কয়েকটি শিক্ষনীয় গল্প
বিচিত্র কুমার
(০১)
দান ও দয়া
রুদ্রপ্রতাপ গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। পেশায় কৃষক, কিন্তু মনুষ্যত্বে একজন সম্পদশালী। তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল দান ও দয়া। বাপ-দাদার সঞ্চয় অনেক না থাকলেও, যা ছিল তা তিনি দু'হাতে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। গ্রামের লোকজন তাকে সম্মানের চোখে দেখতো, যদিও সবাই বুঝতে পারতো না তার দানের গুণ। মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যেন তার কাছে একটা স্বাভাবিক কাজ ছিল।
একদিন রুদ্রপ্রতাপ মাঠ থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ গ্রামের পথে একজন ভিক্ষুক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিক্ষুকের বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, গায়ের কাপড় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। রুদ্রপ্রতাপ তাকিয়ে থাকলেন তার মুখের দিকে। ভিক্ষুকটি বলল, "বাবু, কিছু সাহায্য করুন। খুব কষ্টে আছি।"
রুদ্রপ্রতাপ পকেট থেকে কিছু পয়সা বের করে ভিক্ষুকের হাতে দিলেন। কিন্তু ভিক্ষুকের চাহনি যেন আরও কিছু চায়, যেন কোনো দানের চেয়ে গভীর কিছু। রুদ্রপ্রতাপ বুঝতে পারলেন, শুধু পয়সা দিলেই তার কাজ শেষ হচ্ছে না। তিনি ভিক্ষুককে বললেন, "তোমার নাম কী?"
ভিক্ষুক বলল, "আমার নাম হরিপদ।"
"তুমি কেন এমন পথে পথে ঘুরছো?"
হরিপদ একটু থেমে উত্তর দিল, "আমার একসময় একটা ছোট্ট দোকান ছিল, পরিবার ছিল, সব ছিল। কিন্তু কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এখন আমি শুধু বাঁচার জন্য এখানে-ওখানে ঘুরি।"
রুদ্রপ্রতাপ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তিনি অনুভব করলেন, শুধু পয়সা দিলেই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তার মনে হলো, এখানে দরকার একটু দয়া, একটু সহানুভূতি। তিনি হরিপদকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তাকে খাওয়ালেন, পরানোর জন্য ভালো কাপড় দিলেন। কিছুক্ষণ পর, রুদ্রপ্রতাপ তার সঙ্গে গল্প করতে বসলেন। হরিপদকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার দোকান কি আর ফিরে পেতে চাও?"
হরিপদ বিস্মিত হয়ে উত্তর দিল, "সে কি আর সম্ভব, বাবু? আমি তো সব হারিয়ে ফেলেছি।"
রুদ্রপ্রতাপ বললেন, "জীবনে কখনও হাল ছাড়তে নেই। দানের মতোই দয়া হলো এমন একটা বিষয়, যা শুধু ত্রাণ দেয় না, মানুষকে আত্মবিশ্বাসও ফিরিয়ে দেয়। তুমি চাইলে আবার শুরু করতে পারো।"
হরিপদ কিছুক্ষণ ভাবল। রুদ্রপ্রতাপের কথা তাকে নতুন করে অনুপ্রাণিত করেছিল। সে বলল, "আপনার কথায় নতুন শক্তি পাচ্ছি। যদি সুযোগ পাই, আমি আবার চেষ্টা করবো।"
রুদ্রপ্রতাপ তখন তাকে কিছু টাকা দিলেন, যা দিয়ে সে তার পুরানো দোকানটা আবার চালু করতে পারে। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ শুধু টাকা দিয়েই থেমে থাকেননি, তিনি হরিপদকে একধরনের বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাস, যা তার দান এবং দয়ার গভীরে লুকিয়ে ছিল।
দিন কেটে যায়। কয়েক মাস পর রুদ্রপ্রতাপ যখন আবার গ্রামের পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তিনি দেখেন একটি ছোট্ট দোকানে মানুষের ভিড়। দোকানের মালিক হরিপদ, আর তার মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। রুদ্রপ্রতাপ অনুভব করলেন, তার দয়া শুধু একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনেনি, সেই পরিবর্তন একসময় পুরো সমাজকে ছুঁয়ে যাবে।
তবে গল্পের এখানেই শেষ নয়। রুদ্রপ্রতাপ নিজেও জীবনের এক বড় সংকটে পড়ে। কয়েক বছর পর এক মহামারী আঘাত হানে গ্রামে। ফসল নষ্ট হয়ে যায়, রুদ্রপ্রতাপের জমিও প্রভাবিত হয়। তিনি নিজেও অর্থনৈতিক দুঃসময়ে পড়েন। একসময়, যিনি সমাজের জন্য এতকিছু করেছেন, আজ তিনিই অসহায় হয়ে পড়েন। কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে আসে না। রুদ্রপ্রতাপ বুঝলেন, জীবনে দেওয়া এবং নেওয়ার সমীকরণ সবসময় সরল নয়।
এই সংকটের সময়েই হরিপদ এসে হাজির হয়। রুদ্রপ্রতাপকে সে তার দোকানের আয়ে সহায়তা করতে চায়। হরিপদ বলল, "বাবু, আপনি না থাকলে আমি আজ এখানে দাঁড়াতে পারতাম না। আজ আমি আপনার সাহায্য ছাড়া থাকতে পারি না।"
রুদ্রপ্রতাপ প্রথমে নিতে চাননি, কিন্তু হরিপদের দৃঢ়তার সামনে তিনি নত হলেন। তার চোখে জল এসে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, সত্যিকার দয়া শুধু তাৎক্ষণিক সহানুভূতি নয়, এটি চিরস্থায়ী বৃত্ত হয়ে ফিরে আসে। হরিপদের সাহায্য পেয়ে রুদ্রপ্রতাপ আবার মাথা তুলে দাঁড়ালেন।
সমাজে অনেকেই আছে যারা অর্থ, ক্ষমতা, এবং প্রতিপত্তি দিয়ে নিজেদের দাতা মনে করে। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপের মতো মানুষ দেখায়, দানের প্রকৃত অর্থ শুধুমাত্র বস্তুগত সম্পদ নয়। দয়া এবং সহানুভূতি দিয়ে মানুষের জীবন বদলে দেওয়া যায়, আর সেই বদল মানুষকে আবার সাহায্যের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এটাই দানের প্রকৃত জয়।
দান এবং দয়া—এই দুটি বিষয় জীবনে কিভাবে পারস্পরিকভাবে কাজ করে তা রুদ্রপ্রতাপ ও হরিপদের জীবনের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। একজনের দেওয়া শুধু তাৎক্ষণিক সাহায্য নয়, এটি মানুষের জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। আর সেই পরিবর্তনের ফল একদিন আবার ফিরে আসে।
------
(০২)
গাছের উপকারিতা
জীবন এক অদ্ভুত প্রকৃতি। মানুষ তার প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক কিছুই অর্জন করে, তবে প্রকৃতির দেওয়া দানের মূল্য অনেক সময় অনুধাবন করে না। আজকের গল্পটি আমাদের পরিচিত এবং উপেক্ষিত সেই বন্ধুকে নিয়ে—গাছ। এমন এক সময় যখন কৃত্রিমতা আমাদের চারপাশে জড়িয়ে যাচ্ছে, তখন প্রকৃতির সেই নিবিড় হাতছানি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে।
শহরের এক প্রান্তে এক বৃদ্ধ বসবাস করতেন। নাম তার রামনাথ। একসময় তিনি বন বিভাগের একজন বিখ্যাত কর্মকর্তা ছিলেন। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বনাঞ্চলের সেবায়, গাছপালা লাগিয়ে। কিন্তু বয়সের ভারে অবসর নেওয়ার পর, শহরের কোলাহলে তার মন যেন নিস্তেজ হয়ে উঠছিল। ধীরে ধীরে একাকিত্ব গ্রাস করছিল তাকে।
রামনাথ প্রতিদিন সকালে নিজের বাড়ির ছোট বাগানে এসে বসতেন। তার হাতে ছিল ছোট এক লাঠি, যার সাহায্যে তিনি আস্তে আস্তে গাছের গুঁড়ি স্পর্শ করতেন। গাছগুলোর প্রতি তার ছিল এক অদ্ভুত ভালোবাসা। ছোট ছোট চারা গাছগুলোকে তিনি সন্তানের মতো যত্ন করতেন। প্রতিটি গাছের সঙ্গে তার একেকটি স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। তবে মানুষ এই ভালোবাসা বোঝে না।
একদিন সকালবেলা রামনাথ যখন তার বাগানে হাঁটছিলেন, তার প্রতিবেশী রাজু এসে বলল, "চাচা, আপনার এই বাগানটা বিক্রি করবেন? শহরের মধ্যে এত বড় জায়গা, লাভ অনেক বেশি হবে। আপনার বয়সও তো হয়েছে, টাকা দিয়ে আরাম করবেন।"
রামনাথ হেসে বললেন, "বিক্রি করব? এ গাছগুলো কি তোমার টাকার চেয়ে বেশি মূল্যবান না? তোমরা শুধু নগদ লাভ খোঁজো। গাছের প্রকৃত উপকার বুঝবে কবে?"
রাজু বলল, "চাচা, গাছের উপকার কি আর আমাদের মতো মানুষ বুঝতে পারে? আমরা তো টাকার পেছনে দৌড়াই। সময়ের অভাবে অনেক কিছুই হারাচ্ছি।"
এই কথাটি শুনে রামনাথ তার পুরোনো জীবনের দিকে ফিরে গেলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, গাছের কত রকমের উপকারিতা আছে, কিন্তু মানুষ তা প্রায়ই ভুলে যায়।
তিনি রাজুকে ডেকে বললেন, "শোনো, আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাবো, তারপর ভাববে গাছের উপকারিতা বিক্রি করা উচিত কিনা। অনেক বছর আগে, আমি বন বিভাগের অফিসার ছিলাম। তখনকার কথা। এক ছোট গ্রামে গিয়েছিলাম, যেখানে এক বৃদ্ধ মানুষ এবং তার পরিবার বসবাস করত। তাদের জীবন গাছের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। গাছ তাদের শুধু ছায়া আর অক্সিজেনই দেয়নি, দিয়েছিল খাবার, চিকিৎসা, এবং সব থেকে বড় কথা—জীবনের অর্থ।"
রামনাথ গল্পটা বলতে থাকলেন। "সে গ্রামে একটা বড় বটগাছ ছিল, যা গ্রামের সবাইকে ছায়া দিত। গরমের দিনে গ্রামের মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে বসত, গল্প করত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলত। বটগাছের নীচে গ্রামের বয়স্করা বসে গল্প করত। গাছের নীচে বসে থাকলে মনে হতো, যেন প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি কথা বলছি। সে গাছ শুধু ছায়া নয়, প্রাকৃতিক ওষুধও সরবরাহ করত। গাছের পাতা, ফুল, ফল—সবকিছুই ছিল গ্রামবাসীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
রাজু ধীরে ধীরে মনোযোগ দিচ্ছিল। রামনাথ বলতে লাগলেন, "কিন্তু একদিন, শহরের এক ব্যবসায়ী সেই বটগাছ কেটে ফেলার প্রস্তাব দিল। বলল, সে জায়গায় বড় একটা কারখানা বানাবে। গ্রামের মানুষেরা প্রথমে খুব দ্বিধায় ছিল। তারা ভাবল, গাছের বদলে যদি কারখানা হয়, তবে গ্রামের যুবকরা কাজ পাবে। কিন্তু তারা জানত না যে সেই কারখানার ধোঁয়া তাদের জীবনকেই বিপদে ফেলবে।"
রাজুর চোখে কৌতূহল ফুটে উঠল। সে জিজ্ঞেস করল, "তারপর কী হলো, চাচা?"
রামনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "গ্রামের মানুষ গাছ কেটে ফেলার অনুমতি দিয়ে দিল। সেই ব্যবসায়ী গাছ কেটে ফেলল এবং কারখানা গড়ে তুলল। কিন্তু কয়েক বছর পর, কারখানার দূষণে গ্রামের বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠল। পানীয় জল দূষিত হলো। গ্রামের শিশুদের অসুস্থতা বাড়তে লাগল। তখন গ্রামের মানুষ বুঝল, বটগাছ তাদের শুধু ছায়া আর সৌন্দর্যই দেয়নি, দিয়েছিল তাদের সুস্থ ও সুন্দর জীবন। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। গাছ তো আর ফেরত আসে না।"
রাজু চুপ করে শুনছিল। রামনাথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "তুমি বুঝতে পেরেছ, গাছ বিক্রি করা শুধু অর্থের ব্যাপার নয়। গাছ আমাদের শ্বাস নিতে সাহায্য করে, পরিবেশকে সুস্থ রাখে। আমরা যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য উপভোগ করি, তা এই গাছের দান।"
রাজুর মুখে লজ্জা ফুটে উঠল। সে বলল, "চাচা, আমি আসলে গাছের এত উপকারিতার কথা জানতাম না। আমি শুধু জায়গা আর টাকা নিয়ে ভেবেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, আমাদের দায়িত্ব আছে গাছের প্রতি।"
রামনাথ হেসে বললেন, "তুমি যদি সত্যিই বুঝে থাকো, তবে একটা প্রতিজ্ঞা করো—তুমি যতটুকু পারবে, গাছ লাগাবে। শুধু নিজের স্বার্থের জন্য নয়, পৃথিবীর সবার জন্য।"
রাজু প্রতিজ্ঞা করল। সেদিন থেকেই রাজু নিজে গাছ লাগাতে শুরু করল এবং তার বন্ধুদেরও উৎসাহিত করল। রামনাথ তার ছোট বাগানে প্রতিদিনের মতো বসে থাকলেন। তিনি জানতেন, একদিন এই গাছগুলো আরও অনেক বড় হবে এবং নতুন প্রজন্মকে নতুন করে জীবন দেবে।
গল্পের শেষ কিন্তু বাস্তবের শুরু। মানুষ যখন গাছের আসল উপকারিতা বুঝতে পারবে, তখন পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। গাছ শুধু জীবন দেয় না, জীবনের অর্থও দেয়—এমন একটি অর্থ, যা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না।
------
(০৩)
ঐক্য ও একতা
দুই গ্রামের মধ্যে ছিল দীর্ঘদিনের শত্রুতা। তারা একে অপরের দিকে তাকাতেও চায় না, কথা বলাতো দূরের কথা। গ্রামের বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে খেলাধুলা করতে গেলে বড়রা ধমক দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনে, যেন দুই গ্রাম কখনো এক হতে না পারে। এই বিভেদের গল্পের শুরুর কথা কেউ জানে না, তবে বিভেদের ফল ছিল সুস্পষ্ট—উন্নয়ন থেমে ছিল, মানুষ নিজেরা নিজেদের সমস্যায় ডুবে ছিল, আর ভেতরের ক্ষোভ সমাজকে গ্রাস করছিল।
এমনই এক সময়, গ্রামের মানুষরা জানলো, দুই গ্রামকে ঘিরে একটি বড় সমস্যা আসন্ন। পাশের নদীর জল স্তর দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা দুটি গ্রামেরই জীবনধারার জন্য ভয়ংকর সংকেত। কৃষকদের ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের পুকুরের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, আর গবাদি পশুদের জন্যও খাবার কমে আসছে। কিন্তু এমনকি এ বিপদেও, কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় না। সবাই নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রকৃতির সামনে একা একা কতটুকু লড়াই করা যায়?
এ সময় গ্রামের একজন বৃদ্ধ, নাম রতন, পরামর্শ দিলেন দুই গ্রামের নেতাদের একবার একত্রিত হওয়ার। তিনি বললেন, "বিরোধে আমাদের কিছু আসবে যাবে না। প্রকৃতির রোষ সবাইকে ভুগতে দেবে। আমরা সবাই একই পৃথিবীর মানুষ, এক জল-হাওয়ায় বাঁচি। ঐক্যের মধ্যে যদি শক্তি না থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতও শূন্য।"
রতনের কথা শোনার পর, গ্রামের কিছু মানুষ বুঝতে পারল সত্যি কি হতে চলেছে। তাঁরা জানল, এখনো সময় আছে যদি দুই গ্রাম একত্রিত হয়, তবে নদীর জল সংরক্ষণ করে ফসল বাঁচানো সম্ভব হবে। তাঁদের প্রচেষ্টায় দুই গ্রামের নেতাদের একত্রিত করা গেল। কিন্তু এক হওয়ার প্রথম বাধা ছিল অহংকার। কেউ কারো আগে নতি স্বীকার করতে চায় না। এই সময় আবার রতন মুরুব্বি বলেন, "যদি আমরা এখনও একে অপরকে ছোট ভাবি, তাহলে প্রকৃতি আমাদের সবাইকে ছোট করবে।"
অবশেষে দুই গ্রামের নেতারা নতি স্বীকার করে আলোচনা শুরু করল। প্রথমবারের মতো, তাঁরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করল। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো, দু'টি গ্রামের সমস্যাগুলি আসলে খুবই মিল। প্রত্যেকেই ভাবছিল, শুধু তারাই ভুগছে। কিন্তু সত্যি হলো, এই দুঃখ এবং কষ্ট সকলেরই।
দুই গ্রামের মধ্যে মিলে জল সংরক্ষণের জন্য পরিকল্পনা তৈরি হলো। তাঁরা নদীর তীর বাঁধ দিয়ে শক্ত করল, মিলে একটি বড় পুকুর তৈরি করল যাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়। একই সাথে, তাঁরা সবাই মিলে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করল, কারণ রতন বলেছিলেন, "গাছই আমাদের সুরক্ষার ঢাল। গাছের ছায়ায় ফসল যেমন বাঁচবে, তেমনই নদীর পানি ধরে রাখার শক্তি বাড়বে।"
পরবর্তী এক বছরে দুই গ্রামে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিলো। গ্রামের মানুষ একে অপরের দিকে দোষারোপ না করে, সমস্যাগুলো মিলে মিশে সমাধান করতে শিখল। কেউ কারও থেকে আলাদা নয়—এই উপলব্ধি হলো মূল বিষয়। ঐক্যের মধ্যে সত্যিকারের শক্তি ছিল। একতার জোরে তারা যে শুধু সমস্যার সমাধান করল তা নয়, বরং আগের থেকেও বেশি উন্নতি করল। গ্রামের রাস্তা ভালো হলো, চাষবাসে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলো, এবং সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ আবার একে অপরকে বিশ্বাস করতে শিখল।
এই গল্পের আসল শিক্ষা হলো, প্রকৃতি বা সমাজের যে কোনো বিপদে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি বা বিভেদ মানুষকে বাঁচাতে পারে না। একমাত্র ঐক্যই পারে সব বাধাকে অতিক্রম করতে। জীবনের বড় সমস্যাগুলো তখনই সমাধান হয়, যখন সবাই মিলে তার সমাধানের পথে একসাথে হাঁটে। ঐক্য যেখানে থাকে, সেখানেই উন্নতি, শান্তি, এবং সত্যিকার সমৃদ্ধি থাকে।
-------
(০৪)
সেবা ও সহানুভূতি
শহরের প্রান্তে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রামে থাকতেন বিজন চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, যিনি দিনের পর দিন পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেবা। বিজনবাবু তার চেনাজানা সব মানুষের প্রতি এক গভীর সহানুভূতি পোষণ করতেন। সাহায্য করতে পারলেই তিনি নিজের শান্তি খুঁজে পেতেন। গ্রামবাসীরা জানতেন, সমস্যায় পড়লে বিজনবাবুর কাছে গেলে তারা খালি হাতে ফিরে আসবে না।
বিজনবাবুর বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশের কোঠায়। তার স্ত্রী রেণুকা দেবী এবং ছেলে-মেয়ে মিলে একটি ছোট সংসার। ছেলেমেয়ে দুজনেই শহরের স্কুলে পড়াশোনা করে, কিন্তু বিজনবাবুর মনের ভেতর এক গভীর তৃপ্তি ছিল যে গ্রামে থেকে অন্যদের উপকার করতে পারছেন। তার স্ত্রী প্রথম দিকে কিছুটা বিরক্ত হলেও পরে বুঝে গিয়েছিলেন যে সেবার মানসিকতা তার স্বামীর অন্তরের অংশ।
একদিন সকালে গ্রামে খবর এল যে পাশের গ্রামে এক প্রবীণ বৃদ্ধ একা আছেন, কেউ তার দেখাশোনা করছে না। সবাই বলছিল, "অন্য কেউ কিছু করতে পারবে না। মানুষটি তো সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে।" কিন্তু বিজনবাবু সবার কথা উপেক্ষা করে বৃদ্ধের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
বৃদ্ধের নাম ছিল মনোরঞ্জন দত্ত। বয়সের ভারে তিনি বিছানায় পড়ে আছেন, কারো সঙ্গ ছাড়াই। তার কোনো আত্মীয়স্বজন বেঁচে নেই, এবং গ্রামের মানুষজনও দূরে সরে গেছে। বিজনবাবু সেই বৃদ্ধের ঘরে পৌঁছে দেখলেন, পুরো ঘর অন্ধকারে ঢাকা, ধুলোবালিতে ভরা। বৃদ্ধের শরীর এতটাই দুর্বল যে নিজের জন্য এক গ্লাস পানিও তুলতে পারছেন না।
বিজনবাবু বৃদ্ধের পাশে বসলেন। তিনি ধীরে ধীরে কথা বললেন, "কাকা, আমি এসেছি আপনাকে দেখতে। আপনি আমাকে কিছু বলবেন?"
মনোরঞ্জন দত্তের চোখে পানি ভরে এল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, "বাবা, আমি আর বাঁচতে চাই না। এমন করুণ অবস্থায় পড়ে আছি যে মৃত্যুই আমার জন্য মঙ্গল।"
বিজনবাবু গভীর সহানুভূতি নিয়ে বললেন, "এমন কথা বলবেন না, কাকা। আপনার পাশে থাকতে আমি এসেছি। আপনি একা নন, আমি আপনাকে সাহায্য করব।"
এরপর থেকে বিজনবাবু মনোরঞ্জন দত্তের যত্ন নিতে শুরু করলেন। তিনি প্রতিদিন বৃদ্ধের বাড়ি গিয়ে তাকে খাওয়ানো, ওষুধ দেওয়া, এবং তার যত্ন নেওয়া শুরু করলেন। গ্রামের মানুষজনও এই কাজে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, বৃদ্ধের প্রতি বিজনবাবুর এই সেবার মনোভাব আসলে এক মহান মানবিকতার প্রতীক।
দিনের পর দিন, মনোরঞ্জন দত্ত আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। বিজনবাবুর সেবা ও ভালোবাসায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারলেন না যে এমন নির্লিপ্ত অবস্থায় থেকেও জীবনের প্রতি নতুন আশার আলো ফিরে আসতে পারে।
কিন্তু এর মধ্যে বিজনবাবুর নিজের শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও বয়সের ভারে তিনি দুর্বল হতে লাগলেন। নিজের শরীরের যত্ন নেওয়ার সময়ও তার ছিল না, কারণ তিনি সবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে ফেলেছিলেন।
একদিন, বিজনবাবু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবার তার দেখাশোনা করার জন্য গ্রামবাসীরা এগিয়ে এল। মনোরঞ্জন দত্ত নিজে এসে তার পাশে বসে বললেন, "বাবা, আজ তুমি আমাকে সাহায্য করেছো, এবার তোমার সেবার পালা আমার। আমি তোমার পাশে আছি।"
বিজনবাবু হাসলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, জীবনের আসল অর্থ শুধু নেওয়া নয়, দেওয়া। আজকে তার সেই সেবা ও সহানুভূতি তাকে অন্যদের ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাঝেই ফিরিয়ে দিচ্ছে।
এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে, সেবা এবং সহানুভূতি মানুষকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। সেবা ও ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা কেবল অন্যদের উপকার করি না, নিজের জীবনকেও সমৃদ্ধ করি।
------
(০৫)
ইতিহাসের পাঠ
বাংলাদেশের একটি ছোট গ্রাম ছিল নাম—মহেশপুর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশে ভরা এই গ্রামটি দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অংশ। গ্রামের সবচেয়ে পুরনো স্কুলটির নাম ছিল "মহেশপুর উচ্চ বিদ্যালয়"। এখানে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন—মাস্টারজি রহিম।
মাস্টারজি রহিম ছিলেন ইতিহাসের গভীর পাণ্ডিত। তার পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ছিল অসীম। তিনি জানতেন, ইতিহাসের পাঠ শুধু পুরনো ঘটনার বিবরণ নয়, বরং তা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ দেয়।
একদিন, ক্লাসে একটি নতুন পাঠ শুরু করতে গিয়ে, মাস্টারজি রহিম বললেন, "আজ আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করব, যা আমাদের জীবনের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করবে।"
শিক্ষার্থীরা কৌতূহলী হয়ে উঠল। মাস্টারজি রহিম একটি পুরনো কাহিনী শুরু করলেন যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি ছোট গ্রামের, এবং সেখানে বসবাসকারী এক যুবকের কাহিনী নিয়ে ছিল।
গ্রামটির নাম ছিল মণিরামপুর। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক প্রান্তিক গ্রাম। গ্রামে বসবাসকারী যুবকটির নাম ছিল রুহুল। রুহুল ছিল একটি বড় স্বপ্নের মানুষ। তার স্বপ্ন ছিল, তার গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের পর একটি নতুন ও উন্নত জীবনে প্রবাহিত হোক।
যুদ্ধের পরপরই, গ্রামটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। রুহুল দেখল, গ্রামবাসীদের দুরবস্থা এবং অবকাঠামোর ধ্বংসের চিত্র। তিনি অনুভব করলেন, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের মূল্য দিতে হলে তাকে গ্রামকে পুনর্গঠিত করতে হবে।
রুহুল গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনা করলেন। কিন্তু অনেকেই তার পরিকল্পনাকে সন্দেহের চোখে দেখল। তারা মনে করল, পুনর্গঠন করতে গেলে অনেক টাকা, শক্তি, এবং সময় লাগবে। তবে রুহুল হাল ছেড়ে না দিয়ে, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও স্থানীয় সরকারী সাহায্য সংগ্রহ করতে লাগলেন।
সময় যতই গড়াল, রুহুলের প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে ফলপ্রসূ হতে শুরু করল। তিনি গ্রামবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প শুরু করতে সাহায্য করলেন। স্কুল, ক্লিনিক, ও সড়ক পুনর্নির্মাণ হল। শিক্ষার মান উন্নত হলো, স্বাস্থ্যসেবা বাড়ল, এবং গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা উন্নত হল।
একদিন, গ্রামবাসীরা রুহুলকে সম্মান জানাতে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করল। অনুষ্ঠানে মাস্টারজি রহিম বললেন, "রুহুল আমাদের দেখিয়েছে যে, ইতিহাস শুধু অতীতের কথা নয়; এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আমাদের সংগ্রাম ও ত্যাগের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির পথ তৈরি করা। রুহুলের মতো, আমাদের সবাইকে নিজেদের সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে, যদি আমাদের মধ্যে সেই সাহস এবং উদ্যম থাকে।"
মাস্টারজি রহিমের কথায় শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে প্রভাবিত হল। তারা বুঝতে পারল যে, ইতিহাসের পাঠ শুধু পুরনো ঘটনার বিবরণ নয়; এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মের একটি পথনির্দেশিকা। রুহুলের গল্পের মাধ্যমে তারা শিখতে পারল যে, নিজেদের স্বপ্ন এবং প্রচেষ্টা দিয়ে তারা নিজেদের সমাজ ও দেশকে উন্নত করতে পারে।
এরপর থেকে, মহেশপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের প্রতি নতুন মনোভাব নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠল। তারা বুঝতে পারল যে, ইতিহাস শুধুমাত্র শোনার বিষয় নয়; এটি তাদের জীবনের অংশ, যা তাদেরকে শক্তিশালী ও সচেতন করে তোলে।
---------------
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment