দুটি গল্প ।। মুহাম্মদ ফজলুল হক - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Sunday, July 20, 2025

দুটি গল্প ।। মুহাম্মদ ফজলুল হক


গল্প-১

বৃষ্টিতে একদিন

মুহাম্মদ ফজলুল হক 


বর্ষা এলেই উদাস উদাস লাগে। মেঘবৃষ্টির খেলায় আলাদা অনুভূতি জেগে উঠে। চারপাশে পানি আর পানি। বাড়ীর সামনে উঠান অবধি এসেই থেমে থাকে না পিছনে শৌচাগার ছাপিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত পানিতে সায়লাভ হয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই অস্বস্তি বাড়ে। প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। পানি সংলগ্ন খোলা জায়গায় কাজ সারতে হয়। রান্নাঘরের পিছনে নতুন শৌচাগার তৈরি হয়েছে। শৌচাগার বলতে দুটো করে বাঁশ আড়াআড়ি মাটিতে চাপিয়ে মাঝে আরেকটি বাঁশ রেখে চট দিয়ে কোনরকমে আব্র রক্ষার ব্যবস্থা।

ঘর থেকে বের হলেই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। স্বচ্ছ পানিতে নানান মাছের আনাগোনা একইসাথে ভেজা মাটিতে শামুক-ঝিনুকসহ অন্যান্য অচেনা প্রাণির উপস্থিতি শায়লার মন ভালো করে দেয়। চারপাশে তাকিয়ে চট সরিয়ে পায়খানায় প্রবেশ করে ঝোলানো বাঁশ ধরে অন্য বাঁশের উপর বসে। নিচের স্বচ্ছ পানিতে নিজের ছায়া অবলোকন করে অবাক হয়। আরো অবাক হয় ছায়ার মাঝে ছোট ছোট রঙ্গিন মাছের আনাগোনা দেখে। আনমোনা হয়ে যায় সে। মাছের ছুটাছুটি বেড়ে যায়। কই, শিং ও মাগুর মাছের হল্লাতে পানি যেন উপচে উঠে। কিছুক্ষণ পর বড় মাছ পরিবর্তে আবার ছোট মাছের উপস্থিতি বাড়ে। পানির শব্দে টনক নড়ে। বের হয়ে আসে শায়লা।

ঘরে এসে মাছের জন্য খাবার নিয়ে যায়। রান্নাঘরের পিছনে পরিষ্কার জায়গায় দাড়িয়ে মাছেদের ডেকে খাবার দেয়। নানান মাছের খাবারের প্রতিযোগিতা দেখে আনন্দে অনুভব করে। হাঁস মুরগীর ঘর খুলে দেয়। নাচতে নাচতে হাঁস পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। মুরগীদল উঠানময় পায়চারি করে খাবার খুঁজতে থাকে। বৃষ্টির মাঝে হাঁস, মুরগী, মাছ ও পানির অন্তহীন সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। 


গ্রামের সবাই মনে হয় দুপুরেই গোসল করে। ছোট থেকে বড় সবার যেন এই সময় পছন্দ। সবার বাড়ির সামনে পানি তবু গোসল করার জন্য আলাদা ঘাট আছে। শায়লাদের বাড়ি থেকে দুই বাড়ি এগিয়ে বাম দিকে এগুলে ঘাট দেখা যায়। ঘাটের পাশ দিয়ে নৌকা নিয়ে মানুষ চলাচল করে।
মাটি আর পানি প্রায় সমান সমান। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ায় বাড়িঘর ভাঙ্গছে। কাঠ-বাঁশসহ নানা উপকরণ দিয়ে ভাঙ্গা রোধের কত প্রচেষ্টা চোখে পড়ে।

কলাগাছ ও বাঁশ দিয়ে ঘাট বানানো। নামেই ঘাট! আশপাশের সব জায়গায় মানুষ গোসল করছে। গরু-ছাগল গোসল করাচ্ছে। পোলাপান দল বেঁধে হৈ-হুল্লোড় করছে। তলিয়ে যাওয়া পুকুর পাড়ের হিজল গাছ থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ছে। পানি দেখে রাগ উঠে শায়লার। একটু শান্তিমত গোসল করবে সে ব্যবস্থা নেই। টিপটিপ বৃষ্টি, ঢেউয়ের যন্ত্রণা, কুচুরি পানার বাড়াবাড়ি তার উপর পোলাপানের লুটোপুটিতে সব একাকার। শম্পা, ময়না, টুম্পা, রাশেদ, আলম ও কবিরকে চোখে পড়ে। গাছ উঠে বিভিন্ন ডাল থেকে মনের সুখে লাফিয়ে পানিতে পড়ছে। তর সয় না শায়লার। সব রাগ উবে যায়। হাতের কাপড় রেখে দৌড়ে পানিতে নামে। সাতার কেটে পুকুর পাড়ে যায়। তাকে দেখে খুশি হয় সবায়। হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। গাছে উঠে শায়লা। সবচেয়ে উপরের ঢাল থেকে লাফ দেয়। আহা! শান্তি। এভাবে চলতেই থাকে। শরীরে শ্যাওলা জমছে। চোখ লাল হয়ে আমছে। ক্লান্তি নেই কারো।

টুম্পা কাছে এসে বলে, চল সাতার কেটে টিলায় যাই। অনেক মজা হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সবাই সাতার শুরু করে। সবার আগে টুম্পা, রাশেদ ও শায়লা। ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে এগিয়ে চলছে। টিলা এখান থেকে নিকটে মনে হলেও বেশ দুর। নদী ও গ্রামের মাঝখানে টিলা। টিলা বলতে উচুঁ জমি৷ কয়েক বছর আগে শায়লার দাদা এই জমি ক্রয় করে পুকুর কেটেছে। পুকুর কাটা মাটি জমা করা রাখায় দুর থেকে টিলার মত দেখায়। টিলা পানি থেকে সামান্য উপরে। পরিপূর্ণ বর্ষা না হলে ডুবে না। 

একসাথে অনেকে সাতার শুরু করলে মাঝপথে থেমে যায় অনেকে। পুকুর পাড় দিয়ে ফিরে আসে। টিলার নিকটবর্তী দেখা যায় রাশেদ ও শায়লাকে। চারদিকের পানির বিশালতায় ভয় ঢুকে রাশেদের মনে। শায়লা অভয় দেয়। ভয় পাস না। আরেকটু। আমরা পৌঁছে যাবো। রাশেদের ভয় কাটে না। পাশাপাশি সাতার কাটে দুজন। শায়লা সহায়তা করে। হাত ধরে পৌঁছে যায় টিলাতে। 

টিলায় পৌঁছে শান্ত হলেও গভীর ক্লান্তিবোধ করে। হাত-পা ছড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে শুয়ে থাকে দুজন। এভাবে কতক্ষণ ছিল টের পায় না কেউ। চোখ মেলে অবাক হয় রাশেদ। ভেজা শরীরে কি অপরূপ লাগছে শায়লাকে। তাকিয়ে থাকে পলকহীন। চোখ ফেরাতে পারে না। সতেজ হয়ে উঠে সে। শায়লার পায়ের দিকে চোখ যায়। গোড়ালির কাছে রক্ত ঝড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে একটি জোক রক্ত চুষে নিচ্ছে। হাত দিয়ে সরালে উঠে বসে শায়লা। তীর্যক দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলে শালার জোক রক্ত খাওয়ার আর সময় পাওনি। হেসে উঠে রাশেদ। হেসে উঠে শায়লাও।

পুরো টিলা ফাঁকা হলেও বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা, পোকামাকড় ও শামুক ঝিনুকে ভরপুর। উল্টাদিকে কিছু হাঁস দেখা যায়। হাঁস দেখে শায়লার মনে হয় একটু খোঁজলে নিশ্চয়ই ডিম পাওয়া যাবে। দুজনে মিলে ডিম খুঁজতে যায়। হাঁসের মৈথুন চোখে পড়ে।না দেখান ভান করে রাশেদ। ইতোমধ্যে ডিমও খুঁজে পায় কয়েকটি। ফিরে আসার প্রস্তুতি নেয়। আকাশ মেঘলা হয়ে উঠে। কিছু বুঝার আগেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির আনন্দে রাশেদের হাত ধরে নেচে উঠে শায়লা। বৃষ্টি বাড়তে থাকে।

বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে আসে। আকাশ নিজেই যেন  ভেঙ্গে পড়েছে। দিগন্তজোড়া পানিপ্রবাহে কেবল ঢেউয়ের খেলা। বৃষ্টির সাথে ঢেউয়ের মিলনে অপূর্ব সংগীত সৃষ্টি হয়। শায়লা সেই সংগীতে নিজকে উজার করে দেয়। মাথা উপরের দিকে তুলে চোখ বন্ধ করে হাত ছড়িয়ে নাচতে থাকে। রাশেদ হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার জীবনে এমন মুহূর্ত আগে কখনো আসেনি। পৃথিবী থেমে গেছে বলে মনে হয়। 

তুই পাগল, বলে রাশেদ। শায়লা চোখ মেলে তাকায়। এই তো বৃষ্টি। ইস, সময় যদি থেমে যেত। এই বৃষ্টি, এই পানি সব এমনই থাকুক চিরকাল। রাশেদ অপ্রস্তুত হয়। মাথা ঘুরিয়ে দেখে চারপাশে কেউ নেই। অস্পষ্টভাবে দূরে কিছু মানুষ দেখা যায়। ডিম আঁচলে জড়িয়ে নেয় শায়লা। 
রাশেদ বলে, মাথায় কিছু আছে? না রে, শুধু বৃষ্টি আছে। তুই বুঝবি না। যারা বৃষ্টিতে ভিজে না তারা কখনো বুঝবে না এই আনন্দ। 

হঠাৎ বজ্রপাত হয়। আকাশ গর্জে উঠে। রাশেদ বলে, চল এবার বাড়ি যাই। শায়লা চুপ থাকে। তারপর বলে, একটু দাঁড়া। ওইদিকে যাই। তোকে একটা জিনিস দেখাবো। সে আবার কী? শায়লা জামা খুলে শেমিজ তুলে বুকের মাঝখানে একজোড়া তিল দেখায়। ভালো করে দেখে রাখ। প্রথমটির নাম শায়লা, দ্বিতীয়টির নাম রাশেদ। তারা জীবনভর পাশাপাশি থাকবে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় শায়লার মুখ, ভেজা চুল, চোখ ও ঠোঁটসহ সমগ্র শরীর অপূর্ব দীপ্তি ছড়ায়। চুপচাপ তাকিয়ে থেকে স্তব্দ হয়ে যায় রাশেদ। তার চোখে আগুন লাগে।পুড়ে যাওযার সুখে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। রাশেদের উত্তাপের সুখে পুড়তে থাকে শায়লাও। উত্তাপ ক্রমান্বয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হতে হতে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শান্ত হয় দুজন।


তুই সত্যি আলাদা শায়লা। অন্যরকম। রাশেদ নিরবতা ভাঙ্গে। শায়লা হেসে বলে, তা জানি। তোকে একটা কথা বলি রাশেদ। কেউ জানে না আমি মাঝে মাঝে এখানে আসি। শুধু বৃষ্টির দিনে। জায়গাটা আমার খুব পছন্দের। চাইলে কাঁদতে পারি। আনন্দে আবার নাচতেও পারি। তুই সত্যি অনন্য সুন্দর। আজ প্রথম দেখলাম তোর অনন্যনতা। তুই কবি হলি কবে? এই বৃষ্টিতেই বোধহয়। তোর সঙ্গে ভিজতে ভিজতে নাকি জ্বলতে জ্বলতে। হাসিতে ফেটে পড়ে দুজন। বৃষ্টির শব্দে তাদের হাসি চাপা পড়ে যায়।

টিলার পেছন একটু উঁচু জায়গায় বসে আছে তারা। এবার নামি, বলে রাশেদ। না রে, বৃষ্টি কমুক। শায়লা বলে। যদি বৃষ্টি এত ভালো লাগে বিয়ে করে নে, বৃষ্টিকে? বৃষ্টি তো চিরকাল থাকে না রে বোকা। আমি যে চিরকাল কারো হতে চাই। রাশেদের বুক কেঁপে ওঠে। সে বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। শায়লা ঘেঁষে বসে। তার ভেজা শরীর লেপ্টে যায় রাশেদের শরীরের সাথে। নীরবতা ভেদ করে শায়লা বলে, আমরা কি বন্ধু থাকবো সারাজীবন? বন্ধু মানে কি জানিস? যার সাথে পুড়তে কিংবা ভিজতে খারাপ লাগে না। কথা শেষ হয় না। সেই তো বন্ধু।

হঠাৎ ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। চল এবার বাড়ি ফিরি। বলে শায়লাকে হাত ধরে পানিতে নামায় রাশেদ। কিছু না বলে অভিমানী ভঙ্গিতে রাশেদকে অনুসরণ করে শায়লা। খুব কাছাকাছি থেকে সাতার শুরু করে। রাশেদ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কোন ভয় পা না এবার। মনে হয় পানিতে ভয়ের কিছু নেই। শায়লা পাশে আছে। পানি তাদের বহন করছে। ঠিক যেভাবে বৃষ্টি তাদের ভালোবাসার গান গেয়ে চলছে। মনের সুখে নিয়ে ফিরে আসে তারা।

সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে মাছ ভাজার গন্ধ। উঠানে হাঁস-মুরগীর কলরব। বৃষ্টির ফোঁটা কমেছে। আকাশে হালকা নীলাভ আলো। শায়লা আর রাশেদ উঠানে দাঁড়িয়ে। শায়লা বলে, আবার আসবি টিলায়? রাশেদ চুপ থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। তুই ডাকলে আসব। বর্ষা শেষ হলে দেখা হবে আমাদের? হবে। এমন বর্ষা আর আসবে না। এই বৃষ্টি, এই দিন আজকের মতো হবে না কখনো।

শায়লা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। রাশেদ পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে। নীরবতায় তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়ে উঠে। বৃষ্টি নিজের ভাষায় তাদের মনের কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। এভাবেই শেষ হয় এক বৃষ্টির দিন। জলরঙে আঁকা স্মৃতির মত এক টুকরো ভেজা গল্প। শুধু শায়লা আর রাশেদ জানে। টিলায় বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে চিরকালীন যে সুখ উপলব্ধি করেছে তা কখনো  রোদেও শুকোবে না।


============

গল্প-২

দোলাচল

মুহাম্মদ ফজলুল হক 


সৃষ্টিলগ্ন থেকেই দ্বৈত চেতনার অধিকারী মানুষ।  সময়ের প্রবাহে দ্বৈততা মসৃণ ও সূক্ষ্ম হয়েছে।  একই সঙ্গে একাধিক চিন্তা করার ক্ষমতা থাকায়  মানুষ অন্য সব প্রাণীর চেয়ে শক্তিশালী। অভিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই মূহুর্তে সে শম্পার কাছে সমর্পিত অথচ ভাবছে চৈতীর কথা। এখন শম্পাকে শান্ত করলেও আগামীকাল চৈতীকে সমালাবে কিভাবে? সে অবাক হয় দীর্ঘদিন যাবত কত নিখুঁত ভাবে দুজনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলছে। তাকে যদি একজনকে বেছে নিতে বলা হয় সে কাকে নিবে? শম্পা না চৈতী! সেকি দুজনকে ভালোবাসে। একই সময়ে কি দুজন ভালোবাসা সম্ভব। এই দ্বৈততা কি তার নিয়তি!

নিরিবিলি শান্ত স্বভাবের শম্পা। কখনোই কাউকে অধিকার করতে চায় না। বিশ্বাসের প্রবনতা প্রবল। তার উপলব্ধি আমিতো ঠকাইনি কাউকে। আমাকে কথা দিয়ে যদি কেউ যদি সে কথা না রাখে সেইতো বিশ্বাস ঘাতকতা করল। তার প্রায়শ্চিত্ত সে করবে। শম্পার ব্যতিক্রমতা অভির চোখ এড়ায়নি।  চলনে-বলনে, ফ্যাশনে, চিন্তা-চেতনায় সব তার নিজের মত। সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কে পারিবারিক ঐতিহ্য প্রকাশ থেকে বিরত।

চৈতী বিপরীত। মধ্যবিত্ত ঘরনার হলেও ধ্যান-ধারনায় অন্যরকম। বাড়িয়ে প্রকাশ করার প্রবনতা।বাচালতা ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম। চেহারায় সরলতার আবরণ থাকায় সবাই পছন্দ করে। বকবকানি করলেও মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। ন্যায়নীতি আদর্শ ধরে রাখার চেষ্টা করে। অকপটে নিজের মতামত প্রকাশে দ্বিধা করে না।

বিরূপ পরিবেশে বড় হয়েছে অভি। বড় হওয়ার আগেই বুঝতে পারে বাবা তাদের ছেড়ে আলাদা সংসার করছে। বাবার কথা মনে না থাকলেও মায়ের সব নখদর্পনে। অল্প বয়সে মাকে আবিষ্কার করে তুহিন অ্যাঙ্কেলের বাহুডোরে।

অভির জীবনে সম্পর্কগুলো জটিল। সম্পর্ক নিয়ে কখনোই দ্বন্দ্ব অনুভব করে না সে। দ্বৈততা তার নিকট খেলা। এক্ষেত্রে সে নিজেকে দক্ষ খেলোয়াড় মনে করে। শম্পা তাকে ভালোবাসে বিশ্বাস করে। চৈতীও তাকে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসায় অধিকারবোধ আছে। শম্পার নীরবতা আর চৈতীর স্পষ্টবাদিতা। দুই বিপরীত মেরুর মাঝে অভি নিজকে শক্তিমান মনে করে।

অভি ভাবে অনন্যতা বলতে কিছু নেই। সমগ্র মানব জীবনই অনন্য। জীবনের ভগ্নাংশ অনন্যরূপে ধরা দেয় ভালোবাসায়। ভালোবাসাময় জীবন হয়ে উঠে সুখময়। প্রচুর ভালোবাসতে হবে। শম্পা ও চৈতী দুজনকে প্রগাঢ়ভাবে ভালোবাসবে সে। এই উপলব্ধি তাকে আরো শক্তিশালী ও প্রানবন্ত করে।

জীবনের জটিলতা স্পর্শ করে না অভিকে। তার বেড়ে উঠার জীবন তাকে এই শিক্ষা দিয়েছে। মায়ের প্রতিমূহুর্তের কালিমা সব সহ্য করতে শিখিয়েছে। একবার মা ও তুহিন অ্যাঙ্কেলকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। তাদের বোহেমিয়ান জীবন অসহ্য ঠেকছিল। বাবার অবহেলা ও অ্যাঙ্কলের বিশ্বস্ততায় সব অন্যায় মেনে নেওয়ার বোধ জম্ম নেয়। 

বাবা চলে যাওয়ার পর অভিকে নিয়ে নানার বাড়িতে চলে আসে মা। গ্রামটি পছন্দ হয় তার। নান্দনিক সজ্জিত। গ্রামের সামনে ও পিছনে একটি করে নদী। কয়েক বাড়ি পর পর ছোট ছোট পুকুর। ফসলে ভরা প্রায় জমি। সবুজ হলুদের মিশ্রণে একাকার। চেনা অচেনা গাছগাছালি ভরা ঝুপঝাড়। লতাপাতার মিলেমিশে বুনো জঙ্গল। উঁচু গাছের শাখায় শাখায় স্বর্ণলতা। অপরিকল্পিত গাছগাছালি ভরা সবুজে পরিবেষ্টিত অনিন্দ সুন্দর গ্রাম। গাছে গাছে পাখির কলতান উঠানে হাঁস-মুরগি, ঘরের চালে কবুতরের মধুর ডাকাডাকিতে স্বপ্নময় পরিবেশ।

গ্রামে এসেই বন্ধুত্ব হয় অনেকের সাথে। সবার চেয়ে এগিয়ে শশী। তাকে নিয়ে পুকুরে গোসল করে। বাড়ী থেকে একটু এগুলে মসজিদ। মসজিদ পিছনে সরু খাল। সামনে দিয়ে হাটে যাওয়ার রাস্তা। একটু এগুলে ডানপাশে পুকুর। বসন্তের তাপদাহে নদী নালা খাল বিল প্রায় পানি শূন্য। । কোথাও পানি নেই। অল্প পানি পুকুরে। কাদা ভর্তি পুকুর কচুরি পানায় ভরপুর। কচুরিপানা সরিয়ে গাছের গুড়িতে বসে মগ দিয়ে শরীরে পানি ঢালে শশী। অভিকে আরো কাছে ডাকে। সবান ঘষতে ঘষতে নিজের বুক দেখায়। কিছু না দেখলেও অভির ভালো লাগে। 

অভির বাড়ীর সামনেই বিশাল বটগাছ। গাছের পাতা নড়ার শব্দে ভূতরে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। গাছ পেড়িয়ে এগুলে মসজিদ। পাশে সওদাগর বাড়ি। বাড়ি ও মসজিদের মাঝে ফাকাঁ জায়গায় মলিসহ অন্যরা খেলাধুলা করছে। খেলার ছলে মলি অভিকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, তুই জানিস, তুই দেখতে কত সুন্দর। আমার  ভাইয়ের থেকেও বেশি সুন্দর। অভির অস্বস্তি হলেও শশীর চোখের উজ্জ্বলতা তাকে মুগ্ধ করে।

ছোট খালা আসে বেড়াতে। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে। রাতে অভিকে সাথে নিয়ে ঘুমায়। চাঁদের আলো বেড়ার ফাঁকে ঘরে ঢুকে। পাটখড়ির তৈরি ঘর। দরজা নেই বললেই চলে। লাঠি দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে দরজা আটকানো। লাঠি সরিয়ে দরজা খোলে অভির হাত ধরে বাহির হয়। রাতের স্তব্ধতা ভালো লাগে অভির। তাকে সামনে রেখেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় খালা। চাঁদের আলোতে পাহারাদার হয়ে নিশ্চুপ দাড়িয়ে একই কর্ম করে অভি।

নারী আসক্তি পুরোপুরি জাগ্রত না হলেও সব নারীই তাকে পছন্দ করে অভিকে। তাঁর চারপাশে নারীর আনাগোনা বেশি। দিনে দিনে তার পৌরুষ জাগ্রত হয়। নারী সঙ্গে সুখী হয় সে। তবে তাঁর সচেতনতা তাকে রক্ষা করে। শম্পা ও চৈতীর সাথে মিট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার পৌরুষ অক্ষুণ্ণ ছিল।

জীবনের জটিলতায় বার বার আবদ্ধ হলেও ঠিকই পথ খুঁজে পেয়েছে অভি। শুধু একবার থমকে যায়। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আকড়ে ধরে । এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না। শীতের রাত। নিকষ কালো অন্ধকার। ছনের বিছানায় কাথামুড়ে বরাবরের মত ঘুমিয়ে সে। গোঙ্গানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। মূহুর্তে সব স্পষ্ট হয়। তুহিন অ্যাঙ্গেল লেপ্টে আছে মাকে। নড়াচড়া করছে দুজন। অবাক হলেও সামলে নেয় নিজকে। অসহায়ত্বে চোখে পানি চলে আসে। আগলহীন খুপড়ি দিয়ে চলে যায় তুহিন অ্যাঙ্কেল। সকালে বুদ্ধিমত্তার সাথে সব ঘুছিয়ে বলে নানুকে। সন্ধার আগেই মায়ের বিয়ে হয়। অ্যাঙ্কেল থেকে পিতা হয়ে উঠে তুহিন অ্যাঙ্কেল।

অভি বুঝতে পারে একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসা মানে আসলে কাউকেই পুরোপুরি ভালোবাসতে না পারা। একদিকে শম্পার নিঃশব্দ ভালোবাসা অন্যদিকে চৈতীর স্পষ্টবাদিতা। দুজনের টানাপোড়েনে সে ক্লান্ত । অভি ভাবে সে কি আদৌ কারও জন্য উপযুক্ত? শৈশব থেকে সে শুধু ভালোবাসাকে পেয়েছে। কখনো ভালোবাসার প্রকৃত রূপ অনুধাবন করেনি।

চৈতী অভিকে বলে, তুমি আমাকে ভালোবাসো?
চৈতীর সরাসরি প্রশ্নে সে চমকে যায়। হাসি লুকিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলে। তুমি তো জানো, ভালোবাসা একক অনুভূতি নয়।
আমি জানতে চাই। আমার জন্য তোমার ভালোবাসা ককটুকু?
অভি কিছু বলতে চায়। তার কণ্ঠ আটকে যায়।
সে জানে এই মুহূর্তে সত্য বললে চৈতীকে হারাবে। মিথ্যে বললে নিজেকে হারাবে। জবাব দেয় না। চৈত্রীকে জড়িয়ে ধরে। নিঃশ্বাসের শব্দের সাথে অভির হৃৎস্পন্দন চৈতীকে জানান দেয়। চৈতীর মন ভালো হয়ে যায়। চৈতী ধীরে ধীরে বলে। আমার কাছে তোমার নীরবতাই উত্তর। অভি উপলদ্ধি করে চৈতী আর কখনো তাকে ভুল বুঝবে না।
তুমি কখনো সত্যিটা বলতে পারবে না?
সত্যিটা কী  ?
সত্যি হলো তুমি একা থাকতে ভয় পাও। শূন্যতা ঢাকতে আমাদের সাথে ভালোবাসার অভিনয়  করছ।
আমি কি অন্যায় করছি ? সবাই তো ভালোবাসা চায়।
ভালোবাসা ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না, অভি। 
তুমি কখনো  আমার কষ্ট অনুভব করেছ?
চুপ থাকে অভি।
আমি তোমার বিকল্প ছিলাম।

শম্পা কি এই দ্বৈততার কথা জানে? নীরব থেকেই সব মেনে নেবে? অভি জানে না। শুধু জানে তার পৃথিবী সবসময় সংঘাতময়। যা সে উপভোগ করে।

শম্পা বলে, তুমি কি জান, তোমার চোখে আমি কী দেখি? এক অদ্ভুত শূন্যতা। তুমি ভালোবাসতে জানো না। শুধু পেতে চাও, নিজকে দিতে চাও না। অভি থমকে যায়। সত্যিই কি সে কাউকে ভালোবাসে?
ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। তুমি কখনো নিজেকে কাউকে দিয়েছ?
উপলব্ধি করেনি
তুমি শুধু নিতে চেয়েছ, ভালোবাসার নামে খেলেছ।
আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি, শম্পা।
তুমি শুধু কষ্ট দিয়েছ। চৈতীকে কষ্ট দিয়েছ, আমাকে কষ্ট দিয়েছ। শেষ পর্যন্ত নিজেকেও কষ্ট দিচ্ছ।
ক্ষমা করে দাও।
ক্ষমা!
অভির দ্বৈততা তার জন্য অভিশাপে পরিণত হয়। চৈতী জানতে পারে শম্পার কথা। অভিমানে সে অভির কাছ থেকে সরে যায়। শম্পাও চলে যায় কোন অভিযোগ না করে। অভি তখনো বুঝতে পারে না দুই নারীর অনুপস্থিতি তার জীবনে কী প্রভাব ফেলবে। অভি প্রথমবারের মতো শূন্যতা অনুভব করে। যে দ্বৈততা তাকে শক্তিশালী করেছিল। সেই দ্বৈততা সব কেড়ে নিয়েছে। 

===========

মুহাম্মদ ফজলুল হক 
শিক্ষক, সরকারি জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজ 
ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ। 

No comments:

Post a Comment