দীপক পাল
চেনা প্রতিবেশী
(তৃতীয় পর্ব )
তিনটে ফ্ল্যাটই দেখলো ইমন খুব ভাল করে ঘুরে ঘুরে। ত্রিহানের সাথে আলোচনা করে ঠিক করলো ফিফথ্ ফ্লোরের ফ্ল্যাটটা বুক করাটাই যুক্তিগ্রাহ্য হবে। করণ ইলেভেন্থ ফ্লোরের এবং ফার্স্ট ফ্লোরের পজিশন যত ভালই হোক না কেন একটা উচ্চতা জনিত এবং ছাদের ঠিক নিচে বলে ওটাকে ইমন বাদের দিকেই রাখলো। ফার্স্ট ফ্লোরেরটা দক্ষিণ মুখো হলেও একদম সবসময় চলাফেরা রাস্তার ধার ঘেঁষে হওয়ায় ওটাকেও বাদের দলে রাখলো। কেনই বা রাখবে না যখন ফিফথ্ ফ্লোরেরটা ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। যদিও ওটা দক্ষিণ মুখো নয় কিন্তু পূব মুখোতো বটে। আবার উত্তর দিকটা তো চাপা। দুটো ঘর তার মধ্যে একটায় এটাচ বাথরুম আর একটা ঘরের বাইরে একটা কমে বাথরুম। দুটো ছোট বারান্দা। এছাড়া মাঝে আছে একটা বড়ো প্যাসেজ যেটাকে দুটো ভাগ করে নিলে ডাইনিং ও ড্রয়িং আলাদা করে নেওয়া যায়। যদিও ইমন সেটা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। সত্যি নিজেদের নামে যদি ফ্ল্যাটটা হয় তখন ভাবা যাবে। যদিও ফ্ল্যাটটা দুজনেরই পছন্দ হয়েছে কিন্তু তাতে কি।
ওখান থেকে ফিরে ত্রিহানরা অফিস রুমে গিয়ে বসলো। বীরেন ম্যাডামকে খবর দিতে গেল। কিছুক্ষণ পরে মিনু ম্যাডাম এসে জিগ্গেস করলো,
- 'বলুন, আপনাদের কি কিছু পছন্দ হলো?'
ত্রিহান বললো, - 'আমাদের ফিফথ্ ফ্লোরের যেটা পূবমুখো ফ্ল্যাট সেটাই পছন্দ এবং ওটাই নেবো ভাবছি।'
- 'যদি ঐ ফ্ল্যটটা নিতে চান তো আমি বলবো আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি একদম ঠিক। অনেক উঁচুতে উঠতে হলো না আবার একদম ফার্স্ট ফ্লোরে যদি সেটা একদম রাস্তার ধারে হয় তা হলে নানা রকম সমস্যা হতে পারে। সেদিক দিয়ে আপনাদের ভাবনা একদম ঠিক। এদিকে সকালে উঠেই সূর্যের মুখ দেখতে পাবেন। ভারি চার্মিং তাই না? অবশ্য আরো দুটো বহুতল বাড়ী উঠছে আমাদের খেয়াল করেছেন বোধহয় আপনারা সেখানেও এখন বুক করে রাখতে পারেন পছন্দ মতো ফ্ল্যাট।'
ইমন বলে,
- ' না আমরা একটু তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটের ব্যাপারটা সেটেল্ করতে চাই তবে একটুখানি জানতে চাই যে দুটো ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে সেটার জন্য সূর্যের মুখ কি ঢাকতে পারে?'
- ' আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে যতটুকু উঠেছে সেই লাইনটা যদি দেখি তাতে মনে হয় যদি কিছুটা ঢাকে তবে সেটা হবে গরমকালে কিন্তু শীতকালে মোটেই নয়। আমার কিন্তু মনে হয় সেটা হবে উপরন্তু আপনাদের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ। তাই না?' ত্রিহান বলে,
- ' আচ্ছা আপনাদের ফ্ল্যাট বুক করার আইন কানুনটা যদি একটু বলেন, আমি অবশ্য স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেব ।'
- ' যদি প্রয়োজন পরে বলবেন, স্টেট ব্যাঙ্কের সাথে আমাদের ভাল যোগাযোগ আছে। এখন কাজের কথায় আসা যাক। ফ্ল্যাটের মূল্য আটত্রিশ লক্ষ টাকা। ফ্ল্যাট বুক করতে লাগে দশ পার্সেন্ট অর্থাৎ তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা। ঐ টাকাটা পে করলেই আপনার ফ্ল্যাট বুক হয়ে যাবে। এরপর একুশ দিনের মধ্যে আবার তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা দিতে হবে। এই টাকাটা একুশ দিনের মধ্যে জমা দিলে আপনি ব্যাঙ্কে লোন পাবেন। বোঝাতে পারলাম?'
- ' আমি তাহলে তিন লক্ষ আশি হাজার টাকার একটা চেক লিখে দিই?'
- ' হ্যাঁ দিতে পারেন। আমাদের তরফ থেকে একটা মানি রিসিট ইসু করা হবে রিসিভ্ড্ বাট নট্ ভেরিফাইড। সেক্ষেত্রে ক্লিয়েয়ারিং যেদিন হবে সেদিন থেকে আপনার নামে ফ্ল্যাট বুকড্ ধরা হবে। আর সেদিন থেকে একুশ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় কিস্তি জমা দিতে হবে। ব্যাঙ্ক থেকেই আপনি জানতে পারবেন কবে চেক ক্লিয়ার হয়েছে।'
ত্রিহান ব্যাগ থেকে চেক বই বার করে কি নামে হবে সেটা জেনে নিয়ে চেক লিখে দিয়ে মিনু ম্যডামকে দিয়ে বিদায় জানালো।
বাড়ী ফিরে ইমন ত্রিহানকে জিগ্গেস করলো,
- ' আচ্ছা ত্রিহান ব্যাঙ্ক প্রায় খালি করে টাকাটা তো দিলে এরপর বাকি দশ পার্সেন্ট টাকা কিভাবে জোগাড় করবে? হাতে তো মাত্র একুশ দিনের সময় আছে।'
- ' কোন চিন্তা করো না। অফিসে সব ব্যাবস্থা করে রেখেছি। আশা করি একুশ দিনের আগেই বাকি তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা জমা দিতে পারবো। আর এর মধ্যে একদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে এই মানি রিসিট দেখিয়ে লোনের জন্য কথা বার্তা বলবো। আর তখনই
জানতে পারবো চেক ক্লিয়ারিং কবে হলো। বুঝতে পারলে?'
- ' হ্যাঁ বুঝেছি। যাই জামা কাপড় পাল্টে চা বানিয়ে নিয়ে আসি।' পাশের ঘরে গেল ইমন।
রান্নাঘরে ঢুকলো ইমন। তার মুখে যেন এক আলোছায়া খেলে বেড়াচ্ছে। তার মনে আশা নিরাশার দোলচাল। ত্রিহান আর নিজের জন্য চা বিস্কুট আর আহিরের জন্য হেলথ ড্রিঙ্কস্ ও বিস্কুট বানিয়ে আনলো। ত্রিহানও এর মধ্যে ড্রেস পাল্টে নিয়েছে। এসে বসলো টেবিলে। আহিরকে ডাকতেই দৌড়ে চলে এলো আহির। দুজনের মাঝখানে এসে বসলো। ইমন বলে, ' আহিরসোনা দেখতো তুমি নিজে নিজে খেতে পারো কিনা, আমি আর বাবাও তো নিজে নিজে চা বিস্কুট খাচ্ছি, তুমিও পারবে। না পারলে আমরা হেল্প করে দেব কেমন। ত্রিহান আমার একটা নিজস্ব ফ্লাট হতে যাচ্ছে এটা কিন্তু আমি মাত্র কিছুদিন আগেও ভাবিনি। অবশ্য এখনও আমার মনে সংশয় কাটেনি।' আহিরকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে।
- ' ইমন, দেখ ফ্ল্যাট বুক করেছি ব্যাঙ্কের সাথে কথাও হয়েছে অতএব বাকি কাজটাও করে ফেলবো ঠিক। কোন চিন্তা করো না। তোমাকে খালি আমার সাথে দুদিন বেরোতে হবে। একদিন শান্তি এপার্টমেন্টে আর একদিন ব্যাঙ্কে।'
কয়েকদিন সংসার গতানুগতিক ভাবে চললো। ত্রিহান সকালে খেয়ে অফিস যায়। ইমন ওর জন্য টিফিন বানিয়ে অফিসের কাঁধে ঝোলানো ব্যগে ঢুকিয়ে দেয়। কোন খবর থাকলে ত্রিহান অফিস থেকে ফিরে বলে ইমনকে। বিকালের দিকে ইমন আহিরকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যায় আবার সন্ধ্যা হলে ঘরে ফিরে আসে। কোন কোন দিন ত্রিহান অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে সোজা পার্কে ঢুকে পরে। আহিরের সাথে দৌরোদৌরি করে খেলে তারপর সন্ধ্যার সময় বাড়ী ফিরে আসে। কোন কোন দিন ত্রিহান বাড়ী ফিরে টিফিন চা খেয়ে আহিরকে কাঁধে তুলে হকার সেজে হাঁকে, ' চাই আলুর বস্তা, চাই ইলিশ মাছ, কে নেবে গো।' কোন দিন কাগজ পত্র কলম নিয়ে বসে হিসাব করে। তখন ইমন রান্নাঘরের কাজ শেষ করে আহিরকে বাংলা ও ইংরেজী রাইমস শেখায়। যেদিন মিনু ম্যাডামের হাতে চেকটা তুলে দিয়েছিল ত্রিহান তার থেকে আঠারো দিনের মাথায় তিন লক্ষ আশি হাজার টাকার একটা ড্রাফট বাড়ী ফিরে সে ইমনের চোখের ওপর নাড়াতে থাকলো। সে তখন আহিরকে খাওয়াচ্ছিল। আহির হাত বাড়াতে ড্রাফটটা ত্রিহান সরিয়ে নিয়ে বললো,
- ' এটা মা তোমার খেলার জিনিস নয়। এটা আমার খেলার জিনিস বুজে?' ইমন বলে,
- ' ওটা মনে হয় একটা ড্রাফট তাই যদি হয় তবে ড্রাফট কেন?'
- ' আমি কাল আরো তিন লক্ষ আশি হাজার টাকার চেক নিয়ে যাচ্ছি তার সংগে ব্যাঙ্কের দেওয়া একটা লিস্ট নিয়ে আসছি ঐ সময়ে।' শুনে মিনু ম্যাডাম বললেন চেক না দিয়ে একাউন্ট পেয়ে ড্রাফট দিন তবে আমি ব্যাঙ্কে কি কি লাগবে সে সব কাগজ পত্র একটা ফাইলে করে আপনার কাছে দেব। তার মধ্যে আপনি যেটা রেখে দেবার সেটা রেখে বাকি কাগজপত্র নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দেবেন দেখবেন সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে যাবে। এই জন্যে ড্রাফট দিতে বলা। চেকের ক্ষেত্রে অজথা আপনার দেরী হবে কারণ তখন আমি কিন্তু আপনাকে যতক্ষন না চেক ক্লিয়রিং হবে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে বুঝেছেন?' কালকেই আমরা ড্রাফট জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পত্র নিয়ে আসবো। এবং পরের দিন আমরা সবাই মিলে ফ্ল্যাটের ফাইলটা নিয়ে ব্যাঙ্কে যাবো। কাজেই আমরা গড়িয়ার শান্তি এপার্টমেন্টে যাচ্ছি।
পরের দিন ত্রিহান ইমন ও আহিরকে নিয়ে গড়িয়ার শান্তি এপার্টমেন্টে গিয়ে হাজির হলো। রিসেপসনে গিয়ে হাজির হতেই রিসেপসনের ভদ্রলোক ওকে চিনতে পেরে ওই চেম্বারে বসতে বলে টেলিফোনটা কানে তুললো। একটু পরেই মিনু ম্যাডাম
এসে হাজির। হেসে বলেন, ' কি সব ভাল আছেন তো?' হেসে মাথা নাড়ালো সবাই।
- ' ঠিক আছে ড্রাফট এনেছেন তো?' ত্রিহান ড্রাফটা মিনু ম্যাডামকে দিতে তিনি সেই ড্রাফটটাতে ভাল করে দেখে নিয়ে বলেন,
'ঠিক আছে আপনারা একটু বসুন আমি এখনই আসছি।' তিনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন এবং মিনিট পনেরো পরে হাতে
একটা ফাইল নিয়ে ফিরে এসে বললেন,
' এই নিন আপনাদের দুজনের নামে ফাইল। ভালো করে দেখে নিন। ত্রিহান আর ইমন খুব ভালো করে দেখে নিল সব ও বললো,
- ' সব ঠিক আছে বলেইতো মনে হয়।' চেয়ার থেকে উঠে পড়লো ওরা।
- ' কোন চিন্তা করবেন না। আমরা জানি ওদের কি কি লাগবে। আগে থেকেই ফাইল রেডী করে রেখেছিলাম কালকে আপনার টেলিফোন পেয়ে। এখন ড্রাফটের মানি রিসিট্ দিয়ে আর একবার পুরোটা চেক করে নিয়েছি। আচ্ছা আপনারা কবে ব্যাঙ্কে
যাচ্ছেন?' ত্রিহান বললো, ' কালকেই যাবো ঠিক আছে।'
- ' আবার ঠিক আছে কেন। কালকেই যান। শুভ কাজে দেরী করতে নেই। যাই হোক ব্যাঙ্কে যদি ওখানে কোন অসুবিধে হয় তবে ফোনটা আমায় ধরিয়ে দেবেন। যা বলার আমি বলবো কেমন? দেখবেন আমাদের কোন ভুল নেই।'
- ' আচ্ছা এখনতো আপনারা ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে গেলন। আচ্ছা ঐ পুঁচকেটার নাম তো আহির না?' ওরা ' হ্যাঁ ' বলতেই মিনু ওর গাল টিপে বলে,' খুব সুন্দর নাম তোর।'
নমস্কার করে বাড়ী ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল।
( চলবে )
Dipak Kumar Paul,
DTC, Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkat - 700104.
Contact No. 9007139853.
No comments:
Post a Comment