গোয়েন্দা গোলাপচন্দ আর প্রেমের ভুল ঠিকানা
রাজদীপ মজুমদার
গ্রামের নাম 'দূরগাঁও'। সেখানে প্রেম হয় ঠিকই কিন্তু মজার ব্যাপার প্রেম গুলি প্রকাশিত হয় চায়ের কাপে চুমু দিয়ে, আহা! এটা সেই চুমু নয়। এটা হলো একা থাকার একা একা চায়ের কাপে চুমু। আর সেই গ্রামের গোয়েন্দাগিরি? সেটা হয় ফেসবুকের ইনবক্সে স্ক্রিনশট খোঁজার মাধ্যমে।
গল্পের শুরু আমাদের মহান গোয়েন্দা গোলাপচন্দ মিত্রকে নিয়ে, বয়স ত্রিশের কোটায়, এখনো অবিবাহিত। চশমা, একটা পুরোনো ডায়েরি, আর অতি মূল্যবান 'হামার বিশ্বাস' ব্যাজ তার কাছে আছে, কারণ সে মনে করে CID-এর ব্যাজ তার নেই তো কী হয়েছে! তার কাছে আছে 'হামার বিশ্বাস'। এটাই তার "সত্যের শপথ"। এই নিয়ে ছেলেটা নিজেকে ফেসবুকের গোয়েন্দা মনে করে। কারও প্রেমে কেউ প্রতারিত হলে সে-ই মধ্যরাতে স্ক্রিনশট ঘেঁটে দোষী খোঁজে।
গোলাপচন্দ হঠাৎ খবর পায় মিষ্টি নামে এক মেয়ের প্রেমিক তপন তাকে হঠাৎ করে ব্লক করে দিয়েছে। মিষ্টি নাকি কেঁদে কেঁদে ঘরের মধ্যেই পুকুর করে ফেলেছে। গোলাপচন্দ উপস্থিত হলো মিষ্টির কাছে, জিজ্ঞাসা করলো "কে ব্লক করলো, কেন ব্লক করলো"? শুরু হলো তদন্ত।
যেখানে গোয়েন্দা আছে সেখানে তো একজন সাগরেদ থাকবেই, মানে ওই গোয়েন্দার একজন সঙ্গী। তার নাম "প্যারাগু", ওর শখ শেয়াল নিয়ে গান লেখার। কিন্তু গোলাপ চন্দ্রের এই গোয়েন্দাগিরি তাকে আকৃষ্ট করে। তাই বিনা পয়সায় সে শিষ্য হয়ে যায় গোলাপ চন্দ্রের । দুজনে সাইকেল করে মিষ্টির বাসার থেকে বেরিয়ে প্রেমিক তপনের খোঁজ নিতে বের হয়। এখানে গোলাপ চন্দ্র তৈরি করেছে একটি উক্তি ---
"জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন— জীবনের থেকে বড় প্রেম কিছু নয়। কিন্তু প্রেম যদি ঠকায়— তাহলে তাকে গোয়েন্দা দিয়ে ধরতেই হয়।'"
শুরু হলো তদন্ত।
তপনের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলো গোয়েন্দা মশাই। কিন্তু একি! তপন কই! তপন হয়ে গেছে ধর্মগুরু! মোবাইল ছুঁড়েছে গঙ্গায়। মুখে শুধু ঈশ্বরের নাম। তপন ওদের দেখে বলে উঠলো, "আসো! আমি জানতাম তোরা আসবি আমার কাছে! তোদের জীবনের কষ্ট সব দূর করে দেবো।" এই দেখে তো গোলাপচন্দের চোখ হতবাক, সে প্রশ্ন করে "কেন তু্ই মিষ্টিকে ছেড়ে দিলি।"
অপর দিক থেকে উত্তর আসে,"পৃথিবীর মায়া ভুলে গেছি, আমি এখন ডেটিং অ্যাপ মুক্ত"— বলে হেসে উঠে।
গোলাপচন্দ রীতিমতো হতবাক। বলল, "তুমি কি প্রেমের প্রতারণা করে ধর্মগুরু হও? মানে এই ধর্ম এত সস্তা হয়ে গেল নাকি রে!"
তপনের মা এই সব প্রশ্ন উত্তর অনেকক্ষণ ধরে শুনছিলেন, এবার চুপ করে না থেকে তিনি বেশ রাগ করে বলে উঠলেন,"ও মিষ্টির মেসেজে বিরক্ত হয়ে দীক্ষা নিয়েছে।"
এখানেই তো আসে বিখ্যাত কবি রুমি'র সেই বিখ্যাত লাইন,
"Don't get lost in your pain,
Know that one day your pain will become your cure."
গোলাপচন্দ বুঝলো, প্রেমের সমস্যা শুধু ব্লক-আনব্লকের নয়, সেখানে আছে 'অসম বোঝাপড়া'।
মিষ্টির দিকটা ছিল একতরফা ভালোবাসা, তপনের দিকটা ছিল নিস্তার খোঁজার চেষ্টা।
তখন গোলাপচন্দ একটা কথা লেখে ডায়েরিতে—
"ভালোবাসা যদি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা প্রেম নয়, তবে তা অভ্যাস। অভ্যাসের নাম প্রেম দিলে সমাজে শুধু প্রতারক বাড়ে।"
গোলাপচন্দ তপনের সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নেয়— এই সমস্যার সমাধান ব্রেকআপ থেরাপি দিয়ে হবে না, দরকার প্রেম শিক্ষার পাঠ্যক্রম।
যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। গোয়েন্দা গোলাপচন্দ নিজের ফেসবুকে একটা লাইভ করে:
"আজ আমি বলছি— প্রেম শেখাও, প্রেম বোঝাও, শুধু প্রেম করো না। যে দেশে প্রেম শেখায় না, সে দেশে ব্রেকআপই সিলেবাস। আমি প্রস্তাব দিচ্ছি, প্রতিটি স্কুলে 'ভালোবাসা শিক্ষা' নামক একটা ক্লাস থাকা উচিত।" পেছন থেকে প্যারাগু বলে উঠল, "প্রতিদিন হোমওয়ার্ক থাকবে মানে আজ তুমি কাকে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসলে' লিখে আনো।"
এই সবের মাঝে গোলাপচন্দ বোঝে, সে এই গোয়েন্দাগিরি আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে তার নিজের শূন্যতাকে। সে কাঁদতে কাঁদতে ডায়েরিতে লেখে— "আমি সব প্রেমের গোয়েন্দা হতে পারি,
কিন্তু নিজের জন্য কাউকে ভালোবাসতে সাহস পাই না। কবি জীবনানন্দ দাশও তো বলেছিলেন—
'আমরা কেবলই ঘুমিয়ে পড়ি— ভালোবাসার আগে।'"
ঠিক তখনই দরজার নিচে একটি চিঠি কেউ যেন বাইরের থেকে দরজার ফাঁকে দিয়ে গেল। গোলাপচন্দ্র দৌড়ে এসে দরজা খুলে কাউকেই দেখতে পায় না। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে, চিঠিতে লেখা:
"তুমি তো সবার প্রেমে তদন্ত করো, নিজের প্রেমটা খুঁজবে কবে? একজন মেয়ে প্রত্যেক দিন চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যায় তোমায় দেখতে দেখতে, যে প্রতিদিন তোমার চোখের সামনে থাকে কিন্তু তুমি তাকে দেখ না। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক কাপ লাল চা খাও। কিন্তু তুমি জানো না সে মেয়ের মনে ওই চা ঠান্ডা হলেও, তোমার কথা ভেবে তার বুকটা গরম হয়ে যায়।"
গোলাপচন্দ থমকে যায়, তারপর চিঠির ভাঁজে একটা গোলাপের পাপড়ি খুঁজে পায়...আর তার নিচে লেখা ছোট্ট লাইনটা— "চায়ের দাম এখনও বাকি, তিনশো টাকা। প্রেমটা ছাড়, দেনাটা মেটা।"
গোলাপচন্দ চমকে ওঠে, তারপর হেসে গড়িয়ে পড়ে—বলতে থাকে, "হৃদয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত নয় রে ভাই...আমি তো দেখি দেনা-পাওনার মামলা হয়ে গেল!"
এরপর বলে—
"এইবার কেস নাম্বার ৮: 'প্রেম নাকি পাওনা?'"
শেষ কথা
এই গোয়েন্দাগিরির মধ্যে রাজনীতি নেই, কিন্তু আছে এক ফাঁকা সমাজের প্রতিচ্ছবি—
যেখানে আমরা প্রেম ভুলে প্রযুক্তির স্ক্রিনে ভালোবাসা খুঁজি, আর শেষমেশ ব্লক লিস্টেই ঠাঁই দিই সেই মানুষটাকে যে একদিন চোখে চোখ রেখে বলেছিল, "তুমি হাসলে আমার দিন ভালো যায়।"
গোলাপচন্দের গল্প এখানেই শেষ নয়—সে এখন প্রতিটি ব্রেকআপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা বার্তা দে—
"তোমার প্রাক্তন শত্রু না, সে তোমার অতীত।
তাকে স্মরণ না করো, সম্মান দাও।
কারণ মানুষ ভুল করে, আর প্রেম...
প্রেম কোনোদিন ভুল হয় না।"
* * * * * * * * * *
রাজদীপ মজুমদার
১/২৯এ, প্রিন্স গোলাম মোহাম্মদ রোড, কলিকাতা -২৬
No comments:
Post a Comment