অণুগল্প ।। হরিবোল বুড়ো ।। সুমিত মোদক - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Sunday, July 20, 2025

অণুগল্প ।। হরিবোল বুড়ো ।। সুমিত মোদক

হরিবোল বুড়ো

সুমিত মোদক 


বলো হরি, হরি বোল… বলো হরি, হরি বোল…

হরির ধ্বনি দিতে দিতে এক মৃত দেহ কে নিয়ে এক দল মানুষ গ্রামের মেঠো পথ ধরে নদীর ধারে শ্মশানের দিকে এগিয়ে চলেছে । বাঁশের খাটিয়াতে সাদা কাপড়ে উপর সাদা ফুলে ফুলে ভরে আছে । তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মুখটি । গ্রামের অতি পরিচিত সেই মুখ । হরিবোল বুড়োর ।

মৃত্যুর কয়েক বছর আগে পর্যন্ত পথে  ঘাটে ছেলে-ছোকরা গুলি মানুষটিকে দেখা পেলেই একটু দূর থেকে বলতো — বলো হরি , হরি বোল…
সঙ্গে সঙ্গে মানুষটি রেগে গিয়ে বলতো — তোর বাপ কে গিয়ে বল না । তোর ঠাকুদাকে বল , তোর চোদ্দ গুষ্টি কে বল …
কয়েক পা হেঁটে গেলে ছেলেরা আবার শুরু করতো — বলো হরি , হরি বোল …

মানুষটির প্রকৃত নাম ব্রজ গোপাল দাস । এই নামে তাকে কেউ চেনে না । আশেপাশের দশটা গ্রামের মানুষ চেনে হরিবোল বুড়ো নামে । প্রতিবেশী এক বৌমা এক দিন সাহস করে বলে — জেঠু ,বাচ্চাদের কথায় আপনি ওভাবে রেগেযান কেন ! আপনি রেগেযান বলেই ওরা বলে । আপনার বয়স হয়েছে । এ বয়সে এতো রাগারাগি করলে শরীর খারাপ করবে ।
— বুঝলে মা , আমি চাই ওরা বলুক । হরির নাম বলুক । চারি দিকে হরির নাম ধ্বনিত হোক । সেটাতেই আমার শান্তি , আমার মুক্তি , আমাদের মুক্তি  । সে কারণে তো রাগ দেখাই । রাগ না দেখলে ওরা বলবে বা কেনও !
সে দিন ওখানে যেকজন বউ-ঝি ছিল সকলে আর কোনও কথা বলতে পারে নি । কেবল বোঝার চেষ্টা কর ছিল মানুষটিকে ।

মানুষটিকে আগে কেউ কোনও দিন সে ভাবে গুরুত্ব দেয়নি । এলাকার সকলে কিপটে বুড়ো ভাবতো । বিয়ে করেনি । অনেক জায়গা জমি । টাকা পয়সা , বাগান , ঘর-বাড়ি সব আছে ।  সে ভাবে কোন দিন বাজার হাট করতে দেখনি । একই জমা কাপড়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু সেই মানুষটি শেষ সময়ে এসে নিজের সব কিছু দান করে দিল পাকা রাস্তার ধারে নিজের জমিতে একটি গুরুকুল গড়ে তোলার জন্য । যেখানে প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রীয় শিক্ষা , প্রাচীন ভারতের ইতিহাস , ঐতিহ্য , সংস্কৃতি , পরম্পরার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষা সমান ভাবে প্রদান করা হবে । 

প্রতিবেশী এক বৌমা খেয়াল করল সকাল থেকে হরিবোল বুড়ো বাইরে বার হয়নি । তাই ডাক দিল — ও জেঠু , ও জেঠু …
কোনও সাড়া নেই । সন্ধেহ হল । খোলা জানালা দিয়ে দেখে । বিছালায় শুয়ে । কোনও সাড়া নেই । তার চিৎকার চেঁচামেচিতে আশেপাশের অনেকেই ছুটে এলো । দরজা ভাঙা হলো । দেখা গেলো মারা গেছেন । বুকের উপর খোলা শ্রীমদ্ভাগবত গীতা। উল্টে দেখা গেল দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাইশ নম্বর শ্লোক — বাসাসিং জির্ণানি যথা বিহায় …
মানে , আত্মার মৃত্যু নেই রূপান্তর ঘটে ।

হরিবোল বুড়োর মৃত দেহ কে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘোরালো গ্রামের ও আশেপাশের গ্রামের ছেলে-ছোকরা ও শুভ বুদ্ধি মানুষ সকল । নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে গড়ে উঠছে তাঁর স্বপ্নের গুরুকুল । তার পর শ্মশানের পথে  । সকলে এক সঙ্গে দিতে থাকলো হরির ধ্বনি — বলো হরি , হরি বোল … বলো হরি , হরি বোল …




No comments:

Post a Comment