নতুন পাঠ
অমিতাভ ভট্টাচার্য
টিফিনের সময় খাবার খেতে খেতে সমীরণ সঞ্জয়কে বলল, তুই স্যারকে সত্যি কথাটা না বললেই পারতিস। সঞ্জয় অবাক হয়ে সমীরণের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ব্যাগ থেকে নিজের টিফিন বাক্স বের করতে করতে বলল, স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করল বলেই তো আমি বললাম।
সমীরণ একটু ভীতু প্রকৃতির ছেলে। সঞ্জয়কে গলার আওয়াজ নীচু করে বলল, রঞ্জনকে ভয় পাচ্ছি। একে ডাকাবুকো ছেলে, তার ওপরে আবার গুণ্ডা প্রকৃতির। স্যারের কাছে মার খেয়ে তোর দিকে কেমন করে তাকাতে তাকাতে গেল।
তাতে কী হল?
যদি তোকে মারে?
আমাকে মারবে কেন? আমি কী করেছি?
কী করেছি মানে? তোর জন্য স্যারের কাছে অতো মার খেয়ে ও কি স্কুল ছুটির পর সোজা বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে ভেবেছিস? স্যারকে 'আমি দেখিনি স্যার' বললে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়ে যেতো?
আমি তো দেখেছি রঞ্জনকে লিখতে। তাহলে মিথ্যে কথা বলব কেন?
গোপালবাবু ওদের ক্লাস টিচার। আজ ক্লাসে আসতে দেরি করছেন। স্যার যতক্ষণ ক্লাসে না আসেন ততক্ষণ ছাত্ররা মনের আনন্দে খাতার পাতা ছিঁড়ে সেগুলোকে দলা পাকিয়ে এর ওর দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করে। ওরাও তাই করছিল। তার ওপরে চেঁচামিচি তো আছেই। গোপাল বাবু ক্লাসে ঢুকলে ক্লাসের কয়েকজনের শরীর খারাপ লাগে, পেট ব্যথা করে, জ্বর আসে। গোপাল বাবু আসছেন না দেখে রঞ্জন একটা চকের টুকরো দিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, "আজ আমি তোমাদের পড়াবো না। ছুটি দিলাম"। গোপাল বাবু আগের দিন পড়া দিয়ে গেছিলেন। রঞ্জন পড়া তৈরি করে আসেনি। ইস্কুলে ঢোকার পর যে ব্যথাটা তলপেট থেকে পাক খেতে খেতে গলার কাছে এসে মাঝে মাঝে ধাক্কা দিচ্ছিল, ব্ল্যাক বোর্ডে 'আজ আমি তোমাদের পড়াবো না,ছুটি দিলাম' শব্দগুলো লিখে রঞ্জনের সেই ব্যথাটা কিছুটা কমল। বোর্ডে লেখাটা দেখে ক্লাসে একটা গুঞ্জন উঠল। মুহূর্তের মধ্যে গুঞ্জন হট্টগোলে পরিণত হল। পাশের ক্লাসে তখন তারাপদ বাবু পড়াচ্ছিলেন। এতো চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে তিনি হেডমাস্টার মশাইকে গিয়ে জানালেন যে, গোপাল বাবু ক্লাসে না থাকার জন্যে ছেলেরা হই হট্টগোল করছে। এর ফলে পাশের ক্লাসে পড়ানো যাচ্ছেনা।
গোপাল বাবু তখন ইস্কুলে ঢুকলেন। এগারোটার পর সই করার খাতাটা হেডমাস্টার মশাইয়ের টেবিলের ওপরে চলে আসে, গোপালবাবু তা জানেন।তিনি সোজা হেডমাস্টার মশাইয়ের টেবিলের ওপরে রাখা সই করার খাতাটা খুলে দেখলেন লাল কালির দাগ পড়েনি। সই করলেন। বেরনোর সময় হেডমাস্টার মশাই গোপাল বাবুকে বললেন, ছুটির পর তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবেন না। আপনার সাথে জরুরী কথা আছে।
ক্লাসে ঢুকতে একটু দেরিই হয়েছে গোপাল বাবুর। ঢুকেই ব্ল্যাক বোর্ডে চক দিয়ে লেখাটা দেখতে পেলেন। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলেন, কে লিখেছে?
ক্লাস মনিটর বিকাশ বলল সে দেখেনি কে লিখেছে। ফার্স্ট বেঞ্চে স্যারের একেবারে সামনেই বসে সঞ্জয়। স্যার সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করলেন।সঞ্জয় মিথ্যে কথা বড় একটা বলেনা। শুধু গোপাল বাবু নয়,ইস্কুলের অন্য মাস্টার মশাইরাও তা জানে। সঞ্জয় বলে দিল রঞ্জনের নাম।
এমনিতেই গোপাল বাবুর মেজাজ ঠিক ছিলনা। গিন্নীর সাথে সাংসারিক কোন ব্যাপারে মতান্তর এবং বচসার ফলে ইস্কুলে আসতে দেরি হয়েছে। আজ হেডমাস্টার মশাই রেগে আছেন বলে মনে হল। সর্বোপরি ক্লাসে ঢুকে বোর্ডে লেখাটা দেখে গোপাল বাবুর রাগ তুঙ্গে গিয়ে ঠেকল। সেই রাগ নামানোর দায় এখন রঞ্জনের। রঞ্জনকে ভাল করে উত্তম মধ্যম দেবার পর গোপাল বাবুর রাগ কিছুটা কমল।
সারাদিন রঞ্জন ক্লাসে চুপ করে ছিল। কারোর সাথে বিশেষ কোন কথা বলেনি। সমীরণ খানিকটা নিশ্চিন্ত হল সেটা লক্ষ্য করে। সঞ্জয়কে রঞ্জনের ব্যাপার নিয়ে ও আর কিছু বলেনি। ইস্কুল ছুটি হলে যে যার বাড়ির রাস্তা ধরল।
বাড়ির পথে যেতে যেতে সঞ্জয় হঠাৎ অনুভব করল ওর মুখে শক্ত কিছু একটা এসে ধাক্কা মারল। চোখের সামনে দেখতে পেল ফুলঝুরির কতগুলো ফুলকি। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে একটা নোনতা স্বাদ ওর জিভে। কী ঘটছে বুঝে ওঠার আগেই কেউ ওর জামার কলার ধরে ঝাঁকানি দিল। ভাল করে চোখ মেলে দেখল, রঞ্জন ওর কলার ধরে আছে। রঞ্জন আবার ওর কলার ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়েছিস নাকি?
রতন সবসময় রঞ্জনের পাশে থাকে। সঞ্জয়ের ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। রতন দেখতে পেয়ে রঞ্জনকে কিছু একটা বলতেই রঞ্জন ওর কলার ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বকা খেল সঞ্জয় ইস্কুলে মারপিট করার জন্যে। বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবাকে জানাল, তোমার ছেলে ইস্কুলে গিয়ে মারামারি করে মুখ ফাটিয়ে এসেছে। ইস্কুলে কি কি ঘটেছে, সঞ্জয় বাবাকে সব খুলে বলল। বাবা সঞ্জয়কে বলল, সব ব্যাপারে সত্যি কথা বলতে নেই। তাহলে সারাজীবন এই রকম পড়ে পড়ে মার খেতে হবে। সঞ্জয় আয়নার সামনে গিয়ে কাটা ঠোঁটটা দেখতে দেখতে বলল, বাবা তুমি যে ছোটবেলায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় ভাগে পড়িয়েছিলে "সদা সত্য কথা বলিবে"; সেটা কি তবে ভুল? ঠাকুমা বলল, তুই কেমন বাপ রে; কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয় তা না শিখিয়ে, ছেলেকে মিথ্যে কথা বলতে শেখাচ্ছিস?
==================
অমিতাভ ভট্টাচার্য
ডিবি ২২, রেল পুকুর রোড
দেশ বন্ধু নগর, বাগুইয়াটি সাহা পাড়া
কলকাতা ৭০০০৫৯
No comments:
Post a Comment