পাঠক পেয়ে যান এক অনির্বচনীয় স্বাদ
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
নদীয়া বইমেলা-২০২৪ এর মঞ্চে (ডিসেম্বর ২০২৪) প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখক ও সাহিত্যিক কবি জয়দেব বিশ্বাসের নির্বাচিত কবিতা সংগ্রহ রেণু জ্যোতি। উৎকৃষ্ট ম্যাপলিথো কাগজ, ঝকঝকে বাঁধাই এবং দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের আট-ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থটি (নির্বাচিত কবিতা সংকলন) হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যায়; তারপর পাঠ থেকে পাঠান্তরে যেতে যেতে পাঠক পেয়ে যান এক অনির্বচনীয় স্বাদ। বস্তুতপক্ষে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখক কবি জয়দেব বিশ্বাসের কলম কিছুটা ভিন্নধর্মী — প্রথাগত গতানুগতিকতার বাইরে তিনি যে সমস্ত কবিতাগুলি রচনা করেন তার বেশিরভাগই বিজ্ঞান আশ্রিত এবং বিজ্ঞান আধারিত। (লেখকের পূর্ববর্তী বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রন্থ: বিপন্ন পৃথিবী, খোলা আকাশ, প্রকৃতির কান্না, বিশুদ্ধ বাতাস, আলোর ঠিকানা, পথের নিশানা ইত্যাদি)। তিনি যেমন রাম রহিমের বাংলা, শ্রাবণ সন্ধ্যা, জীবনে মরণে, রূপসী চাঁদ, ব্যালকনিতে প্রেম, শুভ বিজয়া, ভ্যালেন্টাইন ডে, ট্রাজেডি ও কমেডি, সোনা ঝরা দিনগুলি, উড়ন্ত মন ইত্যাদি কবিতা রচনা করেন, তেমনিই তিনি বিজ্ঞান-আধারিত বিভিন্ন কবিতায় অত্যন্ত দক্ষ এবং সাবলীল। বিশেষতঃ জীবন বিজ্ঞানের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক মহাশয় হিসেবে তিনি সারা জীবনে বহু ছাত্রকে পড়িয়েছেন, তাদের মন-মানসিকতা বোঝবার চেষ্টা করেছেন এবং রচনা করেছেন অসংখ্য বিজ্ঞানভিত্তিক কবিতা ও গদ্য যা শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয়, আপামর জনসাধারণের কাছেও শিক্ষার তথা শিক্ষা গ্রহণের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে – সরীসৃপের শীতঘুমকে নিয়ে লেখা তাঁর 'শীতঘুম' কবিতাটি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জীবজগতের জন্মরহস্যকে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর 'আসল জন্মদিন' কবিতাটি যেমন প্রাঞ্জল, তেমনিই সাবলীল ও শিক্ষামূলক। কবিতাটি বহু পঠিত, বহুশ্রুত এবং বহুজনের প্রশংসাধন্য এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিককালের রক্তদান এবং মরণোত্তর দেহদান নিয়েও তিনি কলম ধরেছেন এবং রচনা করেছেন অনবদ্য কবিতা রক্তদান ও মরণোত্তর দেহদান। তাঁর রচিত জন্ম-মৃত্যুর খেলা, জীবনচক্র, জীবনের স্বাদ, ক্রোমোজোম, মহান মানব জীবন, বায়োলজিক্যাল ক্লক, ভেজাল, নীরব ঘাতক, কীটপতঙ্গ ও মানুষ ইত্যাদি বিজ্ঞান-আধারিত কবিতাগুলি যেমন শিক্ষামূলক তেমনিই তা ফিরে পড়বার মতো সুন্দর। প্রসঙ্গত তাঁর রচিত একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা –
"স্বাস্থ্য আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ,
চাই সুস্বাস্থ্য, নইলে আসবে সমূহ বিপদ।
চাই বিশুদ্ধ খাদ্য, জল, বায়ু,
তাহলে বাড়বে আমাদের আয়ু।
আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ জল পান,
করবে সবার সুস্থ জীবন দান।
সব বাড়িতেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার,
সবাইকে করতে হবে ব্যবহার।
সাবান করতে হবে ব্যবহার,
ভালো করে ধুতে হবে হাত,
তাহলে অনেক রোগ হবে কুপোকাত।
চাই সুশিক্ষা, ব্যায়াম, সুষম খাদ্য,
তাহলে আমরা পাবো রোগহীন সুস্বাস্থ্য।
এসো সবাই হাতে হাত ধরি,
দূষণমুক্ত নির্মল সবুজ পৃথিবী গড়ি।" (সুস্বাস্থ্য)
আবার বিশ্বব্যাপী অস্বাভাবিক পরিবেশ দূষণ এবং ইকোসিস্টেম নষ্ট করবার মতো অপরিণামদর্শী ঘটনার দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে তিনি তাঁর বলিষ্ঠ কলমে উপহার দিয়েছেন প্রকৃতির রোষে, সবুজ পৃথিবী, প্রিয়তম বন্ধু গাছ, রঙিন পৃথিবী, প্রকৃতির হুংকার, পরিবেশ, মৃত্যুপুরী পৃথিবী, পরিবেশ বাঁচাও, পরিবেশ ও প্রকৃতি ইত্যাদি কবিতা। তবে শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাই নয়, মানব সমাজে ধর্মান্ধতা, পণপ্রথা, নারী নির্যাতন, সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, শ্রেণী বৈষম্য, অত্যাচার, অবিচার, নৈতিক ও মানবিক অবক্ষয়, বৃদ্ধাশ্রমের বাড়বাড়ান্ত, বিশ্ব মানবতার অপমান, নারী জাতির প্রতি বৈষম্য, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা — ইত্যাদির মতো সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এবং রচনা করেছেন অজস্র কবিতা যা তাঁর এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু, কি অপরাধ, মানবতা ও দানবতা, শিশুশ্রম, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা, ক্ষতিকারক নেশা, পুরুষ ও নারী সমান, বৃদ্ধাশ্রম, বন্ধ হোক, নেশা, ভাঙাগড়া, মৈত্রীর বন্ধন ইত্যাদি কবিতা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর বাইরেও তাঁর কবিমন অত্যন্ত সংবেদী, নারীজাতির প্রতি ভীষণভাবে শ্রদ্ধাশীল এবং মানুষের স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসার মতো সুকুমার বৃত্তির প্রতি ভীষণভাবেই আস্থাশীল। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি রচনা করেছেন বেশ কিছু সার্থক কবিতা যা এই কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়ে কাব্যগ্রন্থটিকে ঋদ্ধ করেছে। তার মধ্যে – আমি নারী সব পারি, ভালোবাসার সাগরে, তোমার জন্য, কন্যারত্ন, তুমি আমার ভালোবাসা, মা, জীবনের জয়গান, ভালোবাসা, পুরুষ ও নারী সমান, রমণী রতন, তুমি মা, মাতৃঋণ, অপরূপা, আমি ও তুমি, চির বসন্তে, শতরূপে, ভালোবাসা বাঁচানোর জন্য, সান্নিধ্য, শ্রাবণ সন্ধ্যা, বন্ধু প্রমুখ কবিতা ফিরে পড়বার মতো সুন্দর এবং নিবিড় অর্থবাহী।
এর পাশাপাশি কবি জয়দেব বিশ্বাস মহাপুরুষদের প্রতিও সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল – প্রিয় নজরুল, রবি ঠাকুর, রবি ও নজরুল, শব্দশিল্পী, সকলের রবি প্রভৃতি কবিতা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া কবি জয়দেব বিশ্বাস একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন যা শাশ্বত, চিরকালীন এবং অবশ্য পালনীয় তথা অনুশীলনের যোগ্য –
"তোমরা হলে ফুটন্ত ফুল, তোমরাই সূর্যের আলো,
দিকে দিকে জ্ঞানের প্রদীপ তোমরাই তো জ্বালো।
তোমাদের দেখে শুনে যেন সকলেই শেখে,
জ্ঞানের আলো ছড়ায় যেন তোমাদেরই চোখে।
লেখা-পড়ার সাথে শেখো সব সুন্দর করতে,
দূষণমুক্ত এক নির্মল পরিবেশ গড়তে।
নোংরা, জঞ্জাল ফেলো নাকো এখানে ওখানে,
ময়লা, আবর্জনা সব ফেলো ডাস্টবিনে।
সর্বদা পরিবেশকে তোমরা সুন্দর রাখবে,
নোংরায় কেন পথ ঘাট ঢাকবে?
দূষণমুক্ত করো চারদিকের পরিবেশ,
সকলে মিলে গড়ে তোলো সুন্দর সমাজ ও দেশ।"
(ছাত্রছাত্রী)
এছাড়া রেণু জ্যোতি গ্রন্থটিতে রয়েছে মৃত্যুচেতনা নামক একটি অনবদ্য রচনা যা প্রকৃত অর্থেই অনবদ্য এবং অবশ্যপাঠ্য। রয়েছে বেশ কিছু ইংরেজি কবিতা। তবু কিছু অসঙ্গতি বইটিতে নজরে পড়ে — যেমন তাঁর অন্যতম সুন্দর একটি কবিতা মানবজাতি দু'বার (১৩ পৃষ্ঠা এবং ১৮ পৃষ্ঠায়) ছাপা হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে নজরে পড়েছে বেশ কিছু বানানের অসঙ্গতি। এটুকু বাদ দিলে রেণু জ্যোতি প্রকৃত অর্থেই একটি চমৎকার সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থ হিসাবে গণ্য হবার যোগ্য দাবিদার।
___________________________
কাব্যগ্রন্থ: রেণু জ্যোতি (নির্বাচিত কবিতা)
কবি: জয়দেব বিশ্বাস
মুদ্রক: ইলা আর্ট প্রেস
প্রচ্ছদ: জয়িতা বিশ্বাস
প্রকাশকাল: নদীয়া বইমেলা, ২০২৪
মূল্য - ২০০ টাকা
No comments:
Post a Comment