বসন্তে পলাশের দুয়ারে
কুহেলী বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকৃতি যখন তার দখিন দুয়ার খুলে দেয় বইতে শুরু করে ফাগুন হাওয়া,পাতা ঝরা শুষ্ক শীতের শেষে ঠিক তখনই আসে রঙিন বসন্ত। চারদিকে নতুন কচিপাতা আর ফুলের সমাহার। যেদিকে চোখ যায়,যেন রঙের রায়ট।অলস দুপুরে একটানা বসন্তের মহাজনের মন উদাস করা কুহু কুহু ডাক আর বাতাসে ঝিম ধরা বাতাবি ফুলের মিষ্টি নরম গন্ধ। বসন্ত মানেই পলাশ। আর পলাশের পরিপাটি সংসার হলো পুরুলিয়ায়। তবে পুরুলিয়া বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট টিলা আর পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা লালমাটির রূপকথা। আমবাঙালির কাছে পুরুলিয়া মানেই গরম, দারিদ্র,মাওবাদী, বনজঙ্গল,আদিবাসী আর অনুন্নত জীবনযাত্রা। কিন্তু আমার কাছে পুরুলিয়া মানে সহজ-সরল মানুষজন আর গভীর এক নৈঃশব্দ্য। ঠিক কোন বহ্নির আকর্ষণে মানুষ এই সময় এমন পতঙ্গের মতো ছুটে যায় মূলত তা চাক্ষুষ করতেই এবারের পুরুলিয়া গমন। গড়পড়তা পুরুলিয়া নয়,এক অন্য পুরুলিয়ার খোঁজে বেড়িয়ে পড়া। যেখানে গড়ে উঠেছে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
দিনের প্রথমভাগেই আমরা রানিগঞ্জ - মেজিয়া হয়ে সাঁতুরি পৌঁছোয়। সেখান থেকে ডানদিকে ঘুরে বড়ন্তি। বড়ন্তি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে বড়ন্তি গ্রাম।গ্রামের পাশেই মুরাডি লেক।লেকের জল স্বচ্ছ নীল। আশেপাশে বেশকিছু সরকারী ও বেসরকারী রিসর্ট রয়েছে।এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা গড়পঞ্চকোটের রাস্তা ধরি। পাহাড়ের গা ধরে পিচ রাস্তা। ডানদিকে ধানক্ষেত। শীতের ফসল তোলা সারা তাই ধূ ধূ করছে মাঠ। আদিবাসীদের ঘরসংসার ছুঁয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। একসময় মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছোলাম। দামোদর শেখর ছিলেন পঞ্চকোটের প্রথম রাজা। ঝালদা অঞ্চলের পাঁচজন আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে তিনি এখানে রাজত্ব গড়ে তোলেন। আর সেই থেকে নাম হয় গড়পঞ্চকোট। ছোট বড়ো মিলে প্রায় চল্লিশটি মন্দির তিনি নির্মাণ করেন। তার দু-একটির ভগ্মাবশেষ বর্তমানে দেখা যায়। বাংলায় বর্গিদের আক্রমণে এঁদের রাজত্ব ধ্বংস হয়ে যায়।
দু বছর আগে নভেম্বরে একবার পুরুলিয়া এসেছিলাম। সেসময় বিখ্যাত ছৌ মুখোশের গ্রাম চরিদা আর জয়চন্ডী পাহাড় ঘুরে যায়। তবে এই জয়চন্ডী পাহাড়ের সাথে অবশ্য প্রথম পরিচয় ঘটেছিল সত্যজিৎ রায়ের "হীরক রাজার দেশে" সিনেমার দৌলতে। বড়ন্তি, পঞ্চকোটের দিকটায় এবার কিংশুকের দৌরাত্ম্য কিছুটা কম । কিন্তু যে পলাশের টানে এখানে আসা তা না দেখতে পেয়ে মনটা ভারী হতাশ হয়ে পড়ে।আর তাই পলাশের টানেই ছুটে যাওয়া পুরুলিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। বান্দা। পলাশ দেখার জন্য একটি অসাধারণ জায়গা। রঘুনাথপুর থেকে চেলিয়ামা যাওয়ার রাস্তায় পড়বে ছোট্ট এই গ্রামটি। দূরত্ব পনেরো কিলোমিটার মতো।গ্রামে ঢোকার আগে রয়েছে পলাশের জঙ্গল। দেখে যেন মনে হয় পলাশের মশাল হাতে রেড আর্মি নেমেছে।
এই এলাকায় সবুজের ছোঁয়া বড়ই কম। রুক্ষ মাটিতে সোনা রঙের ধুলো। দুটি ছোট ছেলে পলাশ বনে আপনমনে খেলায় মত্ত।
টিউবওয়েলে জল নিতে ব্যস্ত এক রমণী আমাদের পথ চিনিয়ে দিল। গ্রাম পেরোতেই নজরে এল নির্জন এক প্রান্তর। কয়েক হাজার পলাশ আর তার মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে একটি দেউল। চারদিকে অদ্ভূত এক নিস্তব্ধতা,শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দে যেন ঘোর ভাঙে। দূরে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তিন-চারটি অল্পবয়সী মেয়ে। কাচা কাপড়ের বোঝা নিয়ে ঘর ফিরছিল। কাছে যেতেই অনাবিল হাসি হেসে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। মার্চের দুপুরে ঘুঘুর কুহরে যেন বিষাদের বিজ্ঞাপন। কোথাও একটা কাঠঠোকরা নিজস্ব ছন্দে ঠুকরে যাচ্ছে - ঠক্ ঠক্ ঠক্।নিস্তব্ধ নির্জন পলাশপুরীর ইতিউতি নানা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে।আর ওদের ওড়ার সাথে সাথে টুপটাপ করে কিছু পলাশ ঝরে পড়ছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে থাকা এই দেউল বা মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতকে জৈনদের দ্বারা এটি নির্মিত। দেউলের পাশেই বনের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। রাঙা আবহে সেই মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মন গুনগুনিয়ে উঠছিল - 'রঙ লাগালে কে বনে বনে/ঢেউ জাগালে সমীরনে।'
অলৌকিক জগতের মায়া কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম শিল্পগ্রাম এর উদ্দেশ্যে। কালো পিচ রাস্তার দুধারের মালভূমির গা তামাটে। এই তামাটে মাটি রোদে রুষ্ট হলে তা বড়ই ক্লেশকর। পথের ধারের ছোট ছোট গঞ্জ, পুরোনো মন্দিরে জমে থাকা ধূপের ধোঁয়া,রুক্ষ মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের সারি বা শাল-মহুয়া-পলাশের জঙ্গল সবের সাথে সবের কোথাও যেন একটা আত্মীয়তার সুর বাঁধা আছে - কতকাল ধরে।আর এই প্রকৃতির সাথে এখানকার মানুষ,তাদের জীবনযাত্রা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।রুখুসুখু,হতদরিদ্র এই জেলা তার সকল অবহেলাকে নীরবে সহ্য করেও ফল্গুধারার মতো বুকের ভেতর বইয়ে দিয়েছে তার শিল্পসত্তাকে।
এমনই এক শিল্পবহনকারী গ্রাম হাতিমারা। যেখানে সাঁওতালদের বসবাস। গ্রাম জুড়ে মাটির দেওয়ালে আলপনা।বদনা পরবের সময় ঘরদোরকে পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলাটাই এদের রীতি।
খড় পুড়িয়ে,গিরিমাটি গোবর,পাতার সবুজ রঙ বের করে এবং নানা রঙের সেরামিক যুক্ত মাটি থেকে ঘরকে রাঙিয়ে তোলে। ফুল,লতা-পাতা,ময়ূর,নানা নকশা এঁকে তাদের সংস্কৃতিকে ঘরের দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলে।
আদিবাসীদের প্রাচীন ছবি আঁকার যে ধারা তা যেন আজও বয়ে নিয়ে চলেছে এই গ্রাম।তাদের আপাত সাধারণ ছবিগুলির মধ্যেই রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের নানা রহস্য।
এরপর আমরা অযোধ্যার পথে যখন রওনা দিলাম সূর্য তখন দিন-আহ্নিক শেষ করে পশ্চিম প্রান্তে ঢলে পড়েছে। প্রাকৃতিক পসরায় সাজানো অযোধ্যা যেন বসন্তের বিগ বাজার। দুধারের স্তব্ধ বনে গাছেদের মজলিশ বসেছে -শাল,আসন,কুসুম,মহুয়া, পলাশ,অর্জুন। দূর থেকে বসন্তের পোষ্টম্যান তার বার্তা পাঠায় --- কু -উ-উ। মাঝি পাড়াগুলো এক এক করে পিছলে যেতে থাকে। তাদের টালির ছাউনি, ধান ছড়া আঁকা মাটির দেওয়াল, কাঠের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা রমণীর মুখ, নিকোনো উঠোনে উদোম গায়ে শিশু --- যেন ছোট ছোট জীবনের চালচিত্র। পাহাড়ের ঠিক কোলেই বেড়িরিয়া বলে ছোট্ট গ্রাম। ঠিক যেন প্রকৃতি,বুনো গন্ধ ও একরাশ প্রশান্তির মেলবন্ধন। বড়োই নিরিবিলি। রাত্রিযাপন করবো এখানেই। ছোট্ট রিসর্টের ধারেই পলাশ গাছ আর তার গা লাগোয়া মাটির ঘর। কিন্তু জনমানবহীন। পরদিন সকাল হতেই চারপাশটা ঘুরতে গিয়ে নজরে এল একটি চা- তেলেভাজার দোকান। সেখানে মাচায় বসে গুটিকয় লোক গল্প জুড়েছে। পাশেই পলাশের বনে মুরগির সাথেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বনময়ূর। দোকানের মালিক অনাথ চন্দ্রর সঙ্গে টুকটাক গল্প চলছিল। তাতেই জানলাম পাহাড় থেকে নেমে আসে ময়ূরগুলি। খাবারের খোঁজে।ইচ্ছে হলেই আবার জঙ্গলের পথে অদৃশ্য হয়।
মন কেমনের গন্ধ মেখে আমাদের গাড়ি বেড়িরিয়া ছাড়িয়ে বাড়ির পথে। অযোধ্যার গড়ান ধরে গাড়ি নামতে থাকে। বাতাসে হিমের পাক। দুধারে জঙ্গলের ঢেউ নিয়ে এগিয়ে চলেছি। পথের বাঁকে বাঁকে বসন্তের বিস্ময়। কুব কুব করে ডেকে চলেছে কুবো পাখি। বনমহলের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে পাহাড়ের কোন প্রান্ত থেকে ভেসে এল কেকাধ্বনি। জঙ্গল ফুঁড়ে চকিতে বেড়িয়ে এল এক তেলকাজলা মেয়ে। মাথায় জঙ্গলের কাঠ,কোঁচরে বুনোফল। তার দেহের গড়নের সাথে নামটিও বড়োই মানানসই। কাজুলী। ডুরে শাড়িতে তার রঙের বাহার। মুখে অনাবিল এক প্রশান্তির ছায়া।কোথায় থাকে জানতে চাইলে বলে - উই হোথা। যেদিন কোনো কাজ জোটে না সেদিন বনে হানা দেয়। সেখানে ফল-মূল-কন্দ-আলু থেকে ইঁদুর,বাদুড়,গোসাপ -- ভেজ - ননভেজ দুইই মেলে।সেদিনটা তাই দিয়েই চলে যায়। আমরা শুনি আর হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ভাবি এখানে সবকিছু কতো উন্মুক্ত,কোথাও কোনো আড়াল নেই। জীবন যেন এখানে তার সব ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে ধরা দিয়েছে এক সীমাহীন সারল্যে। পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে এক অদ্ভূত আদিমতা। এর রঙ-রূপকে যথাযথ উপলব্ধি করতে হলে সময় নিয়ে দেখে আসতেই হয়। তাইতো এর ভাণ্ডারে বিবিধ রতনের খোঁজ যারা একবার পাবে তারা বারেবারেই ছুটে যাবে এর আনাচে-কানাচে।
===============
Kuhali Bandyopadhyay
A-14, Lalkuthipara Govt.Housing.
Po + Ps - Suri
Dist - Birbhum
Pin - 731101
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন