প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র
মেয়েটির নাম আফিয়ং। সে অতীব সুন্দরী। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যুবকেরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় কোভাম গ্রামে তার বাড়িতে। কিন্তু আফিয়ং তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করে। তার একান্ত ইচ্ছা সে দেশের সব থেকে সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করবে, যে হবে শক্তিশালী সাহসী এবং তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে। আফিয়ং-এর বাবা-মা মেয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান করতে থাকেন, কিন্তু তাঁরা এমন সব পাত্র জোগাড় করেন যারা অর্থবান হলেও বয়স্ক এবং তেমন সুশ্রীও নয়। স্বভাবতই আফিয়ং সেইসব পাত্রকে পাত্তা দিত না।
আফিয়ং-এর সৌন্দর্যের কথা এক পৌঁছে যায় প্রেতলোকে। এক করোটি আফিয়ংকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু সে তো নিছক একটা মাথার খুলি, তার ঘিলু নেই, দেহ নেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। অনেক ভেবেচিন্তে সে তার ভূতপ্রেত বন্ধুদের দ্বারস্থ হল। একজনের কাছ থেকে ধার নিল একটা সুশ্রী মুখমণ্ডল, আর একজনের কাছ থেকে ধার নিল একটি সুঠাম দেহ, একজনের কাছ থেকে নিল পেশীবহুল বাহুযুক্ত একজোড়া হাত, বাকি থাকল পা। তাও সে ধারে পেয়ে গেল এক বন্ধুর কাছে। এইভাবে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চেয়েচিন্তে সে হয়ে উঠল সর্বাঙ্গসুন্দর নবীন যুবা। এখন তাকে দেখে কে বলবে সে আসলে একটা ন্যাড়া খুলি!
প্রেতলোক ত্যাগ করে করোটি-যুবক চলল কোভামের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে সে বাজারের দোকানে দোকানে ঘুরেফিরে জিনিসপত্রের দামদর করে বেড়াতে লাগল। আগন্তুক করোটি-যুবার আসামান্য সৌন্দর্যের কথা আফিয়ং-এর কানে পৌঁছাতেই সে বাজারের দিকে হাঁটা দিল। করোটি-যুবাকে দেখেই আফিয়ং তার প্রেমে পড়ে গেল। সে তার সঙ্গে যেচে আলাপ জমাল।তার হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে গেল। আতিথেয়তা গ্রহণের পর করোটি-যুবা আফিয়ং-এর বাবাকে তার মনোবাঞ্ছার কথা জানাল। কিন্তু তাঁরা অচেনা-অজানা আগন্তুকের সঙ্গে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। কিন্তু মেয়ের নাছোড়বান্দা ভাব দেখে তাঁরা শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন।
করোটি-যুবার সঙ্গে আফিয়ং-এর বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। দিন দুয়েক পরে করোটি-যুবা নববধূকে নিয়ে দেশে ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দিল। আফিয়ং-এর বাবা-মা মেয়েকে পাঠাতে চাইছিলেন না। কিন্তু মেয়ে এমন বায়না ধরল যে, তাঁদের রাজি না-হয়ে উপায় ছিল না। আসলে আফিয়ং, করোটি-যুবার সৌন্দর্যে এমন সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল যে তার বাস্তববুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। ফলে যা হবার তাই-ই হল, নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে মেয়ে বরের হাত ধরে ড্যাংড্যাং করে নাচতে নাচতে বেরিয়ে পড়ল।
দিন দুয়েক পরে আফিয়ং-এর বাবা মেয়ের পরিণতি সম্পর্কে জানার জন্য এক সর্বজ্ঞ গণৎকারের শরণাপন্ন হলেন। সেই গণৎকার অনেক হিসাবনিকাশ করে জানিয়ে দিলেন, মেয়েটি প্রেতলোকের এক করোটির পাল্লায় পড়েছে, তার মৃত্যুযোগ সামনে।
কয়েকদিন হাঁটার পর করোটি-যুবা ও আফিয়ং পৌঁছে গেল প্রেতলোকে। করোটি-যুবাকে দেখে একজন হেঁকে উঠল, 'কই হে আমার পা-দুটো ফেরত দাও দেখি।' সে অপেক্ষা করল না। একটানে করোটি-যুবার পা-দুটি খুলে নিল। মুহূর্তের মধ্যে মুখমণ্ডল, হাত ও দেহের মালকেরাও জুটে গেল। তারা নিজেদের অঙ্গগুলি খুলে নিল। করোটি-যুবা পুনরায় করোটিতে রূপান্তরিত হল। আফিয়ং নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। শেষে ধাতস্থ হয়ে নিজের বোকামির জন্য হাহুতাশ করতে লাগল। কিন্তু গতস্য শোচনা নাস্তি। সে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু করোটির এক ধমকে সে থমকে গেল। বাধ্য হয়ে সে করোটির পিছু পিছু চলতে লাগল। একসময় করোটি গড়াতে গড়াতে এক গুহায় ঢুকে পড়ল। আফিয়ংও তাকে অনুসরণ করল। গুহায় করোটির বুড়ি মা ছাড়া আর কেউ নেই। বুড়ির যেন বয়সের গাছপাথর নেই। সে দাঁড়াতে পারে না, হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। বুড়িকে দেখে আফিয়ং-এর খুব মায়া হয়। সে বুড়ির সেবাযত্ন শুরুর করে দেয়। বুড়ির হাত-পা টিপে দেয়, খাওয়ায় ধোয়ায়। করোটির আর আনন্দ আর ধরে না। সে মনে মনে ভাবে যাক, মেয়েটি এতদিনে পোষ মানল!
আফিয়ং-এর আদরযত্নে বুড়ি খুব খুশি হলেন। একদিন তিনি আফিয়ংকে আড়ালে ডেকে বললেন, শোন মা, ছেলের এই অপকর্মের জন্য আমি দুঃখিত। এটা প্রেতলোক। এখানে সবাই নরখাদক। একবার যদি জানাজানি হয়, তোকে সবাই ছিঁড়ে খাবে। তবে আমি ছেলের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। তোকে আমি তোর বাবা-মার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আপাতত তুই এখানে লুকিয়ে থাকবি। তবে তোকেও কথা দিতে হবে বাড়ি ফেরার পর কখনও বাবা-মায়ের অমতে কোনো কাজ করবি না। আফিয়ং ছলছল চোখে বুড়ির দুটো হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনোই সে বাবা-মায়ের অবাধ্য হবে না। বুড়ি তাকে একটি মাকড়সার কাছে পাঠিয়ে দেয় সাজগোজের জন্য। মাকড়সা তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। বুড়ি তাকে নানান অলংকারে ভূষিত করে। তারপর বুড়ি জুজুর সাহায্যে বাতাসকে ডাক দেয়। প্রথমে বজ্রবৃষ্টিসহ আসে এক ভয়ংকর টর্নেডো। মন সায় না দেওয়ায় বুড়ি তাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর আসে আসে মৃদুমন্দ বাতাস। বুড়ি তার পিঠে চাপিয়ে আফিয়াংকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
বাতাসের পিঠে চেপে অনায়াসে আফিয়ং তার বাড়ির সামনে নেমে পড়ে। তাকে দেখতে পেয়ে তার বাবা-মা কাঁদতে কাঁদতে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। আফিয়ং-এর বাবা উঠানে পেতে দেন হরিণের চামড়ার কার্পেট, যাতে মেয়ের পায়ে ধুলো না-লাগে। আফিয়ং তার ওপর দিয়ে হেঁটে ঘরে ঢোকে। কিছুক্ষণের মধ্যে আফিয়ং-এর বান্ধবীরা চলে আসে নাচগান শুরু হয়। আটদিন ধরে এই নাচগানের পর্ব চলে। আফিয়ং-এর বাবা নগরপালের বাড়িতে গিয়ে মেয়ের ফিরে আসার খবর দেন। সব শুনে নগরপাল এই মর্মে একটি আইন জারি করেন– কোনো বাবা-মা অচেনা-অজানা আগন্তুকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না। কয়েকদিন পরে আফিয়ং-এর বাবা এক সুপাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দেন। বলাবাহুল্য এই বিয়েতে আফিয়ং আপত্তি জানায়নি।
-----------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন