google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re জীবন যেখানে যেমন ।। আরজু মুন জারিন - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

জীবন যেখানে যেমন ।। আরজু মুন জারিন

গল্প

জীবন যেখানে যেমন

আরজু মুন জারিন

 

১ 

পারুলরা তিনবোন। বড় পারুল বয়স দশ মেজ মরিয়ম ছয় ছোট আদুরী বয়স চার।

অনেকক্ষন ধরে তারা তিনবোন চেষ্টা করছে তাদের হাতের মালাগুলি বিক্রি করতে। আজকে কেও একটা মালাও কিনছেনা। ছোট বোন আদুরী ক্ষিধার যন্ত্রনায় রাস্তায় বসে পড়ল। কালকে দুপুর থেকে আজকে এখন বাজছে সকাল দশটা তাদের কোন খাওয়া হয়নি।

"পারুল এসে কোলে নিয়ে বলল মনা বেশী খারাপ লাগছে? আর কিছুক্ষণ বোন"।

 

গ্রীষ্মের প্রখর রোদে দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। যে কোন গাড়ী থামলে চেষ্টা করছে কেও যদি একটা দুইটা মালা কিনে তাহলে কলা পাউরুটি কিনে খেতে পারবে।

তার সামনে হুশ করে একটা গাড়ী থামল । তার হাতের মালাগুলি একঝটকায় টান দিয়ে নিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিল। সে দৌড়াতে দৌড়াতে গাড়ীর পিছনে গেল।পরে হতাশ হয়ে রাস্তায় বসে কাঁদতে লাগল।

কিছুক্ষন পরে উল্টা দিক থেকে একটা গাড়ী এসে থামল পারুলের সামনে। গাড়ী থেকে মাথা বের করে ডাকল কেও তাকে। লোকটি হাত বাড়িয়ে তার হাতে টাকা ধরিয়ে দিল বলল

"তোমার মালার দাম।সরি গাড়ী থামানো সম্ভব হয়নি বলে চলে যেতে হয়েছিল"।

 

পারুলের চোখটা ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়।ছানাবড়া হওয়ার ই কথা।কড়কড়ে পাচশ টাকার নোট এখন তার হাতে।

ছোট দুইবোন পাশে এসে দাড়াল।

"বুবু এই লোকটা কে? কোথা থেকে আসছে" ? মরিয়ম মেজবোন জিজ্ঞাসা করল

 

"ফেরেশতা হবে বুবু"। ছোট আদুরী তার ছোট আদুরে গলায় জানান দিল।

কিছুক্ষন পর গাড়ীর লোকটি আবার কাছে এসে ডাক দিল ইশারায় বলল

"আমার সাথে যাবি ভাল খাবি পরবি"।

"আমার বোনরা যাইতে পারব স্যার"?

 

"না তুই একা আয়" বলে হাত টান দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলে ছোট আদুরী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। পিছনের এক পুলিশের গাড়ী হুইসেল দেওয়ায় লোকটি তাড়াতাড়ি গাড়ী ছুটিয়ে দেয় হাত ছেড়ে ।

তিনবোন অনেক খুশী হাতে অনেক টাকা।

 

"কি খাবি মনা" জিজ্ঞাসা করে ।

"বুবু ভাজি ভাত মাংস আর কোক"।

তিনজনে খেল পেটপুরে মা বাবার জন্য কিছু খাওয়া কিনে বাড়ীর দিকে রওয়ানা করল।


২ 

তাদের মা জামিলা পরপর তিনমেয়ের জন্মদিয়ে স্বামীর কাছে কুন্ঠিত হয়ে থাকে ছেলে না দেওয়ার অপরাধে। বেচারী এখন আবার সন্তান সম্ভবা।মূর্ছার মত হয়ে উঠানে পড়ে আছে। তাকে দেখার ও কেও নাই। খাওয়ানোর ও কেও নাই। তার স্বামী আবদুর রহিম সরকার বাড়ীর গরু ছাগল দেখা শোনা করে।

এই কতক্ষন আগে স্বামী তার সাথে চেচামেচি করে ঘর থেকে গেছে।যখন এরকম চেচামেচি করে মেয়েগুলি ভিতরের রুমে ভয়ে কাপে আর জামিলা কাঁদতে থাকে।

 

"কি কপাল করি আসলাম একের পর এক আভাগ্যার গুষ্ঠি।মানুষের কি সুন্দর একটার পর একটা পোলা হয়।মনে কয় সবগুলারে মাটিতে পুতি লাই"।

 

"এইবার পোলা হইব আমি খোয়াবে দেখছি" মিনমিনিয়ে বলে জামিলা।

"হ হুংকার ছাড়ে রহিম। প্রত্যেক বারে তুই খোয়াব দেখছ বান্ধী"।

 

চেচামেচি করতে করতে সে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।হাটতে হাটতে তার মন পলকে অনুশোচনায় ভরে যায়।

তার এত ভাল বউটারে যখন তখন বাজে কথা বলে সে বিশেষ করে এই সময়ে তার বউ টার যখন যত্নের দরকার। এই কথাটা মনে আসা মাত্র বুকের ভিতরটা টনটন করতে লাগল বউ এর জন্য। তার মেয়েগুলি আল্লাহর রহমতে কত লক্ষী সুন্দর কত গোছানো।

"আমি এরকম করি কেন পোলার লাগি ।মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে ভাবতে থাকে।

মনে মনে ভাবে আর কোনদিন তোগোরে কষ্ট দিমুনা বউ মারে । তার চোখের কোনে পানি চলে আসে। শার্টের হাতায় সে চোখ মোছে।

সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর দিকে রওয়ানা করে আবার। আজকে বউর কাছে মাপ চেয়ে তারপর কাজে যাবে।

পথিমধ্যে দেখা তার দোস্ত বন্ধু একসঙ্গে কাজ করে ।আকবর নাম।

"চল চল তাগাদা দিতে থাকে দেরী হয়ে গেছে এমনিতে।

"আমি একটু বাড়ী থেকে ঘুরে আসি তুই যা"।

"দেরী করিসনা বন্ধু চিৎকার করে বলে"।

একটু পরে মন পরির্তন করে বাড়ীর দিকে না গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে রওনা হল।

বন্ধু পিঠ চাপড়ে দিল "কিরে সব ঠিকঠাক আছে তো"?


হু বলে সে হাসল।

 

 

অনেকক্ষন ধরে জামিলা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। আসমানী মায়ের পেটে বসে সেক দিচ্ছে।

"কয়টা চাল বসাই দে হাড়ীতে।তোর বাপ আসব এখন"।

"মা চাল তো নাই" কিছুক্ষন পরে ঘুরে এসে বলল সে।

"দেখতো আটা আছে নাকি" ?দেখা গেল তাও নাই।

"মা দাড়াও আমি নিয়া আসি" বলে দৌড়ে সামনের দোকান থেকে সামান্য চাল আলু আর এক হালি ডিম কিনল।

আধাঘন্টার মধ্যে নিপুন হাতে ডিমের তরকারী রান্না করল আলু তরকারী ভাতের সাথে। বাবার জন্য বলে ঢেকে মা আর তাদের তিনজনের খাওয়ার এক বোলে করে নিয়ে আসল।

ছোট আদুরী র বায়না মায়ের হাতে খামু।একসঙ্গে সবাই গোল হয়ে মাকে ঘিরে বসল।এক এক লোকমা মা এক এক জনের মুখে দিচ্ছে তারা আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে।

খাওয়া শেষ সব পরিস্কার করে বাবার খাওয়ার পারুল ঢেকে রাখে ঢাকনার নিচে।

 

"মা বাবা তো এখন আসলোনা"।মেয়ে জিজ্ঞাসা করে।

"তোরা বাতি নিভায়ে ঘুমায়ে পড়।আমি জাগবো। বলল জামিলা।

 

ঘরের ভিতরে ঢুকে পারুল তার গোপন সঞ্চয় আবার দেখল কত হয়েছে। বাঁশের চোঙাতে সে সঞ্চয় করে রাখছে। আটশ পচাত্তর টাকা হয়েছে। যখন হাজার টাকা হবে সে ভাবে বাবারে দোকান নিয়ে দিব।

রাতে জামিলার ব্যাথা আরও বাড়ায় ওই বাড়ীর দাই আমেনা বিবিকে নিয়ে আসা হল।

সে এসে প্রয়োজনীয় সব ব্যাবস্থা করল।

 

"ওই পারুল মিষ্টি পায়েসের ব্যবস্থা করছিস তোদের এবার মনে হয় ভাই হবে। বললো দাই বেটি খুশীতে।

পারুলের খুশী র বদলে কান্না আসছে।মা বারবার যেভাবে গোঙানীর মত করে কেঁদে উঠছে তারা তিন বোন শিউরে শিউরে উঠছে।

ছোট বোন আদুরী জোরে কান্না শুরু করল ।আমি মার কাছে যাবো বলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকল।

"হেই বাদাইম্মা কোথায় তোর বাপ" ?জিজ্ঞাসা করে দাই নানী।

 

"আমাদের বাপরে বাদাইম্মা বলবানা" মেজ প্রতিবাদ করে।

"বাদাইম্মা না তো কি? ঘরে কোন ব্যবস্থা নাই খাওয়ার নাই।কি অশৃঙ্খলা তোদের"।

 

দাই নানী চারিদিক ঢেকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার বাহিরে তিনবোন অসহায়ের মত কাঁপতে লাগল।

নুতন প্রাণ আসার সময় আগত।

 

 

আজকের সরকারের বাড়ীর ধান ভাঙ্গার বিশাল উৎসব।চারিদিকে মেয়েরা সাজগোজ করে নাচগান করছে।খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন । রহিমের সামনে একজন একপ্লেট খাওয়ার রেখে গেল। খাওয়া দেখে বুকের ভিতর টনটনিয়ে উঠল। বউটার কথা মনে পড়ে গেল। বউ র দেওয়া খাবার ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে আসছে আজকে।

ভাবী পাশের মহিলাকে ডাকলো

 

"এই খাওয়ার আমি নিয়ে যাবো বাড়ীতে। কোন বাটিতে বা বোলে যদি দিয়ে দিতেন।" অনুনয়ের স্বরে বলল সে

"এই মিয়া এ তুমি খাও। আদুরীদের জন্য খাওয়ার দিয়ে দিবো পরে। চিন্তা কোরনা"। বললো ভাবী স্নেহের সুরে।

কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। বারবার ছোটমেয়ের কথা মনে পড়ছে। কতদিন মেয়েগুলি কোলে নিয়ে আদর ও করে নাই। আজকে বাড়ীতে যাওয়ার পর আর কোনদিন বউ বাচ্চারে কস্ট দিবোনা আল্লাহ মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করে।

 

হঠাৎ আশেপাশের পরিবেশ সচকিত করে বাতাসে ভেসে এল আর্তচিৎকার। দেখা গেল রহিম মাটিতে পড়ে গিয়ে কাটা মাছের মত তড়পাচ্ছে। ধান ভাঙ্গার মেশিনে কোন ফাকে তার হাত ঢুকে গিয়েছে । নিমিষের মধ্যে তার হাত কনুই পর্যন্ত কেটে আরেক জায়গায় উড়ে পড়লো। তার আর্তচিৎকার সবার হায় হায় ধ্বনিতে পরিবেশ ভারী বেদনার্ত হয়ে উঠল। অসহ্য ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো।

 

রহিমকে নিয়ে আসা হল সদর হাসপাতালে। সে ব্যাথায় প্রলাপের মত বকছে।

আদুরী মা তুই কই?আমার বউ আমারে মাপ করে দে।

প্রবল রক্তক্ষরনে সে একসময়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ।

একই সময়ে জামিলা সন্তান প্রসব করল।এবার আল্লাহ তাকে দয়া করেছে একদিকে ।তার ছেলে হয়েছে এবার। আরেকদিকে জীবন মৃত্যূর সাথে পান্জা লড়ছে সদ্য প্রসূত শিশুটির জন্মদাতা।

প্রকৃতি জানে সে বেচে ফিরে আসবে কিনা এই শিশুটির কাছে এই পরিবারটির কাছে। ছোট খাট দুঃখ কষ্ট বেদনায় জীবনের গতি থেমে যায়না। জীবন জীবনের নিয়মে চলতে থাকে।

পারুলরা তিনবোন তাদের ছোট ভাই টিকে কোলে নিয়ে বাবার অপেক্ষায় দাড়িয়ে।

 

পরিশিষ্ট: কেও একজনকে দেখা যাচ্ছে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। তাদের বাবা ও হতে পারে বা বাবার সংবাদ বহনকারী দূত।

আর ও তিন বৎসর পরের ঘটনা। সেই একই জায়গা ক্যান্টনমেন্ট এর ট্রাফিক লাইট টার সামনে তারা দুইবোন দাড়িয়ে

পারুল ও মরিয়ম। ষ্টপে গাড়ী থামা মাত্র ভিতর থেকে এক লোক বলে উঠল দরজা খুলে আহবানের ভঙ্গিতে

"আয় আয় আমার গাড়ীতে ভাল খেতে পারবি পরতে পারবি"। তিনবছর আগে বলা এই কথাগুলির অর্থ সে ধরতে পারেনি। আজকে পারলো।

বিনা বাক্যব্যয়ে সে গাড়ীতে উঠে বসলো।

 

--------------সমাপ্ত-------------



Hosne Ara Arzu
40 Teesdale Place 
Unit no 1903
Scarborough, Ont
M1L 1L3
Canada





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন