কবচ
ঠিক ক্যারাটে নয়, বলা যায় সেল্ফ ডিফেন্স অর্থাৎ আত্মরক্ষা। পাড়ায় একটি ক্লাব
তার কুড়ি বাই কুড়ি ফুটের জমি যার নাম মাঠ,
সেখানে
শিক্ষার আয়োজন করেছে। প্রশিক্ষরা সেই জমিকে বলছে লন। তবে অমসৃণ জমির ফালিকে
প্রশিক্ষণ যোগ্য করতে লনে যেটুকু ঘাস ছিল তা চেঁছে দুরমুশ পিটিয়ে ন্যাড়া করে ফেলা
হয়েছে। সেখানেই ভর্তি হয়েছে শাহানা।
মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোটে
তিনজন হওয়ায় তাদের জন্য আলাদা ব্যাচ তৈরি না করে আপাতত ছেলেদের সঙ্গেই শেখানো হবে।
প্রথম দিন ট্রেনার কোনও নির্দিষ্ট ধারার পূর্ণাঙ্গ মার্শাল আর্ট আর আত্মরক্ষার
মধ্যে পার্থক্য এবং তার উপযোগিতা নিয়ে বক্তব্য রাখছেন।
"এই যে শাহানার দিদির কথা
তোমরা সবাই জানো। তার মতো অবস্থা যাতে না হয় সেই জন্যই সেল্ফ ডিফেন্স। ধরো যদি
তোমাদের একসাথে চারজন চার দিক থেকে ঘিরে ধরেছে, তখন কী করবে? তখন শুধু গায়ের জোর
খাটালে চলবে না, বুদ্ধিও খাটাতে হবে।
এই সমস্তই আমাদের কোর্সে আছে।"
একজন শিক্ষানবিশের প্রশ্ন, "যদি যারা অ্যাটাক করছে তারাও এই ব্যাপারে
এক্সপার্ট হয়?"
"সেই জন্যই তো আমাদের সকলেরই
আরও বেশি করে শেখা প্রয়োজন। এই যে শাহানার দিদির সঙ্গে যা হয়েছে, যদি সে আত্মরক্ষার উপায় শিখে রাখত, হয়তো সেটা এড়াতে পারত। এই ট্রেনিংটা হেলমেটের মতো।
প্রোটেক্ট করবে, কিন্তু কোনও
প্রোটেকশনই তো হানড্রেড পার্সেন্ট গ্যারেন্টি দিতে পারে না। কিন্তু তাই বলে কি
প্রোটেকশন নেব না? নিজের রক্ষাকবচ তো
নিজেকেই ধারণ করতে হবে।"
বারবার দিদির উদাহরণে
যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় শাহানা। যে ঘটনার অভিঘাত থেকে বেরোনোর জন্য তাকে ছ মাস
মনোবিদের চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে, সেটা মনে করালে মনোবল
বাড়ার বদলে কুঁকড়ে যায়। ভেতরের আগুন ততক্ষণই উদ্দীপক যতক্ষণ তা নিয়ন্ত্রিত। দাবানল
হয়ে গেলে তো ভেতরটা ছাই হয়ে যায়, অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো
জীবনিশক্তি অবশিষ্টই থাকে না।
অহনা সান্যাল এই এলাকার গত দু বছর
ধরে অন্যতম আলোচ্য নাম। তবে সেই আলোচনায় পরিবারের সম্মান বা আনন্দ বৃদ্ধি হয় না।
সাতজন শিকারি মিলে যা যা করার তা করে কাতরানো শরীরটার অ্যাসিড দিয়ে সৎকার পর্যন্ত
করে দিয়েছিল। পুলিসের বিলম্বিত তৎপরতায় দেহটা যবে উদ্ধার হল ততদিনে নিজের বাঁচার
ইচ্ছা প্রকাশ করে সে 'নির্ভয়া' প্রতিপন্ন হতে পারেনি। তবে যেহেতু দুপুরবেলা কলেজ থেকে বাড়ি
ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যায়, তাই রাতবিরেতে ঘোরা
নিয়ে বক্রোক্তির অবকাশ তেমন ঘটেনি। মিডিয়ার সৌজন্যে অহনার প্রেতাত্মার কোনও আদরের
নাম জোটেনি, তার নিজের নামটাই ঐ অঞ্চলের
নারী শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে,
যেমন
পেয়েছে এই 'আত্মরক্ষা'র ক্লাসে।
বাড়ি ফিরে দেখে মা এই গরমেও গায়
কালো ক্রুশের চাদর মাথায় ঘোমটা দিয়ে, যেন এক্ষুণি কোথা
থেকে ফিরেছেন। এই রকম চাদর তো ওরা পরে,
বোরখার
উদারতর বিকল্প। মায়ের গায়ে কেন?
"কোথায় গিয়েছিলে মা এমন
টিপিকাল চাদর জড়িয়ে?"
কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা খাম বার
করলেন মা। খামের ভেতর একটা কালো সূতোর মধ্যিখানে লকেটের মতো বাঁধা একটা লম্বাটে
সরু ছোট্ট পুরিয়া। মাদুলির মতো, তবে রূপো দিয়ে
বাঁধানো নয়।
মা বললেন, "এটা গলায় পরে থাক। আর
তেমন বিপদ বুঝলে দাঁত দিয়ে বেশ করে চিবিয়ে নিস, বুঝলি? নিজের গয়না বিক্রি করে অনেক
টাকা দিয়ে কত লুকিয়ে চুরিয়ে যোগাড় করেছি,
হারায়
না যেন। যদি তোর ক্যারাটের বিদ্যে কাজে লাগে তো খুব ভালো। নইলে নিজেকে দিদির মতো
কষ্ট দিস না মাগো। যন্ত্রণা অপমান থেকে এটাই তোর আসল রক্ষাকবচ।"
==================================================
Sriparna Bandyopadhyay
Flat 3A, Jagadish Apartment
26 J. K. Chatterjee Road
Sodepur, Kolkata 700110
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন