সেদিন ছিলো পনেরোই অগাস্ট, আমার কাছে তখন পনেরো অগাস্ট মানে একটা চকোলেট চকোলেট দিন, সারাদিন অনেক খেলাধূলা করা সকালে প্রভাত ফেরী নাচ গান, আর বিকেলে খেলা জিতে অনেক পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফেরা। সেদিন ও এক পনেরো অগাস্টের বিকেল, আমি অনেক গুলো পুরস্কার চকোলেট দু'হাতে বুকের কাছে চেপে ধরে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ দেখলাম রাস্তার একপাশে সবুজ ঘাসের উপর চেপ্টা হয়ে ফুলা পাটা রোদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বসে হাঁপাচ্ছেন আমাদের প্রতিবেশী ফুলন পিসি। পাশে একটা কলসি ভর্তি জল, সম্ভবত আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী থেকে কলসি দিয়ে জল তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন, এই ফুলন পিসিকে আমি খুব ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি , বেচারির বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী মারা যান, বাবার বাড়িতে এসে উঠেছেন ভাইয়ের সংসারে। অসুস্থ মহিলা, বাঁ পাটি ফুলা, ব্যথায় ভালো করে হাঁটতে পারেন না, তবুও সারাদিন কতো রকমের কাজই না করতে হয়। রাস্তার পাশে বসে এভাবে হাঁপাতে দেখে আমি পাশে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে তোমার পিসি?
উনি প্রথমে কোন উত্তর দিলেন না, আবার বললাম কী হয়েছে তোমার? এবার হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন যন্ত্রণা, পায়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি তার দিকে একটা চকোলেট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম খাবে? মাথা নাড়িয়ে না করলেন, আমি আরো একটু কাছে গিয়ে বললাম এই ফুলা পা নিয়ে জল নিতে কেন এসেছো তুমি। এবার ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে জিগ্যেস করলেন তুই কোথায় গিয়েছিলি?
আমি বললাম স্কুলে, স্কুল থেকে মাঠে, আজ তো স্বাধীনতা দিবস তুমি জানো না? ও আজ স্বাধীনতা দিবস? হায় রে স্বাধীনতা! লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফুলন পিসি আমায় বললেন তা আজ কী করলি মাঠে গিয়ে? এই দিনে খুব মজা হয় আন্টি, কোন পড়াশোনা নেই, সারাদিন খেলা চকোলেট খাওয়া আর বিকেলে এত্তোগুলো পুরস্কার নিয়ে বাড়ি আসা। একটা চকোলেট খাও। আমি আবার একটা চকোলেট তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, ফুলন আন্টি তার শক্ত খসখসে হাতের তালু দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন বাড়ি যাও, বোনকে নিয়ে খাও। আর মন দিয়ে পড়াশোনা করো। অনেক বড় হও। স্বাধীনতা থাকুক তোমাদের জীবনে। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি স্বাধীনতা আবার জীবনে থাকে কী করে?
আমি তাকে জানতে চাইলাম- তোমার জীবনে কী তাহলে স্বাধীনতা নেই পিসি?
- না রে মা নেই।
- তাই বুঝি তোমার খুব কষ্ট?
- হ্যাঁ, তাই আমার খুব কষ্ট।
- আমি তোমায় স্বাধীনতা এনে দেবো পিসি, তাহলে তোমার আর কোন কষ্ট থাকবে না। বল না স্বাধীনতা কোথায় পাওয়া যায়, আন্টি একটু মুচকি হেসে বললেন স্বাধীনতা পাওয়া যায় না রে মা। ছিনিয়ে আনতে হয়। আমি ছিনিয়ে এনে দেবো তোমায়। তুমি তবে বড় হও। অনেক পড়াশুনো করো তবেই পারবে। আমি আসতে আসতে আবার বললাম আমি বড় হয়ে তোমায় স্বাধীনতা এনে দেবো আন্টি, নিশ্চয়ই এনে দেবো।
এখন আমি বড় হয়েছি, কিন্তু স্বাধীনতা এনে দিতে পারিনি ফুলন পিসিকে। কারণ যে দেশে সীমান্তের আকাশ ঘোলাটে, বোমা বারুদের শব্দ কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে, এক রাজ্যের পুলিশ অন্য রাজ্যের পুলিশকে মেরে উন্মাদ নৃত্য করছে, রাজা নীরব দর্শক হয়ে দেখছেন, খর্ব হচ্ছে ধর্মের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা , ফুটপাতে রাস্তার পাশে পথশিশুদের জীবন নিয়ে টানাটানি, দিনদুপুরে ধর্ষিত হয় মেয়ে, সেই ধর্ষিতা মেয়েকে জ্বালিয়ে দেয় পুলিশ । সত্যি বড় অবাক এই দেশ আর তার নিয়ম। ডাস্টবিনের ময়লা পরিস্কার করতে গেলে যে দেশে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে সেই দেশের রাজা মন্ত্রী নেতা হতে গেলে কোন যোগ্যতা লাগে না। সাবেক চোর গুন্ডা মাস্তান ডাকাত সব হলেই চলে। আর যাইহোক এমন দেশে তোমায় আমি আরো বড় হলেও স্বাধীনতা এনে দিতে পারবো না হয়তো ফুলন পিসি।
এতো পরাধীনতার মাঝেও বছরে একবার পনেরো অগাস্ট এলে আমি সব ভুলে গিয়ে হয়ে যাই একটুকরো ভারতবর্ষ। দূরে কোথাও থেকে যখন ভেসে আসে "সারে জাঁহা সে আচ্ছা " অথবা জন-গণ - মন অধিনায়ক জয় হে. ভারত ভাগ্য বিধাতা "....
আমার সারা শরীরের প্রতিটি লোমে লোমে শিহরণ জাগে। আমি সেদিন হয়ে যাই একটুকরো ভারতবর্ষ।
---------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন