Featured Post
জীবনের সেরা পুজোর দিনটির কথা ।। গোবিন্দ মোদক
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
জীবনের সেরা পুজোর দিনটির কথা
গোবিন্দ মোদক
স্মৃতিকথার প্রসঙ্গ এলেই প্রথমেই মনে পড়ে "স্মৃতি সততই সুখের"। তবে "স্মৃতি সততই সুখের" --- এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও সত্য যে- স্মৃতি অনেক সময়ই দুঃখের। তো, এই সুখ-দুঃখের প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি এখন বলতে চেষ্টা করবো আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সেই পুজোর দিনটির কথা।
সালটা 1978 বা 1979 হবে, তখন আমার বয়স বারো-তেরো। আমাদের পাঁচ ভাই-বোন, বাবা-মা মিলে অভাবের সংসার। বহুদিন দেখেছি রাত্রে আমাদের ভাই-বোনকে রুটি খাইয়ে মা-বাবা মুড়ি খেয়ে থেকেছেন। তখন দারিদ্র জিনিসটাকে বুঝতাম, কিন্তু কতোখানি অভাব থাকলে মা-বাবাকে মুড়ি খেয়ে রাত কাটাতে হয় সেটা বুঝবার বয়স বোধহয় তখন আমার হয়নি। কাজেই সেটাকে খুব অস্বাভাবিক মনে করতাম না। কিন্তু পুজো এলে আমাদের তিন বোনের মন খুব খারাপ হতো, কারণ তাদের নতুন জামাকাপড় হতো না। এই মন খারাপের ব্যাপারটা দূর করতে বাবা ধার-দেনা করেও ছাপা ছিট কাপড়ের থান কিনে তিন বোনের জন্য ফ্রক বানিয়ে দিতেন পাড়ার দর্জি জেঠুর কাছ থেকে। তাতেই তাদের কী আনন্দ ! কিন্তু আমাদের দুই ভাইকে ? না, না। আমাদের দুই ভাইয়ের যেমন চাহিদাও ছিল না, তেমন সেটা পূরণও হতো না। যাই হোক সে কথা। অভাবের সংসারে কি যেন মনে হলো --- পুজোতে বেলুনের দোকান দেবো, যা রোজগার হয় !কিন্তু বেলুনের দোকান দিতেও দু'শো-তিনশো টাকা মূলধন প্রয়োজন, সেটা আসবে কোথা থেকে ! অগত্যা বাবার এক দাদা স্থানীয় বন্ধু অর্থাৎ আমাদের এক জেঠু (ভোলানাথ দাস) এ বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। তিনি তিনশো টাকার মতো বেলুন আমাদেরকে ধার দিলেন। কিন্তু সাপ-বেলুন ফোলানোর মতো পাম্পার দিতে পারলেন না। তারপর অনেক কষ্টে সেটি নব্বই টাকা দিয়ে জোগাড় হলো।
ষষ্ঠির সন্ধ্যে থেকেই বসে পড়লাম বেলুন নিয়ে। সঙ্গে সরঞ্জাম বলতে একটি টেবিল, ছোট্ট একটি জলচৌকি, গুলি-সুতো, পাম্পার, বেলুন আর পাটকাঠিতে বাঁধা একটি খাঁচা, যাতে বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন মাপের, বিভিন্ন ছাপার, বিভিন্ন রঙের বেলুন ঝোলানো চলবে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পর্যন্ত সব ছেলেমেয়েরা, আমাদের স্কুলের বন্ধুরা নতুন জামা-কাপড় প'রে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পুজো দেখে বেড়ালো, আর আমি আমার ভাইকে সঙ্গে করে বেলুন বিক্রি করতে থাকলাম। দশমীর সকালে হিসাবপত্র মিটিয়ে ফেলতে হলো। সবকিছু মিটিয়ে দেওয়ার পর আমার হাতে লাভ হিসাবে রইলো ঐ পাম্পারটি এবং নগদ সত্তর টাকা মতো ক্যাশ। সত্তর টাকা মানে তখনকার দিনে খুব কম নয়, অন্তত আমার কাছে। আমার তিন দিনের রোজকার --- জীবনের প্রথম রোজগার !
কি ভেবে যেন সেই টাকা দিয়ে স্থানীয় কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে গিয়ে মায়ের জন্য একটি জনতা শাড়ি (যতদূর সম্ভব আটত্রিশ টাকা) এবং বাবার জন্য একটি কম-দামের লুঙ্গি (সম্ভবত: পনেরো টাকার মতো হবে) এবং একটি গেঞ্জি কিনে আনলাম। সেইসঙ্গে মায়ের জন্য আলতা-সিঁদুর এবং এক হাঁড়ি রসগোল্লা। তখন পাঁচ টাকায় দশটি বড়ো সাইজের রসগোল্লা পাওয়া যেতো। সেগুলো মা এবং বাবাকে দিয়ে প্রণাম করলাম। মা-বাবা সেদিন কেঁদে আকুল। জানিনা মণ্ডপে মা দুর্গা বিদায়ের ব্যথায় কতোখানি কেঁদেছিলেন, কিন্তু আমার ঘরের মা দুর্গা সেদিন কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আর আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছিলেন। সেই দিনটিতে আমার চোখেও ছিল আনন্দাশ্রু। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে --- একে একে বাবাকে হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি। কিন্তু সেই দিনের স্মৃতি, সেই দশমীর অমূল্য স্মৃতি আজও আমার মনের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করে। মেয়েরা সাধারণত নিজের সুখের কথা এবং দুঃখের কথা সবাইকেই বলতে বেশি ভালোবাসে। আমার মাও সেদিন সবাইকে সেই লাল পাড় সবুজ রঙের শাড়িটা দেখিয়ে বলেছিলেন আমার গোবু (আমার ডাকনাম) প্রথম রোজগারের টাকায় আমাকে শাড়ি দিয়েছে। কিন্তু আমার বাবা ইন্ট্রোভার্ট ছিলেন, কাউকে এভাবে নিজের মনের কথা মন খুলে বলতে পারতেন না। কিন্তু তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন, আমি আজও অনুভব করি আমার মাথায় বাবার সেই কল্যাণসুন্দর হাতটির স্পর্শ আজও যেন রয়েছে, রয়েছে মায়ের সেই স্মৃতিমেদুর আদরের স্পর্শ।
ওহো, আর একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি --- সেটি হচ্ছে মা-বাবা সেদিন সন্ধ্যেবেলায় সেই সামান্য অতি নগণ্য নতুন পোশাক পরে ঠাকুর বিসর্জন দেখতে গিয়েছিলেন। জানি এই ঘটনাটা অনেকের কাছেই অকিঞ্চিৎকর মনে হবে। কিন্তু আজও আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পুজোর দিন হিসাবে এই দিনটির কথাই মনে হয়। আজ আমার উপার্জন পাঁচ অঙ্ক ছাপিয়ে ছয় অঙ্কের পথে, কিন্ত জীবনের সেই প্রথম রোজগারের সামান্য অর্থে মা-বাবাকে অতি সামান্য গিফট্ দিয়ে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তা পরবর্তীতে লাখ টাকার গিফট্ দিয়েও পাইনি।
_____________________
গোবিন্দ মোদক।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ডাকসূচক - 741103
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন