বাংলার গাজন, চড়ক ও বর্ষশেষের সংস্কৃতি
সৌভিক দে
শিব হচ্ছে বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় দেবতা। তিনি খুব অল্পতেই তুষ্ট হন। বাংলায় শিবপুজোর জন্যে চৈত্র মাসের এক আলাদা গুরুত্ব। শ্রাবণ মাস, শিব লিঙ্গে জল ঢালার মাস। বাঙালি সম্ভবত শিবের মাথায় জল ঢালার বিষয়টা আগে পালন করত না। কারণ, মধ্যযুগে বা ইংরেজ আমলে বাংলায় এই শ্রাবণ মাসে জলবাহী পদযাত্রা উৎসবের কোনও নথি-প্রমাণ নেই। উত্তর ভারতে এই শিবের মাথায় শ্রাবণ মাসে জল ঢালা এক বিশাল বড় উৎসব – সেখান থেকেই বাঙালিরা প্রভাবিত। যদিও প্রথাটি প্রাচীন। মনে রাখতে হবে, উত্তর ভারতের দীর্ঘ অংশ শুষ্ক, তার অনেক স্থানেই আজও দীর্ঘ যাত্রা করে খাওয়ার জল নিয়ে আসতে হয়। এই প্রথা সেখান থেকে এসেছে, এমন সম্ভাবনাই প্রবল। জল ঢালার পেছনে এক সুপ্রাচীন কৃচ্ছসাধন ও তীর্থযাত্রার প্রথা কাজ করে থাকে। কিন্তু নদীমাতৃক সুজলা-সুফলা বাংলায় এমন প্রথা বেমানান, দীর্ঘ দূরত্ব থেকে জল বয়ে আনার এই উৎসব অন্তত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বা জলময় পূর্ববঙ্গের হতে পারে না। তাছাড়া সন্ধ্যা রায় অভিনীত 'বাবা তারকনাথ' সিনেমার সাফল্যের পরে, জল বয়ে নিয়ে শিবের মাথায় ঢালার প্রবণতা খুবই বেড়ে গিয়েছে।
কিন্তু চৈত্র মাসে শিবের জন্যে গ্রামবাসীরা প্রচুর কষ্ট করে। স্থানীয় জাগ্রত শিবমন্দির থেকে গ্রামবাসীরা অনেকেই এক মাসের সন্ন্যাস গ্রহন করে উত্তরীয় নেয়। সারাদিন উপবাস। শুধু রাতে একবার ক'রে খাওয়া। এদের বলা হয় গাজনের 'সন্ন্যাসী' বা 'সাঁই'। মহিলা, পুরুষ, বয়স্ক, অল্প বয়সী – সবাই এতে সন্ন্যাস নিতে পারে। অনেক গ্রামবাসীরা সন্ন্যাসের জন্য মানত করে – কেউ পনেরো দিন, আবার কেউ পাঁচ দিন। এ এক বাৎসরিক উৎসব। বলা যেতে পারে বর্ষবিদায়েরও উৎসব। বিভিন্ন দেশে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজনই ব্যাপক। বাঙালি বিদায়কেও মহিমান্বিত করে তুলতে জানে। গ্রামের ব্রাত্যজন, মানে গাঁ-জনের কাছে যার পুজোর মন্ত্র বলতে স্রেফ নাচ আর গান। বৃহদ্ধর্মপুরাণে অবশ্য চৈত্রমাসে শিবের উৎসব সম্পর্কে বলা হয়েছে – "চৈত্রমাসে কি ক্ষত্রিয় কি বৈশ্য, কি শূদ্র… দেহ পীড়ন পূর্বক নৃত্যগীত মহোৎসব সহকারে ভক্তিপূর্বক শিবোৎসব করিবে"। শিব শ্মশানচারী দেবতা। সুতরাং শিবের সঙ্গে শব যে যুক্ত হবে এতে আর আশ্চর্য কোথায়।
গাজন পশ্চিমবঙ্গে পালিত একটি হিন্দু লোক-উৎসব। বাংলায় 'গাজন' শব্দটি 'গর্জন' শব্দ থেকে এসেছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এইরূপ নামকরণ হয়। অপর মতে, 'গাঁ' শব্দের অর্থ গ্রাম এবং 'জন' শব্দের অর্থ জনসাধারণ; গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের এই রূপ নামকরণ বলেও অনেকে মনে করেন। এই উৎসব শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পুজো কেন্দ্রিক উৎসব। মালদহে গাজনের নাম 'গম্ভীরা', জলপাইগুড়িতে 'গমীরা'। নবদ্বীপ মহিমার লেখক কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি 'গাজন'-কে ধর্মগাজনের অপভ্রংশ বলেছেন। গাঁ-জনের এই শিব সাধনায় তাই আত্মগোপন করে আছে কত বিস্মৃত যুগের লোকাচার। আত্মগোপন করে আছে জীবন সংগ্রামের এক অনিবার্য প্রেরণা। পাশাপাশি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, অভাব-অভিযোগ, ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম-উত্তরণের বিচিত্র প্রাণধর্ম প্রকাশিত হয়েছে গাজন কেন্দ্রিক প্রাচীন লোকসংগীত বোলান গানে ও কয়েকটি সুপ্রাচীন লোকনৃত্যে। এছাড়া শিবের গাজনে মূলত দু'জন সন্ন্যাসী শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সং সেজে নৃত্য করতে থাকেন। শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। এলাকাভেদে গাজনে সন্ন্যাসীদের আচার অনুষ্ঠানের পার্থক্য আছে। অন্যদিকে, ধর্মঠাকুরের গাজন হল ধর্মঠাকুর ও দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব। ধর্মের গাজন সাধারণত বৈশাখ, জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালিত হয়। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা (কালিকা পাতারি নাচ)। জৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেয়, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে। জৈষ্ঠ্য মাসের দশহরাতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের অযোধ্যাগ্রামের 'মনসার গাজন'-এর জনপ্রিয়তা আজও আছে। চৈত্রমাস ছাড়া বছরের অন্যসময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলে তাকে 'হুজুগে গাজন' বলা হয়। বাঁকুড়ার ছাতনা থানার ঝাঁটিপাহাড়ী গ্রামে জৈষ্ঠ মাসের ২৫/২৬ তারিখে শিবকেন্দ্রিক 'হুজুগে গাজন' বিখ্যাত; এখানকার মেলায় আদিবাসী নৃত্য বিশেষ আকর্ষণ। আষাঢ়ি পূর্ণিমায় বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজনও বেশ উল্লেখযোগ্য।
পশ্চিমবঙ্গে চৈত্রসংক্রান্তিতে হুগলি জেলার তারকেশ্বরে তারকনাথ শিব, বর্ধমানের কুড়মুনের ঈশানেশ্বর শিব, বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর শিব ও বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার বুনোঠাকুর শিবের গাজন বর্তমানে বিখ্যাত ও উল্লেখযোগ্য। কলকাতায় গাজনে একসময় কাঁসারিপাড়া ও জেলেপাড়ার সঙ বিখ্যাত ছিল। এই দিনেই কলকাতার লোহাপটি থেকে বার হত বারোয়ারি সঙ। কলকাতাতে সঙদের আবির্ভাব হয় বাবু-কালচারের সময় থেকে। নানারকম পোষাক ও রঙিন সাজে সেজে, গান, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্টি করা হত হাস্যরস। মূলত গ্রামীণ লোকেদের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের হাত ধরে এটি চলে আসে শহরাঞ্চলে। অন্যান্য পুজো-পার্বণে সঙ দেখা গেলেও, গাজন উপলক্ষে এদের সবথেকে বেশি দেখা যেত। প্রথমদিকে প্রান্তিক সমাজের সংস্কৃতি বলে, শহুরে সমাজ এটাকে নিচু চোখে দেখতো। পরে ফূর্তিবাজ জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সেই সময়ে কলকাতার পাড়াগুলোয় দ্রুত ঘন বসতি গড়ে উঠেছিল, একই জীবিকা বা একই জাতের মানুষের একত্রিত হওয়ার ভিত্তিতে। যেমন ডোমতলা, কুমোরটুলি, বেনিয়াটোলা, আহিরীটোলা, কাঁসারীপাড়া, জেলেপাড়া, লোহাপটি ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতক থেকেই কলকাতা ও হাওড়াতে এই পাড়াগুলো থেকে, অঞ্চলভিত্তিক সঙদের শোভাযাত্রা বেরোতে থাকে। কাঁসারীপাড়া অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি তারকনাথ প্রামাণিক, এবং হিন্দু পেট্রিয়ট এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের পরিচালনায় বের হত কাঁসারীপাড়ার প্রসিদ্ধ সঙ যাত্রা, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন। পরবর্তীকালে অবশ্য আহিরীটোলা, খিদিরপুর, বেনিয়াপুকুর, তালতলা, জেলেপাড়া প্রভৃতি এলাকা থেকেও শুরু হয় সঙ বেরনো। হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর থেকেও বের হতে এই সঙ। নানান এই বিচিত্র সঙের ফিরিস্তি দিয়েছেন হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমের লেখা পড়লে মনে হয় সেকালের কলকাতার সংস্কৃতি যেন সঙের রঙ ঢং-এ মেতে উঠেছে। রঙ্গময় এই বঙ্গদেশে উনিশ শতকে সঙের মিছিলে, এবং সঙের গানে রস পরিহাস ও কৌতুকে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য কথা।
সেই দিনে কলকাতার গলি ও রাজপথের বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানালায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। কলকাতা হয়ে উঠত মিলন মেলার নামান্তর। গৃহস্থঘরে অতিথির জন্য তৈরি হত শরবত। থাকত পান, তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের উপর সামিয়ানা টাঙানো হত। ১৯১৭ সালে চুরি গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। জেলেপাড়ায় রচিত হল –
"বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে
সখীরা নেকী নাকি পড়ল ফাঁকি
কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে
বিদ্যা সর্ববিদ্যা অধিকারী
দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী
বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে"
ইংরেজদের সন্তুষ্ট করে চলা বাঙালি'বাবুদের উদ্দেশ্যে লেখা –
"ডাণ্ডা ধরে গাধা পিটলে
ঘোড়া কভু হয় না
ধরে যখন কান মলা দেয়
তখন বাঁকা থাকতে পারে না।"
তথাকথিত ইঙ্গ-বঙ্গ যুবককে নিয়ে লেখা সঙের গানও আছে —
"এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপ
চোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপ
মুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপ
একমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যান
এরা নতুন অর্থ করেন গীতার
ভুল ধরেন পরম পিতার
নৈলে কি তার trial বিনা in হয়।"
হাসানোর জন্য নানা রঙ ঢং দেখিয়ে সঙের দল ছড়া কাটত —
"হাসি হাসব না তো কি
হাসির বায়না নিয়েছি
হাসি ষোল টাকা মণ
হাসি মাঝারি রকম
হাসি বিবিয়ানা জানে
হাসি গুড়ুক তামাক টানে
হাসি প্যরা গুড়ের সেরা
হাসি হুজুর করে জেরা।"
"বারো মাসে তেরো পার্বণ" নিয়ে এক বহু পুরোনো প্রচলিত সঙের দল কর্তৃক ব্যবহৃত ছড়া —
চৈত্রমাসে চড়ক পূজা গাজনে বাঁধ ভারা (১)
বৈশাখ মাসে দেয় সকল তুলসীগাছে ঝারা (২)
জৈষ্ঠমাসে ষষ্ঠীবাঁটা জামাই আনা আনি (৩)
আষাঢ় মাসে রথযাত্রা দড়া টানাটানি (৪)
শ্রাবণ মাসে ঢেলাফেলা হয় চড়চড়ী (৫)
ভাদ্র মাসে টকপান্তা খান মনসা বুড়ী (৬)
আশ্বিনে অম্বিকা পূজা কাটে মোষ পাঁঠা (৭)
কার্ত্তিকে কালীকা পূজা (৮)
ভাইদ্বিতীয়ার ফোঁটা (৯)
অঘ্রাণে নবান্ন নূতন ধান কেটে (১০)
পৌষ মাসে বাউনী বাঁধা ঘরে ঘরে পিঠে (১১)
মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতেখড়ি (১২)
ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা ফাগ ছড়াছড়ি (১৩)
তৎকালীন বাঙালি সমাজে বছরভর যে সব ঘটনা, দৃশ্য বা কথা দাগ কেটেছে – মূলত তা আলোকিত হত সঙের ছড়ায় আর গানে। এরকম তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির উপরে বিদ্রুপ করার জন্য, একটা সামাজিক ঝড় ওঠে। তারপর এই সঙ সংস্কৃতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে থাকে। পরবর্তীকালে, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপে এবং কলকাতাতে প্লেগের মহামারীর জন্য, এই সঙযাত্রা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ৮০'র দশকে 'কলিকাতা কৈবর্ত সমিতি' আবার নতুন ভাবে উপস্থাপিত করে জেলেপাড়ার সঙকে। প্রতিবাদ জানানো হয় দাঙ্গা লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। ১৯৯৩ সালে ডঃ প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের উদ্যোগে আবার শুরু হয় জেলেপাড়ার 'সঙ সমিতি সঙ্ঘ'। মিছিল বের করেন শঙ্কর প্রসাদ দে। এনাদেরই মতো কিছু মানুষের উদ্যোগে আজও বেঁচে আছে বাংলা লোক বিনোদনের এই মৃতপ্রায় মাধ্যমটি। তবে এরা আগের মতো প্রসিদ্ধি পায়নি। কারণ, সময়টা বদলে যেতে শুরু করেছিল অনেকটাই। বিশ্বায়নের যুগে, এই সঙ-সংস্কৃতির আর কোনো চাহিদা তৈরী হয় নি। এই সঙ-সংস্কৃতি কলকাতা থেকে প্রায় হারিয়ে গেলেও, তাদের ছড়া-গানের এবং যাত্রার অনেকগুলো কথা আজ প্রায় প্রবাদ বাক্যে পরিণত – এখনো আমরা ব্যবহার করে থাকি। যেমন : 'এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই', 'বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন', 'ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে', 'কানা পুত্রের নাম পদ্মলোচন', 'মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কি উপায়', ইত্যাদি।
এ-দিকে ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজনে তিনটি প্রমাণ সাইজের কাঠের ঘোড়ার উপরে মহামানস, স্বরূপনারায়ণ ও ধর্মরাজকে (যথাক্রমে বুদ্ধ, সংঘ ও ধর্ম) চড়িয়ে অসংখ্য ভক্ত-সন্ন্যাসী ও মাথায় জ্বলন্ত ধুনোর খোলা নিয়ে ব্রতচারিণীদলের শোভাযাত্রা বেরোয়। কুরমুনের গাজনে সন্ন্যাসীদের মুখে রং মেখে সঙ সেজে ও শ্মশান সন্ন্যাসীদের নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্য লক্ষ্যণীয়; কুরমুনের মেলায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি পুতুলের কলানৈপুণ্যের প্রতিযোগিতা আকর্ষণীয়। কোটালপাড়ার গাজনে মৃত্তিকানির্মিত বিরাট শিবমূর্তির সামনে বলি দেওয়া এবং বলির রক্তে মূর্তিকে স্নান করানো বিশেষ বৈশিষ্ট্যময়।
শিবের গাজন মোটামুটি শিব ওঠা থেকে শুরু হয়ে যায়। চৈত্রমাসের মাঝামাঝি বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে যায় উৎসব। অধিকাংশ শিব মূর্তি বা লিঙ্গ পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। ২৭ বা ২৮শে চৈত্র জাগরণের রাত। ঐ দিন সকালবেলায় রাক্ষস বা রাক্ষসী নাচ দেখার মতো লোকনৃত্য। একক বা দলবেঁধে শিল্পীরা ঢাকের বাজনার তালে তালে এই নাচ প্রদর্শন করে। মুখোশ পরে এই নাচ হয়। ইদানিং কঙ্কাল-নাচও জনপ্রিয় হচ্ছে। সন্ধ্যে থেকে শুরু হয় বোলান গান। নানা ধরনের বোলান-পালার আসর জমে ওঠে। সখি-বোলান, হিজরে-বোলান, সাঁওতালি-বোলান, যাত্রা-বোলান পালা শোনা যায়। সারারাত ধরে এই বোলান শোনা যায়। পরিবেশ হয়ে ওঠে জমজমাট। ভোর থেকে আদি-বোলান বা পরো-বোলানের দল আস। এরা সন্ন্যাসী। একহাতে তলোয়ার অন্যহাতে নরমুণ্ডু। এদের গানের পালা করুণ-রসাত্মক। শেষে দেখা যায় শকুননাচ। পরের দিন দেখা যায় জলসন্ন্যাসী। এইদিন শিবকে স্নান করাতে নিয়ে যায় ভক্তরা। বসে মেলা। অগণিত শিবভক্তরা শিবের দোলযাত্রায় নাচতে আসে। পরেরদিন শিবের নীলপুজো। এই নীলপুজো নিয়ে প্রচলিত রয়েছে এক বিখ্যাত লৌকিক ছড়া —
"নীলপুজোর পরের দিন
শিবের হল সর্দিকাশি।
ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে
জ্যেঠি কাকী মামী মাসী।
তাই শিবের হল সর্দিকাশি...
আদা দিয়ে চা করে,
দুগ্গা এসে সামনে ধরে
'সিদ্ধি আজকে খেও না, বাপু'
বললে শিবে মুচকি হাসি।
শিবের হল সর্দিকাশি..."
এই দিন বাণফোঁড়া। শতাধিকভক্তরা জিভে বাণ ফোঁড়েন। তা দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী ভিড় করেন। কোথাও আবার কোঁকবান ফুঁড়ে ভক্তরা গ্রাম পরিক্রমা করেন। শেষ দিনে থাকে ঝাঁপ বা চড়ক অনুষ্ঠান। চৈত্রের শেষ দিনে চড়ক পুজো শুরু হলেও বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পুজোর উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পুজোর উল্লেখ নেই। এমনকি বৃহদ্ধর্মপুরাণেও চড়কের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের 'বর্ষক্রিয়াকৌমুদী' ও রঘুনন্দনের 'তিথিতত্ত্ব'-এও এই পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় না। উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে নাকি পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। চড়ক পুজো কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি।
কেন এই কৃচ্ছ্রসাধন আর আত্ম-নিপীড়ন? হাতে, কপালে, জিভে, ফুঁড়ে নেওয়া বাণ আর ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে উন্মাদের মতো নাচ, এ তো শরীরের উপর অন্যায় অত্যাচার! কেউ কাউকে বাধ্য করেনা, তবু তা হয় কেন! সামিল হয় অকুতোভয় শিশু থেকে প্রবীণ মানুষ। অন্ত্যজ শ্রেণী থেকেই বাণ ফুঁড়তে এগিয়ে আসে অব্রাহ্মণ শিশু ও পুরুষরা। অনেকেই বাণ ফোঁড়ার দৃশ্যটি দেখতে পারেন না, গা শিউরে ওঠে। বলেন বন্ধ হোক এই নিষ্ঠুর প্রথা। আসলে, গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রনা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। সমুদ্রের বুক থেকে শঙ্খ তুলে আনলেও তার বুকে কান পাতলে যেমন স্রোতের আওয়াজ শোনা যায়, তেমন সভ্যতার হাজারো বিবর্তন ঘটলেও প্রাচীন জনজাতির মন থেকে অতীত সংস্কার এবং বিশ্বাসকে মুছে ফেলা যায় না। বাংলার নীল সন্ন্যাস, গাজন, চড়ক ইত্যাদির মধ্যে আদি অষ্ট্রোলয়েডদের অবশেষ আজও রয়ে গেছে। গাজনে বা বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর পুজোর সঙ্গে জড়িত একটি বিষয় হল 'মাঙ্গন' বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা। একটা কথা পরিস্কার করে বোঝা দরকার – আদিম অধিবাসীদের অনুসৃত প্রথা বা লোকাচার, যা পরবর্তী তান্ত্রিক, শৈব ধর্ম, জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীগন দ্বারা বা আরও পরে হিন্দু ধর্মে কিছু পরিবর্তনসহ গৃহিত হয়েছে। যেমন, 'মাঙ্গন' হলো বনের আদিম অধিবাসীগনের জীবনের শিকার সংগ্রহের একটি প্রথা, তা পরে বৌদ্ধ ধর্মে গৃহীত হয়। যেমন, আদিবাসীগনের মাটির স্তূপ পুজো, যা এখনও সুন্দরবনে করতে দেখা যায় – তা থেকেই বৌদ্ধগন বুদ্ধের প্রতীক স্তূপ পুজো শুরু করেন। বুদ্ধের প্রতীক বিশেষ গাছ পুজোও তাই। জৈন তীর্থংকরদের লাঞ্ছন হিসেবে বিভিন্ন পশু ব্যাবহৃত হয়, তা আসলে বিভিন্ন জনজাতির টোটেম। তাই ক্ষেত্রসমীক্ষা করে জানা যায় যে বিবি মা, মনসা পুজোর মত আদিম সংস্কৃতির ধারা বয়ে চলেছে গাজনেও। এই পুজোগুলিতেও 'মাঙ্গন' করা হয়, এগুলি আদিম সংস্কৃতির প্রবহমান ধারার জীবন্ত দলিল। যাঁরা বলেন, "এ সব বেদ অথবা বৌদ্ধ সংস্কৃতির উৎস"; তাঁরা ভুলে যান ভারতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আদিম অধিবাসীগণ বাস করছেন। তাঁরাই মূলত নিজস্ব সংস্কৃতিসহ আগত বিভিন্ন ধর্মগুলি গ্রহন করেছেন। আদিম প্রথা, আচার, পার্বণ – সব তাঁরা নতুন ধর্মের সঙ্গে সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। আদিম অধিবাসীগণ দল বেঁধে গান বাজনা করতেন, শিকার করতেন, খাওয়া-দাওয়া করতেন; সঙ্ঘবদ্ধতা তাঁদের জীবনের অঙ্গ। বৌদ্ধ ধর্মে সঙ্ঘ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখনও সুন্দরবনের আদিবাসীরা মাটির ছোট স্তূপে ধর্ম পুজো করেন, তা আসলে সূর্য পুজো। পরে যা ধর্মরাজ হিসেবে কূর্ম মূর্তিতে বা মনুষ্য মূর্তিতে পূজিত হচ্ছে। আদি অষ্ট্রোলয়েডদের পুজো বা সংস্কৃতির এই সব ধারা পরে ভূমধ্যাগরীয় ও নর্ডিক আর্য ভাষীদের মিলনে আজকের বাঙালী জাতির সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তার ভিত্তি কিন্তু আদি অ্যষ্ট্রোলয়েডদের সংস্কৃতির মধ্যেই প্রোথিত। কিছু মঙ্গোলীয় ধারাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থান বিশেষে। বাঙ্গালীর ধর্ম, ভাষা, পার্বন প্রথার উৎস খুঁজতে গেলে আদি অষ্ট্রোলয়েডদের বাদ দিয়ে কিছুতেই পূর্ণতা পেতে পারে না।
রাঢ়বঙ্গের শৈব-সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে 'গাজন'। যে শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের ক'দিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পুজো গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা নেই। এতে সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। সেখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা। বর্তমানে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রায় জোড় করে সমগ্র ভারতের প্রতিটি রাজ্যে চাপিয়ে দেওয়ার এক অপচেষ্টা চলছে। নীলপুজো, গাজন, চড়কের মত উৎসব সমূহ পালনের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যে এমন নিজস্বতায় পরিপূর্ণ উৎসব বা সংস্কৃতির অভাব নেই, সেই সকল উৎসব পালনের মাধ্যমে আমাদের দেশের বৈচিত্রময়তা রক্ষা করা প্রকৃত ভারতীয় মানসিকতার নাগরিকদের কর্তব্য হওয়া উচিত।
গ্রন্থসূত্রঃ
১.) ধন্য কলকেতা সহর, কৌশিক মজুমদার, আখরকথা।
২.) কলকাতা, শ্রীপন্থ, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩.) নবদ্বীপ মহিমা, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী, সম্পাদনা : যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ।
৪.) কলিকাতার পুরাতন কাহিনি ও প্রথা, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, ভাষা।
৫.) বাংলার ধর্ম দেবতা ও উৎসব, সম্পাদনা : উত্তম পুরকাইত, দে বুক স্টোর।
==========
সৌভিক দে
সি-৪৬, ব্রহ্মপুর সাউথ
সুবর্ণরেখা অ্যাপার্টমেন্ট
ফ্ল্যাট নং - ১০২
কলকাতা - ৭০০০৯৬
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন