ইয়েতি যদি প্রশ্ন করে, আমাদের উত্তর নেই
-----------------------------------------------------------
সাম্প্রতিক দুটি খবর--- এভারেস্টে আবর্জনা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘায় অভিযাত্রীদের মৃত্যু।
যে কথা দুটির কোনওটাই যে হালক নয়--- তা দুঁদে নেতা মন্ত্রী থেকে সাধারণ ভোটারদেরও জানা কথা। আর ঠিক এখানেই একটা প্রশ্ন রাখা হয়তো যায়, আমাদের অমন মৃত্যু- উপত্যকায় না গেলে কী হয় ?
'অভিযান' শব্দটির আভিধানিক অর্থ, দেশাবিষ্কার বা দেশজয় বা শত্রু দমনের উদ্দেশ্যে সদলবলে যাত্রা অথবা যুদ্ধযাত্রা (সংসদ্ বাংলা অভিধান)। পর্বতাভিযান সে অর্থে দেশ কালের সীমা ছাড়িয়ে বর্তমানে একান্তভাবে ব্যক্তিগত ইচ্ছার। শোনা যায় ৮৮৪৮ মিটার উঁচুতে পৌঁছে অভিযাত্রীরা আধ ঘন্টার মতো সময় সেখানে অবস্থান করেন, পতাকা পুঁতে দেন,ছবি তোলেন এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছবার সাফল্য ও অনুভব নিয়ে ফেরার পথ ধরেন। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর এই সাহসিকতা খুব সহজ নয় । সফল অভিযাত্রীদের বিবরণ থেকে এই যাত্রার দুর্ধর্ষ প্রতিমুহূর্তের মৃত্যু-লড়াই সম্পর্কে জানতে আমাদের বাকি নেই । আমরা জেনেছি বছরে মাত্র কিছু সময় মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে বেস ক্যাম্প থেকে ধাপে ধাপে থিতু হয়ে হয়ে মূল লক্ষ্যে ওঠা যায় । অবশ্য এর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বেস ক্যাম্পে থেকে উপযুক্ত আবহাওয়ার অপেক্ষা করতে হয় । এছাড়াও উপরে ওঠার বিভিন্ন ধাপে বরফ ও উচ্চতা এবং অপরিমীত বাতাসের সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে নিতে হয় । শুরু থেকেই প্রয়োজন পড়ে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণ ।এর পর উপযুক্ত শেরপা ও প্রয়োজনীয় খাবার,ওষুধ,অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ।আর সব শেষে যেটা না বললেই নয় তা হলো, এক এক জন অভিযাত্রী প্রতি পুরো অভিযানের খরচ হিসাবে ভারতীয় টাকায় প্রায় তিরিশ লক্ষের মতো। তবু শৃঙ্গ থেকে বাড়ি ফিরে প্রিয়জনের সামনে হাজির না হওয়া ইস্তক ভরসা শূন্য । তবে এক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভারতীয় হিমালয় অভিযাত্রীদের বাড়ি ফিরে না আসার হার কিছু বেশি । অথচ দুর্ধর্ষ পর্বতারোহণের ঝোঁক প্রতি বছর দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে । ১৯৫৩ সালে এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে যে মানব-বিজয় কেতন উড়িয়ে ছিলেন হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরে, তারই ঐতিহ্য ধরে শুধুমাত্র ২০১৮ সালে এভারেস্টে পৌঁছেছেন ৮০৭ জন। উৎসাহ এবং সংখ্যাটা যেমন তাক লাগানোর, এর ভবিষ্যৎ টা তেমনই প্রশ্নের। কিন্তু এই যে এতো এতো মৃত্যু,নিখোঁজ--- এ কি প্রশ্ন-হীন মান্যতা পেয়ে যাবে ? ছন্দা গায়েন, রাজীব, কুন্তল,বিপ্লব এই নামের তালিকা কেবল দীর্ঘ হতেই থাকবে ? না কি একথা বলার সময় এসেছে---- অমন মৃত্যু উপত্যকায় না গেলে কী হয়!
সাম্প্রতিক কালে প্রতিবেশী দেশ নেপাল প্রায় আড়াই কোটি নেপালি টাকা খরচ করতে চলেছে এভারেস্টের স্বচ্ছতার আর এক অভিযানে। বেসক্যাম্প পর্যন্ত আনুমানিক অভিযাত্রীদের ফেলে আসা আবর্জনার পরিমাণ দশ হাজার কেজি । যার মধ্যে অক্সিজেনের শূন্য কন্টেনার, বিয়ার সহ অন্যান্য পানীয়ের প্লাস্টিক বা ধাতব বোতল,তাঁবু এমনকি মানুষের মল মূত্র রয়েছে । বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন বরফের স্তর ,হিমবাহ এই সব বর্জ্য দ্বারা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি পর্বতের উচ্চ স্তরের বায়ুমণ্ডলও অনেকখানিই দূষিত হয়ে উঠছে । এবং এটা সবচেয়ে ভাবনার কথা, এই বিশাল আকারের আবর্জনা ও তৎসংক্রান্ত দূষণের কারণ কিন্তু একটাই---- পর্বত-অভিযান, অন্য কিছু নয় ।
এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ইয়াংলু আর যত আকর্ষণীয় শৃঙ্গই হাতছানি দিক, আমরা পর্বতের ঠিক কতটা দূর যাবো ? কেন অনেক অনেক উঁচুতে যাবোই ? আসলে দেশ,কাল,সমাজ বা ব্যক্তিগত জীবনে এই উচ্চে আরোহণ ঠিক কতটা দরকারি ? না কি এখানেও মানসিক ভাবে কাজ করে চলেছে একটা আদিম প্রকৃতি-পদানতের সিনড্রোম ? সখ,ইচ্ছা, নেশা যা-ই হোক না কেন, তার কি কোনও পিছন ফেরার পালা থাকতে নেই ? অবশ্য তলে তলে মানুষের এই অদম্য আগ্রহের পূর্ণ প্রফিট তুলতে লেগে আছে কিছু পেশাদার সংস্থাও। নানান প্যাকেজের অভিযাত্রা তারাই নাকি সব অ্যারেঞ্জ করে, যাতে অপেক্ষাকৃত সহজ হয় অভিযান । রয়েছে তাদের উৎসাহব্যঞ্জক বিজ্ঞাপনও। ব্যক্তি-জীবন থেকে পরিবেশ থোড়াই কেয়ার ।প্রতি বছর বেড়েই চলেছে অভিযাত্রীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে । যেন থামার কথা এক্ষেত্রে ঘোরতর অন্যায় ।
ইয়েতি-র সঙ্গে যদি কারও দেখা নাও হয়, তবু সে হয়তো বড়ো বড়ো পায়ের ছাপে এক অজানা সংকেতে পৌরাণিক গল্প থেকে উঠে এসে খোঁজ নিয়ে যাবে, আমাদের পদতলে কতদূর হিমালয় । হয়তো বিরক্ত প্রশ্ন ছুড়ে দেবে, মানুষ তোমার পদতলে আরও কতটা চাই ?
=================================
সুব্রত বিশ্বাস
গ্রাম ও পোস্ট-ধর্মপুকুরিয়া
বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগণা
পিন- ৭৪৩২৩৫