দক্ষ এক
প্রাবন্ধিকের আত্মপ্রকাশ
এক
ব্যতিক্রমী গদ্য ও কবিতার হাত চন্দন মিত্রের। ব্যতিক্রমী মানে ব্যতিক্রমীই। এখন
সব্বাই প্রায় আমরা গদ্য ও কবিতা লিখি; উভয় শাখায় যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে লিখতে না
পারলেও। তো চন্দন মিত্রের হাতে, এমনকি খুব পরিচিত কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক
প্রসঙ্গও যখন কবিতা হিসাবে উঠে আসে তখন আগাগোড়া তা কবিতা হয়েই আসে। তাঁর গদ্যের
সঙ্গে পরিচিত হই আমরা মূলত প্রবন্ধ ও গল্পের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন লেখাজোখার সঙ্গে
যুক্ত থাকলেও, মাত্র ইদানীং প্রায় একইসঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধের
একটি করে বই। মুখ-বইয়ে বাংলার ফুলফল, গাছপালা, মৎস্য, মাটির বাড়ি, মেলা বা অলোকসামান্য,
জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি বিষয়ে সচিত্র বিবরণ সহ তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি
আমাদের অনেকেরই জানা। লোকগানের প্রতিও তাঁর দীর্ঘ আকর্ষণ। আকর্ষণ লোকগানের মাধ্যমে
মনের মাঝে মনের মানুষ খুঁজে-বেড়ানো সহজ সাধকদের প্রতিও। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর
প্রবন্ধের বইটির গুরুত্ব সাধ্য অনুযায়ী বুঝতে চাইব আমরা এখানে।
চন্দন
মিত্রের প্রবন্ধের প্রধান দিক হল সুনির্বাচিত বিষয়ের প্রতি গভীর মনোযোগ ও পরিশ্রমী
যত্নশীলতা। কিংবা 'ট্রিটমেন্ট'। নিজস্ব
বোধ এবং অধীত বিদ্যার আলোকে লিখিত তাঁর প্রবন্ধগুলি পড়লে মনে হয় বড় প্রয়োজন ছিল যেন সেগুলির। তার সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর দৃষ্টিকোণ,
বেশির ভাগ সময়ই যা মুক্তমন ও মানবিকতার আন্তরিক স্বাক্ষরবাহী। এক টানটান ঋজু গদ্যে বিষয়ের অঙ্গীভূত করে নেন তিনি পাঠককে। সবচেয়ে যেটা
বলতে ইচ্ছা করে, সে গদ্য হল লক্ষ্যভেদী। খুচরো ছোটোখাটো যে-কোনো ধরনের রচনাকে
প্রবন্ধ বলে চালিয়ে দেওয়ার একটা চল আছে। প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রায়ই একই অর্থে ব্যবহৃত
হলেও, প্রবন্ধ যখন বলা হবে তখন তা প্রবন্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির বেশির ভাগ পূরণ
করল কি না তা দেখা দরকার। অসম্পূর্ণ ছোটোখাটো রচনাকে – যাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে
মোটামুটি একটা সামগ্রিকতা ফুটে ওঠে না, তাকে নিবন্ধ তবু বলা যায় কিন্তু প্রবন্ধ
বলা সঙ্গত নয় বলেই বিশ্বাস বর্তমান আলোচকের। শ্রী মিত্রের প্রবন্ধে বিষয় অনুযায়ী সচরাচর
চমৎকার একটি সূচনা থাকে, থাকে লক্ষ্যভেদী একটি উপসংহার, আর নানা কোণ দিয়ে বিষয়কে
দেখতে দেখতে মাঝের ক্রমবিস্তার ও গুটিয়ে-আনার পথটি থাকে বিচার-বিশ্লেষণে পূর্ণ।
সেখানে প্রাসঙ্গিক কোনো কিছুকে এড়িয়ে গিয়ে দায় সারার পক্ষপাতী নন তিনি। তথ্য
সহযোগে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলোকিত করে যান সকল দিক খতিয়ে দেখতে দেখতে। প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে পাঠক তাই পেয়ে যান সেই বিষয়ে যেন একটি পূর্ণ চিত্র।
এইখানেই পাঠকের তৃপ্তি। বেঁধে-দেওয়া শব্দগণ্ডি বা এলোমেলো আলোচনার প্রবণতা সহজে
যেখানে পৌঁছাতে অপারগ।
পুস্তকধৃত
দশটি প্রবন্ধের মধ্যে প্রথম দুটি - 'বাহান্নর ভাষা আন্দোলন : পটভূমি ও বিস্তার' এবং 'বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন : প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া' - হল ওপার বাংলা ও এপারে আসামের বরাক
উপত্যকার প্রধান দুই ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে, যাদের সূত্রে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে
দুটি তারিখ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে – একুশে ফেব্রুয়ারি ও উনিশে মে। অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে
প্রেক্ষাপট ও পরিণতি সহ ফুটে উঠেছে দুই ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক চিত্র। অনবদ্য
দুটি লেখা! পড়তে পড়তে বুকের কাছে কখনও কখনও কী যেন একটা দলা পাকিয়ে ওঠে, চোখের কোণ
করে ওঠে চিকিচিক! উপরি হিসাবে যুক্ত হয়ে প্রথম লেখাটিকে আরও মূল্যবান করে তুলেছে
একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব আলম চৌধুরির 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'
(ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি/...), আবদুল গাফফার চৌধুরির অমর 'একুশের গান' (আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/...) এবং আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সিদ্ধান্ত
ও ঘোষণার দলিল দুটি।
সহজিয়া
জীবন ও জগৎ-দর্শন হিসাবে এসেছ 'জেন : রিপুতাড়িত
মানবের নিকট সুসমাচার' ও 'লালনের গান : আমাদের লালিত
সংস্কারের গালে সপাট থাপ্পড়' শীর্ষক প্রবন্ধ দুটি। রহস্যমণ্ডিত জেনদর্শন, জেন
সাধুদের প্রসঙ্গ, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো 'সাতোরি'-লাভ সহ অসাধারণ আকর্ষণীয় কয়েকটি
জেন গল্প – আদতে গল্পের আদলে যা ধর্ম-দর্শন বা আরও কিছু - অনূদিত হয়ে প্রবন্ধটিকে অনন্য
এক মর্যাদায় উন্নীত করেছে। পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন প্রাবন্ধিক : 'প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলি ঈশ্বর-আল্লা-গড বা অন্যান্য দেবদেবী ও
স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বে আস্থাশীল। তাদের যাবতীয় কার্যকলাপের মুখ্য উদ্দেশ্য
মৃত্যুর পরে নরক নামের ভয়ংকর স্থানকে এড়িয়ে স্বর্গ নামের স্ফূর্তিদায়ক
সুরম্যস্থানের মৌরসিপাট্টা হাতানো। কিন্তু জেনবাদীদের কাছে এসব হাস্যকর। তাঁরা
এইসব অতিপবিত্র ও স্পর্শকাতর ধারণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এই নশ্বর জগতের
নির্যাস-সন্ধানে ব্রতী।' লিখেছেন : 'জেন জগতে কিছুই
অনুকরণযোগ্য নয়। জেন অনেকটা প্রণয়ের মতো। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে তবে
অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন। জেন আসলে তীব্রভাবে জীবন-সম্পৃক্ত একটা দর্শন। জেনবাদীরা
এতটাই জীবনবাদী যে জীবনকে সামগ্রিকভাবে অবলোকনের জন্য স্বেচ্ছা দূরত্ব গড়ে নেন।...
আসলে জেন সম্পর্কে যত বলা হয় ততই জটিলতা বাড়ে। এ এক এমন জগৎ যেখানে কোনো বাছবিচার
নেই আবার নিয়মেরও শেষ নেই।' বোঝা যায়, এমনি এমনি এটি পুস্তকের নাম-প্রবন্ধ হয়নি।
তা ছাড়া, এই প্রবন্ধে মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তুলে ধরা ছাড়াও অন্যান্য
প্রবন্ধেও রয়ে গেছে এর ঘ্রাণ। যেমন, মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে লেখাটিতে। নিজ জীবনের
উপলব্ধি থেকে এক অনন্য মানবধর্মে পৌঁছে-যাওয়া, মনের মাঝে মনের মানুষ-অন্বেষক
সহজিয়া সাধক লালনের দর্শন যুগে যুগে মানুষকে পথ দেখাবে। ইহবাদী লোকধর্ম বলাহাড়ি,
লোকায়তিক চার্বাক ইত্যাদি ছুঁয়ে লালনে প্রবেশ করে, ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম বা দেশে
আচার-আচরণের ভিন্নতানির্দেশক লালনগীতিকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে – যাতে বিশদ হয় যে
অনড় অটল কোনো দৈব বিধান নেই দুনিয়াজুড়ে – শেষে প্রাবন্ধিকের আসা এই সিদ্ধান্তের
সঙ্গে সহমত পোষণ না করে আমাদের উপায় থাকে না : 'আসলে
মৌলবাদ জানে তাকে টিকে থাকতে আবং বিকশিত হতে গেলে গ্রামে-গঞ্জে শিকড় চারিয়ে
মানবতাবাদকে আগলে রাখা ললনপন্থাকে সমূলে বিনাশ করতে হবে। কারণ লালনপন্থার যুক্তি ও
জীবনচর্যার কাছে মৌলবাদ অসহায়। এমন লড়াই শহুরে ভদ্র-শিক্ষিতজনেরাও দিতে পারেননি।
কারণ তাঁদের হারানোর অনেক কিছু আছে বিত্ত, সম্ভ্রম, আভিজাত্য, কৌলীন্য, সামাজিক
প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য বিবিধ আর্থিক ও পারমার্থিক সম্পদ। তাই তেমন বেকায়দায় পড়লে
অথবা স্বার্থ বিঘ্নিত হলে তাঁরা যাবতীয় প্রগতিশীল আদর্শকে লাথি মেরে খাঁটি হিন্দু
বা মুসলমান হয়ে উঠতে বিন্দুমাত্র সময় নেন না। এই ভণ্ডামির ছোঁয়াচ থেকে লালনপন্ধীরা
মুক্ত। আসলে ললনপন্থীদের নিজস্ব আদর্শ 'মানবধর্ম' ছাড়া হারাবার কিছুই নেই। আর সেটা
হারিয়ে গেলে তাঁদের অস্তিত্বটাই মিথ্যে হয়ে যায়। তাঁরা হিন্দুও নন, মুসলমানও নন;
তাঁরা দুই প্রতাপশালী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মাঝখানে একটি অকৈতব সাঁকো।'
সাহিত্যতত্ত্বের
দিক দিয়ে জাদু-বাস্তবতা বিশ্লেষিত হয়েছে 'ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু-বাস্তবতা : স্বরূপ সন্ধান' প্রবন্ধে। বিশেষ
সৃষ্টি হিসাবে 'উলঙ্গ রাজার গল্প' ও 'রবীন্দ্রনাথের গোরা ও ভগিনী
নিবেদিতা' প্রবন্ধ দুটিতে উঠে এসেছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর 'উলঙ্গ রাজা' কবিতার প্রেক্ষিতে
আদত 'উলঙ্গ রাজা'র উৎসসন্ধান এবং রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' মিলনান্তক হওয়ার পিছনে
আইরিশ কন্যা ভগিনী নিবেদিতার ভূমিকা। নীরেন্দ্রনাথের কবিতাটিকে প্রেক্ষিতে রেখে
তিনি পৌঁছে গেছেন মূল উৎস ভিলেনার রাজপুত্র জুয়ান ম্যানুয়েল (১২৮২ – ১৩৪৮) এবং তার
থেকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে রূপান্তরিত হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসনে (১৮০৫ –
১৮৭৫)। বাড়তি প্রাপ্তি ম্যানুয়েলের মূল গল্পটির লেখককৃত চমৎকার বাংলা রূপান্তর। জন্মসূত্রে
জাতিতে আইরিশ ও ধর্মে খ্রিস্টান গোরার সঙ্গে একই জাতি ও ধর্মের নিবেদিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকৃত
বিয়োগান্তক 'গোরা'কে পরে মিলনান্তক করার প্রেক্ষাপট বর্ণিত অন্য প্রবন্ধটিতে।
আর আছে
নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ককে শরীরী আশ্লেষে নামিয়ে-আনা
এক প্রাজ্ঞ অধ্যাপক-লেখকের রচিত উদ্দেশ্যমূলক উপন্যাসের ('ছদ্ম গবেষণাধর্মী') বিরুদ্ধে
বলিষ্ঠ এক প্রতিবাদ 'কাদম্বরীর সুইসাইড নোট : নিছক
নামমাহাত্ম্যের বেসাতি' শীর্ষক লেখায়। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার পুরো পটভূমি ও
পরিণতি তুলে ধরে দেখিয়েছেন তিনি, 'চাতুর্যের সঙ্গে নির্মিত' প্রচ্ছদ ও
ব্লার্বসম্বলিত 'অন্তঃসারশূন্য, মলাটসর্বস্ব' একটি বই 'নামমাহাত্ম্যকে সম্বল করে'
কীভাবে 'দিনের পর দিন সংস্করণ-বৈতরণী পার হয়ে চলেছে'। প্রবন্ধশেষে তাঁর অবধারিত
প্রশ্ন, 'এই যে রবীন্দ্রনাথ, কাদম্বরীদেবীকে নিয়ে একটি মনগড়া কাহিনি ফাঁদলেন তিনি
– তার সত্যাসত্য বিচারের ক্ষমতা যাদের নেই তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ বা কাদম্বরীর
কোন রূপ ধরা পড়বে? এর দায়ভার কার? শিল্পীর স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কোনো অর্বাচীন
যশলিপ্সু লেখক যদি ভবিষ্যতে এই সম্পর্ককে আরও কদর্যভাবে পরিবেশন করেন? যদি সেই
কাহিনি নিয়ে সিনেমা হয়?'
শেষে সাহিত্যিক
হিসাবে আলোচনার বৃত্তে উঠে এসেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও মণীন্দ্র গুপ্ত
'সিরাজনামা : প্রাজ্ঞ এক মুসাফিরের আখ্যান' ও
'মণীন্দ্র গুপ্ত (১৯২৬ – ২০১৮) : মহানগরে এক গ্রামবৃদ্ধ'
প্রবন্ধ দুটিতে। একাধারে দুই সাহিত্যিকের উৎসপট,
ব্যক্তিমানস ও সাহিত্যমানস চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে অনতিদীর্ঘ প্রবন্ধ দুটিতে।
ছাপা ও
বাঁধাই চমৎকার! বানান নির্ভুল। প্রচ্ছদ সুন্দর!
*
* * *
* * *
পুস্তক : "জেন : রিপুতাড়িত মানবের নিকট সুসমাচার ও
অন্যান্য প্রবন্ধ"
লেখক : চন্দন মিত্র
প্রকাশক : কলিকাতা লেটারপ্রেস
প্রকাশকাল
: জানুয়ারি ২০১৯
মূল্য : দুশো টাকা