ভাবানুসারে তথা অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা
বেশ কয়েকটা ইংরেজি কবিতার ভাবানুসারে লেখা কবিতা আমি ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছি। তার মধ্যে যেমন অনুবাদ কবিতা আছে তেমনি ভাবন্তরিত কবিতা আছে সেগুলো নিয়ে কিছু কথা বলার তাগিদ অনুভব করছি।
আমার লেখা ইংরেজি কবিতা ও তার ভাবানুসারে লেখা কবিতাগুলোর অনেকগুলো কালাতির্ন, ধ্রুপদী। স্কুল থেকে কলেজস্তরে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরেও এগুলোর পাঠকপাঠিকার সংখ্যা অগুনতি। অথচ দেখা যায় মূল কবিতাগুলো বিদেশি ভাষায় পাঠক পাঠিকাদের কাছে অনেক সময় সহজে বোধগম্য হয় না । ইংরেজি শব্দগুলোর সঠিক প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। অনেক শব্দ কবিতায় চলতি অর্থে ব্যবহৃত হয় না। পুরো লেখাটা ধরে তার অর্থ বুঝে নিতে হয়। আমরা যারা অনুবাদ করি তারা শব্দ ধরে করি না । ভাবটা ধরে অনুবাদ করতে হয় । ভাবটাকে ধরে রাখার জন্য সঠিক শব্দ চয়ন জরুরি । শিক্ষাথীরা তাই মাতৃভাষায় ভাবানুসারে লেখা কবিতাটা যদি পড়ে নেয় তবে মূল কবিতাটা সহজে বুঝতে পারে। কবিতা বুঝতে হয় তার ভাব দিয়ে। শব্দের আভিধানিক অর্থ দিয়ে সেটাকে উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় না। সেই অর্থে বাংলায় লেখা এই কবিতাগুলো ঠিক অনুবাদ কবিতা নয় ভাবটা বজায় রেখে যে কবিতা লেখা হয় তাতে লেখকের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। আর এই আত্মস্ত করার প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হয় মাতৃ ভাষায়। তাই মাতৃভাষায় পড়ে পরে ইংরেজিটা সহজে পড়ে নেওয়া যায় কারণ কবিতার ভাবটা মাতৃভাষায় আমাদের শয়নে স্বপনে খেলা করে । তাই আমরা বলি বিদেশী ভাষা শিখতে গেলে তার রস পেতে গেলে মাতৃভাষার চর্চা করতে হয় ।
ভাষান্তরিত তথা অনুবাদ সাহিত্যের একটা বৃহত্তর দিক আছে যেটা নিয়ে দুচারটে কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। আমি সাহিত্যের লোক নই। কোন বিদেশি ভাষায় পন্ডিত নই। তাও যেটা ভাবি সেটা বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছি। এছাড়াও নিজে কিছু কবিতার ভাবান্তরের চেষ্টা করেছি। সেগুলো পরিবেশন করার আগে নিজের কয়েকটা কথা নিজে বলে নিচ্ছি।
কোন কবিতার ভাষান্তর করা হলেও যিনি এটা করেন তাঁর ভাবনাটা নিজের অজান্তে হলেও জুড়ে যায় ভাষান্তরিত কবিতাটিতে কবির ভাবের সঙ্গে। কবিতাটি অন্য মাত্রা পায়। স্বাদটা বদলায়। এখানে যিনি ভাষান্তরিত করেন তাঁর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটা আরও ভালো হতে পারে আবার কারও ভালো নাও লাগতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সাহিত্য সৃষ্টিতে দুটো সংস্কৃতির মধ্যে বিরোধ ও মিলনের মধ্যে দিয়ে এক নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। এক ভাষাভাষীর মানুষ অন্য ভাষাভাষীর মানুষের সঙ্গে মননের দিক থেকে একাত্ম হয়। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ মুখোপধ্যায়ের অনুবাদ ধর্মী তথা ভাষান্তরিত কবিতায় সেটা আমরা পাই। বোধ হয় এটাকেই সংস্কৃতায়ন বলা হয়। ইংরেজিতে একে সিন্থেসিস বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ এমনি একটা অসাধারন কবিতা যেটাতে ইংরেজ কবি কিটসের ‘Ode To A Nightangle’ কবিতার ভাবটি রবীন্দ্রনাথের স্বকীয়তায় প্রস্ফুটিত। মধুসূদনের কবিতার ভান্ডারও এই স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ। নজরুলের কবিতায় উর্দু ভাষার অসাধারণ সমন্বয় ধরা পড়ে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘জেলখানার চিঠি’ তুরস্ক কবি নাজিম হিকমতের কবিতার অসাধারণ ভাষান্তর। আমরা যারা রাজনৈতিক কারণে জেলে ছিলাম তাদের এই কবিতাটা হৃদয় স্পর্শ করে যায়। মনে হয় আলিপুর প্রেসিডেন্সি বা বহরমপুরের কোন জেলে বসে আমাদের কোন কমরেড এই কবিতা লিখে গেছেন। এখানেই অনুবাদ কবিতার তাৎপর্য, সার্থকতা। সাহিত্যের আন্তর্জাতিকরণের মাধ্যম হলো এই ধরণের কবিতা। আন্তর্জাতিকতাবাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি এটা। একে নেহাৎ অনুবাদ কবিতা বলে নকল বলে উপেক্ষা করার একটা প্রবণতা অনেক উন্নাসিক ব্যক্তির মধ্যে আছে। তাঁরা এর মধ্যে লেখকের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দেখেন না। সাহিত্যকে মানবতার মহাসাগরের মোহনায় মিলতে দেখেন না। এটা খুব দুর্ভাগ্যের। এক ধরনের অহং এর পেছনে কাজ করে।
কোন কোন কবিতার ক্ষেত্রে আমি মূল কবিতার ভাবে পরিবর্তন করেছি তবে কবিতার ধরণটা গ্রহণ করেছি। এখানে শুধু ভাষান্তর নয় ভাবান্তরও ঘটেছে। যেমন Composed upon Westminster Bridge (September 3, 1802),নামক William Wordsworth এর কবিতাটা ।
William Wordworth এর ‘Composed Upon West Minister Bridge’ কবিতায় কবি লন্ডন শহরকে এক অবিশ্বাস্য সুন্দর নগর বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর আমলে লন্ডনকে আধুনিক সভ্যতার প্রতীক বলে মনে করা হত। আমি আজ বিপরীতটাই আধুনিক নগর সভ্যতা সম্পর্কে মনে করি। তাই এ ব্যাপারে যে ভাবনাটা আমার ভাবান্তরিত কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে তা কবির ভাবনার অনুরূপ নয় বরং বিপরীত বলা চলে। বিশেষ করে ভারত সহ এশিয়া আফ্রিকার নগর সভ্যতা সম্পর্কে। তাই ভাবনার দিক থেকে মিল পাওয়া যাবে না। তবে ওনার কবিতাটা পড়ে আমি এই কবিতাটা লেখায় উৎসাহ পাই। উনার কবিতার ভাষা ও ধরণটাকে অনুসরণ করে তাই এটাকে উনার লেখার অবলম্বনে বলে উল্লেখ করেছি ঋণ স্বীকারের দায়টা থাকে বলে। একে ঠিক অনুবাদ কবিতা বা ভাব অবলম্বনে কবিতা বলা চলে না। বরং ভাবান্তরিত কবিতা বলে এটাকে উল্লেখ করা যায়। তবে চিন্তা ভাবনার ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের এগিয়ে যাওয়ার দিকটা প্রতিফলিত হয় যে বিষয়টা আমরা আগে আলোচনায় বলেছি।
যে কবিতাগুলো অনুবাদ করেছি তা ইউরোপের সাহিত্যের ইতিহাসে তিনটে সময়কালকে বেষ্টন করে আছে। কিছু কবিতা শিল্পবিপ্লবের আগে রোমান্টিক কবিতার যুগে লেখা। কিছু কবিতা শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে লেখা। শিল্প বিপ্লবের পরের সময়কালকে আধুনিক যুগ বলা হয়।
প্রথম পর্যায়ে শিল্প বিপ্লবকে আধুনিক সভ্যতার জনক বলে দেখিয়ে সেই সময়কালকে প্রগতির সময় বলে কবিতায় তুলে ধরার প্রবণতা দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়কালে সভ্যতার সংকটটা ধরা পরে বিভিন্ন কবির কবিতায়। এছাড়া আছে বর্তমানের আধুনিক কবিতার কালের লেখা কবিতা যাকে অনেকে আধুনিকোত্তর যুগ বলেন। কবিতাগুলো পড়লে তার ধরণ ও বিষয়বস্তুর এই সময়কালের মধ্যে যে বিবর্তন ঘটেছে তা ধরা পড়ে। টেনিসন, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী প্রমুখ প্রথম দুটো যুগের কোন একটার প্রতিনিধিত্ব করেন। এই দুই যুগের কবিতাকে ক্লাসিকাল যুগের কবিতা বলা হয়। এছাড়া আছে কিছু বর্তমানের আধুনিক যুগের কবিতা যাকে আধুনিকোত্তর যুগের কবিতা বলা হয়। যেমন নিকিতা গিল। আর কিছু আছে শিল্প বিপ্লবের পর ও বর্তমান আধুনিক যুগের যুগসন্ধিকালের যুগের কবির কবিতা।
প্রথম পর্যায়ে শিল্প বিপ্লবকে আধুনিক সভ্যতার জনক বলে দেখিয়ে সেই সময়কালকে প্রগতির সময় বলে কবিতায় তুলে ধরার প্রবণতা দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়কালে সভ্যতার সংকটটা ধরা পরে বিভিন্ন কবির কবিতায়। এছাড়া আছে বর্তমানের আধুনিক কবিতার কালের লেখা কবিতা যাকে অনেকে আধুনিকোত্তর যুগ বলেন। কবিতাগুলো পড়লে তার ধরণ ও বিষয়বস্তুর এই সময়কালের মধ্যে যে বিবর্তন ঘটেছে তা ধরা পড়ে। টেনিসন, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী প্রমুখ প্রথম দুটো যুগের কোন একটার প্রতিনিধিত্ব করেন। এই দুই যুগের কবিতাকে ক্লাসিকাল যুগের কবিতা বলা হয়। এছাড়া আছে কিছু বর্তমানের আধুনিক যুগের কবিতা যাকে আধুনিকোত্তর যুগের কবিতা বলা হয়। যেমন নিকিতা গিল। আর কিছু আছে শিল্প বিপ্লবের পর ও বর্তমান আধুনিক যুগের যুগসন্ধিকালের যুগের কবির কবিতা।
ওপরের বক্তব্যের সমর্থনে আমি নিজের দুটো তিনটে কবিতা যা ইংরেজি কবিতার ভাবান্তর তুলে ধরলাম।
ভাবানুবাদ
Ode to the West Wind
BY PERCY BYSSHE SHELLEY
বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলীর লেখা Ode to the West Wind নামক কবিতাটা অবলম্বনে নীচে কবিতাটা লেখা যেটাকে ভাব বজায় রেখে ভাষান্তর বলা চলে। মূল কবিতার ভাবটা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন পুরোনোর আবির্ভাব তিরভাবে জন্মমৃত্যুর সম্পর্কটা কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে। এটা প্রকৃতির জীবনে যেমন মানব সমাজে তেমন শ্বাশ্বত সত্য। ক্ষয় ও লয়ের সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্কটা কবি তুলে ধরেছেন। প্রকৃতির দুর্দমনীয় শক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে এই ক্ষয় লয় ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় এক অসাধারণ কাব্যিক মহিমায়। পশ্চিমা বাতাসকে শক্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
পশ্চিমা বাতাস উৎসর্গ তোমায়
১
হে উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস!
তুমি শরতের নিঃশ্বাস,
দেখা দেও না,
বয়ে চল অবিরাম,
তবু তোমার অশরীরি উপস্থিতি
শিহরণ জাগায় স্নায়ু জগতে আমার।
শীতের প্রাদুর্ভাব, তোমার প্রবাহে
তরু হতে ঝরে পড়ে
বিবর্ণ নিষ্প্রাণ পত্ররাশি
মরণোন্মুখ পাতা বাহার,
পক্ষাঘাতে জীর্ণ
পীত কালচে ফেকাসে লাল,
কোন জাদুকরের জাদুবলে
পলায়ন তার!
বন প্রাঙ্গনে যেন মহামারী,
আকাল আজ জঙ্গল অঙ্গনে।
বায়ু রাজ পশ্চিমা বাতাস,
তুমি তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাও
হিম প্রবাহে
কোন এক অন্ধকার শৈত্য শয্যায়।
খোসা বীজ আশ্রয় নেয়
কুণ্ডুলি পাকিয়ে কোন এক
অন্ধকার কবরে হিমেল গহ্বরে।
তোমার সোহাগিনী বসন্ত ভগিনী,
তার বাঁশির সুর বেজে ওঠে
অদূরে স্বপ্নপুরী এ পৃথ্বীতে,
সে বেণুর সুরে প্রাণসঞ্চার,
রাখাল বালকের মত
তাড়িয়ে নিয়ে চলে ভ্রুনেরে,
বাতাসে নিঃশ্বাস তাদের
জেগে ওঠে সবে কলকল রবে।
হে উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস,
তুমি অশরীরি, শোন তুমি,
তুমি ধ্বংস তুমি সৃষ্টি
রক্ষাকর্তা তুমি।
২
হে পশ্চিমা বাতাস, তোমার আঘাতে
টুকরো টুকরো মেঘ আকাশে ভাসে,
জীর্ণ পাতার মত ঝরতে থাকে,
বাতাস তুফান হয়ে ওঠে
সংঘর্ষ তুফানে মেঘে,
জোট বাঁধে মেঘেরা
কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস,
বাতাসে তুফান আকাশে বজ্রপাত,
বিদ্যুৎ চমকায়,
বর্ষের বিদায় লগ্নে রাতের শেষ বেলায়
তুমি ভয়ঙ্করী, ভেঙে কর সব চুরমার,
তুমি আগমনী গান গাও
নতুনের বার্তা বও,
জানান দাও তুমি,
মেঘ স্বর্গদূত হয়ে নামবে
বর্ষা হয়ে ঝরবে
আকাশ নেমে আসবে দিগন্তে,
সে মিলবে এসে পৃথ্বীর আলিঙ্গনে,
সমুদ্র উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে,
জল সিঞ্চন বৃষ্টি প্রপাতে,
পোহাতি মাটি উর্বর হয়ে উঠবে,
প্রাণ সঞ্চার সবুজে সবুজে
অঙ্কুর মাথা তুলবে আকাশে।
৩
হে উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস!
তুমি জাগাও তারে,
নিটেল স্বচ্ছ ভূমধ্যসাগর
গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে
নিদ্রামগ্ন সমুদ্র বক্ষে,
স্বপ্নে বিভোর সে এক স্বপ্নপুরি মাঝে,
শান্ত উদাসীন সে ঘুমায়
জাগিয়ে তোল তুমি তাকে;
তারই পাশে বাওয়াস উপসাগরে
নির্বাসিত সেই প্রস্তর দ্বীপ,
নিদর্শন ফেলে আসা সে অতীত,
স্বপ্নে দেখে সে
ভগ্নদশা অট্টালিকা গম্বুজ যত
নির্বাসিত তারা সমুদ্র গভীরে
কেঁপে ওঠে ঢেউয়ের তীব্র কম্পনে।
সমুদ্র তলে নীলাভ শৈবাল
মিষ্টি সুবাস ছড়ায় যত পুষ্পরাজ,
বয়সে ভারাক্রান্ত তারা,
তাদের বিদায় বেলা আজ।
হে শক্তিমান পশ্চিমা বাতাস
আটলান্টিকের পথ ধরে তুমি নেচে চল,
তোমায় পথ করে দিতে
আটলান্টিক দ্বিখণ্ডিত হয়
সমুদ্র গহ্বরে ফাটল ধরে,
সে পথে তুমি বাধাহীন দুর্নিবার,
তোমার দুর্বার গতিতে নতজানু সবে।
শেওলায় আচ্ছাদিত
সমুদ্রগর্ভে যত বৃক্ষরাজি
বিবর্ণ জরাজীর্ণ পত্ররাশি তার,
তোমার পরিচিত কন্ঠস্বর
ভয়ঙ্কর বার্তা বয়ে বেড়ায়
ভয়ে কুঁকড়ে মরে তারা,
ধূসর বিবর্ণ তাদের মুখ
আশ্রয় খোঁজে তারা।
হে বন্ধনহীন পশ্চিমী বাতাস
তোমার তান্ডব বার্তা শোনা যায়
ধ্বংসের মাঝে তোমার সৃষ্টি
তুমি শোন আগামীর পদধ্বনি।
৪
যদি আমি বিবর্ণ পাতা
ও: সর্বশক্তিমান পশ্চিমা বাতাস!
বয়ে নিয়ে চল আমায় আমার অন্তে
হলে আমি ত্বরিতগতি মেঘ
ভেসে চলি তোমার ডানায় ডানায়,
যদি আমি সমুদ্রের ঢেউ
দেখ আমার প্রলয় নাচন,
তোমার অঙ্গে অঙ্গে
তোমার হাত ধরে
ভাসি আমি তরঙ্গে তরঙ্গে।
হে বন্ধন হারা মুক্ত বাতাস
তোমার শক্তি শিহরণ জাগায়,
দাও আমায় ক্ষমতা তোমার।
আমি যদি শৈশব ফিরে পাই
তোমার বন্ধু আমি,
তোমার ক্ষমতার ভাগিদার,
তোমার সাথে বিচরণ আকাশে বাতাসে,
পাল্লা দিয়ে চলি গতিকে তোমার।
কিন্তু হায়! জীবনের এই দিনান্তে
অক্ষম আমি, তাই নিবেদন আমার,
হে উন্মাদ বাতাস! তুমি বন্ধু আমার,
সাহস জোগাও, আমাকে জাগাও,
সাঁতার কাটি ঢেউয়ে ঢেউয়ে;
এ নব বসন্তে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়
নতুন পাতায় নব জন্ম আমার
ভেসে চলি মেঘের ডানায় ডানায়।
জীবনের কণ্টক শয্যায় শুয়ে রই,
আঘাতে আঘাতে আমি বিদীর্ণ
আমি রক্তাক্ত, রক্ত ঝরে আমার,
তাও ডরি না আমি ভয়ে।
কিন্তু হায়!
এ জীবন সায়াহ্নে
সময় বয়ে নিয়ে যায় আমাকে
সময়ের ভারে আমি ভারাক্রান্ত,
শৃংখলিত আমি, আমি ন্যুব্জ আজ,
আমি বিবর্ণ ঝরা পাতা;
তবু জেনো আজও অদম্য আমি
আমি তোমায় ভালোবাসি,
হে উন্মাদ বাতাস,
অশরীরী শক্তি তুমি,
তোমার গতি তোমার উদ্যম
অহং আমার, তুমি বন্ধু আমার।
৫
বিদায় ঘণ্টা বাজে শোন ওই,
বাজে ওই শরতের বিদায়ের গান,
শীতের আগমনে আমি ঝরা পাতা
তাই বধ আমায় আজ,
আমি তোমার নিবেদিত প্রাণ
ঝরা পাতার মত আমিও ঝরে যাই।
বিষণ্ণ মধুর বিদায়ের সুর শোনা যায়,
ও আমার অশরীরী নির্মম শক্তি!
আমাকে নিয়ে যাও
বিদায় দাও আমায় আজ।
তোমার অদম্য শক্তি বলে
এই মহাবিশ্বের ওপ্রান্তে
আমার জীর্ণ মৃত ভাবনা,
ঝরা পাতা, উড়িয়ে নাও
ভাসিয়ে নিয়ে যাও তাকে
তোমার গতির শক্তিতে,
বিদায় দাও আমাকে
ত্বরান্বিত হোক নতুনের আগমন,
নতুন তোমায় স্বাগতম।
অগ্নিকুন্ড থেকে ভেসে আসা
ছিন্নভিন্ন অনির্বাপিত ভষ্মরাশি
আমার কথামালা হয়ে
ছড়িয়ে যায় মানুষের মাঝে
বিচ্ছুরিত হয় আমার ওষ্ঠ থেকে
নিদ্রা মগ্ন এ পৃথ্বীতে।
হে বন্ধু, উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস!
আমার এ বিদীর্ণ বক্ষে
ভাবনা জাগাও নব জাগরণের
জেগে উঠুক ঘুমন্ত এ ধরা
ভবিষৎ দ্রষ্টার বার্তা শোনা যায়,
‘শীত আসলে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে,
তার আর আসতে বিলম্ব কোথায়’?
ভাবানুবাদ
Robert Herrick, To Daffodils
সুন্দরী ড্যাফোডিল
রণেশ রায়
সুন্দরী ড্যাফোডিল, ক্ষণজীবী তুমি
ঝরে পড় সময় না হতে
ক্ষণকাল দেখা দিয়ে কাঁদাও আমাদের,
এখনও প্রভাত সূর্য উদয়ের পথে
যৌবন তার এখনও বাকি ঢের-----
অপেক্ষা করো, এখনই যেও না চলে
গোধূলি বেলায় সূর্য যাবে অস্তাচলে
প্রার্থনা ঘন্টা বাজবে তখন
সন্ধ্যাদীপ জ্বলবে যখন,
প্রার্থনা সভায় মিলব মোরা সবে
সভা শেষে সবে যেতে হবে,
এসেছি জীবনে স্বল্পকাল তরে
বসন্ত আসে সময় ধরে
জীবনের বসন্ত শেষে
চলে যেতে হয় অবশেষে।
আমরা বেড়ে উঠি অল্প সময়ে
মিলি এসে সে অন্তিমে
তখন চলে যেতে হয় সবে
ক্ষয় আর লয়ের পথ ধরে,
যেমন দেখি গ্রীষ্মের বৃষ্টি
বা ভোরের শিশির মুক্ত ঝরায়
সে কি অনাবিল সৃষ্টি!
এসে চলে যায়
দেখা যায় না এ জীবনে আর
অপেক্ষায় থাকি
নতুন কলি ফোটে কবে আবার।
কে বসে একা নিরালায়
William Wordsworth এর The Solitary Reaper (1807) কবিতা অবলম্বনে
কে বসে একা, কাকে দেখা যায়
মাঠের মাঝে নিরালায়,
কেউ নেই সাথে তার
সে যে শস্য কন্যা আমার!
সারাদিন পরিশ্রম মাঠে
ধান বোনে ধান কাটে
গান গেয়ে চলে আপন মনে
একলা বসে সে প্রান্তরে বিজনে,
সে গান ভেসে আসে আমার কানে
করুন বিষাদের সুর বেজে ওঠে গানে।
কোকিলও গাইতে পারে না এর চেয়ে মিষ্টি
এমন ভৈরবী কেউ শোনে নি আগে
আরব মরুতে যেন ঝরে সুধাবৃষ্টি,
পথিককে স্বাগত জানায় সে মধুর গানে
কোকিলের গলায় পাবে না এ সুর বসন্তে,
এমন সুরেলা গান শুনেছ কি আগে?
সে সুর ভাসে বাতাসে স্তব্ধতা ভেদ করে
পৌঁছে যায় জনতার মাঝে দূর দুরান্তে।
কেউ বলেনি আমায় সে কি গান গায়
কানে বাজে সে গান বেদনার মূর্ছনায়,
অতীতের কান্না না পাওয়ার হতাশা
জীবন যুদ্ধের কত না কাহিনী
কত না আশা নিরাশা
বেজে ওঠে মধুর সংগীতে,
প্রাত্যহিক জীবনের বারোমাস্যা
ভাষা পায় তার গানের কলিতে,
রোজের সুখ দুঃখ আনন্দ নিরানন্দ
ফিরে আসে সে সংগীতে।
ভাবায় আমাকে, শস্য কন্যা সে যে,
কি ভাবনা বেজে ওঠে দুহিতার গানে
অন্তহীন সে গান বাজে আমার কানে,
আমি তাকে দেখি আমার মননে
কাজের মাঝে সে গেয়ে চলে
ধানের শিরীষে দোলা লাগে,
অচঞ্চল মুগ্ধ আমি গানের সুরে
শ্রবণে আমার সে গান খেলা করে।
পাহাড় ডিঙিয়ে আমি হেঁটে চলি,
সে গান বসে এসে হৃদয় জানালায়
আস্তে আস্তে সে গান বাতাসে মেলায়
সে সুর কোথায় যে হারায়
শুধু রেশটুকু থেকে যায় ভাবনায়,
বাজে না আর সে গান আমার কানে
পথিক আমি, হেঁটে চলি সে কোন অন্তে।
ওপরের কবিতা দুটো পড়লেই বোঝা যাবে কিভাবে লেখকের ভাবনা ভাবান্তরিত কবিটায় যুক্ত হয়েছে। শব্দ চয়ন দেখলে বোঝা যাবে ঠিক আভিধানিক অর্থে শব্দের ব্যবহার হয় নি। এখানে দুটি ভাষার মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটার সুযোগ লেখক নিয়ে থাকেন যা ভাষার দিক থেকে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ ঘটায়। তবে প্রকৃতি ও মানবসমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সার্বজনিক কয়েকটা দিক তুলে ধরা হয়েছে কবিতা দুটোতে। প্রকৃতির আবির্ভাব ও তিরোভাবের অনিবার্যতার কথা বলা হয়েছে প্রথমটায় আর দ্বিতীয়টায় কৃষকপরিবারের একটি খেটে খাওয়া মেয়ের জীবন তুলে ধরা হয়েছে যা পশ্চিম ও পাশ্চাত্যের সব দেশেই শ্রমজীবী মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম। দুই দেশের দুই কবির মননের মধ্যেও অমিল থেকে মিলটাই বেশি ধরা পড়ে।
এবার আসা যাক Composed upon Westminster Bridge, September 3, 1802,নামক William Wadsworth এর কবিতার ভাবান্তরিত কবিতা সম্পর্কে কয়েকটা কথায় ।
William Wordworth এর ‘Composed Upon West Minister Bridge’ কবিতা অবলম্বনে লেখা আমার এই কবিতা। কবি লন্ডন শহরকে এক অবিশ্বাস্য সুন্দর নগর বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর আমলে লন্ডনকে আধুনিক সভ্যতার প্রতীক বলে মনে করা হত। আমি আজ বিপরীতটাই আধুনিক নগর সভ্যতা সম্পর্কে মনে করি। তাই এ ব্যাপারে যে ভাবনাটা আমার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে তা কবির ভাবনার অনুরূপ নয় বরং বিপরীত বলা চলে। বিশেষ করে ভারত সহ এশিয়া আফ্রিকার নগর সভ্যতা সম্পর্কে। তাই ভাবনার দিক থেকে মিল পাওয়া যাবে না। তবে ওনার কবিতাটা পড়ে আমি এই কবিতাটা লেখায় উৎসাহ পাই। তাই উনার লেখার অবলম্বনে বলে উল্লেখ করেছি ঋণ স্বীকারের দায়টা থাকে বলে। একে ঠিক অনুবাদ কবিতা বা ভাব অবলম্বনে কবিতা বলা চলে না। তবে চিন্তা ভাবনার ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের এগিয়ে যাওয়ার দিকটা প্রতিফলিত হয় যে বিষয়টা আমরা আগে আলোচনায় বলেছি।
হে নগর সভ্যতা
রণেশ রায়
হে নগর সভ্যতা! তুমি নিংড়ে নিয়েছ সব,
এ পৃথ্বীর যা কিছু সুন্দর, সৌন্দর্যরাশি,
ঝর্ণার কলকল পাখির কলরব;
বিবেককে দিয়ে বিসর্জন
তাকে করেছ সবহারা,
এ পৃথিবী হারিয়েছে যা ছিল তার,
নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার
কিছুই নেই তার আর।
নগর সভ্যতা সেজে এক কৃত্রিম সজ্জায়
সেই সদাহাস্যমান সূর্যালোক কোথায়?
কোথায় আলোকিত শান্তশুভ্র ভোরের সকাল!
শস্য ক্ষেতের বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়ায়,
আকাশপানে বোবা হয়ে তাকায়,
জাহাজ ইমারত অট্টালিকা,
সব দেখি মজে থাকে
চোখ ধাঁধানো জ্বলজ্বলে কৃত্রিমতায়।
দোলা হীন নীরব বাতাস,
উপত্যকা শিলাভূমি বা গিরি
জঙ্গল সমুদ্র আকাশ
হারিয়েছে বর্ণ গন্ধ রূপ,8
দেখিনি আগে সূর্যের এমন তির্যক দহন,
অনুভবে ছিল না
এমন ভয়ঙ্কর স্তব্ধ নীরবতা,
প্রকৃতির স্তব্ধতা, দহন যন্ত্রনা
নদনদী হারিয়েছে গতি তার
তাও সে বয়ে চলে নির্বিকার।
হে সর্বজ্ঞ সভ্যতা!
দেখ, এক কবর শয্যায়
এ নগরী যেন চির নিদ্রায়
নগরী জুড়ে সর্বত্র নীরবতা হাহাকার।