প্রত্যাখান
সকাল বেলাতেই একচোট হয়ে গেল দুজনের । কণা ঘোষণা করল –মা আসছে। আকাশের চোখে বিদ্রোহ দেখে তাড়া তাড়ি আরো জোর দিয়ে বলল, না না কোনও কথা হবে না আর, মা আসবে ই। আরে বোঝার চেষ্টা কর আকাশ, ললিতা শুক্রবার থেকে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে ।
কি আশ্চর্য কথা, যাব বললেই হল, আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা ভাববে না ! কি চায় কি, আ রে বাবা ললিতার মাস মাইনেটা বাড়িয়ে দাওনা কণা । কোনও লাভ নেই আকাশ । আমি বলিনি ভাবছ ! একটা মেয়েকে দিয়ে যাচ্ছে অবশ্য, কিন্তু নতুন মেয়ে, রান্না জানেনা, সোজা গ্রাম থেকে আসছে ।
কিন্তু তুমি কেন দেখাতে পারবেনা কণা, রান্না, বা বাড়ির কাজ, এ তো তুমি ই দেখাতে পার। তুমি তো জানো আমার যখন তখন তোমার মাকে ডেকে পাঠান ভাল লাগেনা । তুমি তো জানো আমি একলা থেকতে ভাল বাসি ।
কিছু করার নেই আকাশ । বাড়ির সব কাজ দেখাতে হবে, রান্না শেখাতে হবে, সকাল এ বিরজু র জলখাবার াআর স্কুলের টিফিন তৈরি করতে হবে, সব করে আমি অফিস যাব কখন? তারপরে ছুটির পর বিরজু স্কুল থেকে ফিরে একা একা একটা অজানা অচেনা মেয়ের সঙ্গে থাকবে ? এটা আমি ভাবতে ই পারিনা । না কি তুমি বলতে চাইছ যে আমি কাজ কর্ম ছেড়ে তোমার সংসার র তোমার ছেলের দেখা শোনা করি!
অতএব, জামাই এর শত বাধা এবং বিরক্তি অতিক্রম করে শ্রীমতি মায়া রয় চৌধুরি, সুটকেস হাতে এসে উঠলেন, আকাশ আর কণার একটুকরো ফ্ল্যাট বাড়িতে, দক্ষিণ ভারতের ।
শহরে।
দিদু ও দিদু, মালতীর আঁচল ধরে টানা টানি করছে নাতি, কেন তুমি এখুনি চলে যাবে, আরও কিছু দিন কেন থাকছ না দিদু, প্লিইইইস।।
মালতী মায়া ভরে নাতির মুখের দিকে তাকালেন , মিষ্টি এক দেব-শিশু যেন, অভিমান ভরা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে, আদর করে বললেন, আমাকে যেতে হবে সোনা, অনেক কাজ আছে বাড়িতে, তাছাড়া তোমার দাদু একা আছে, তাই তো এবার চলে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরোনা দাদাভাই, আমি তোমাকে ফোন করব রোজ কেমন । নতুন আন্টির সঙ্গে তো তোমার ভাব হয়ে গেছে, তাইনা!
দাদুকে কেন নিয়ে এলে-না তাহলে !
কিছু কাজ ছিল বাবা । এর পরে যখন আসব তখন নিশ্চয় দুজনে ই আসব, সত্যি, সত্যি সত্যি ।
বেশ কিছু দিন এসেছেন মায়া অনেক রকম কাজ । নতুন মেয়েটিকে সব দেখিয়ে দেওয়া । নানা রকম রান্না শেখান, বাঙালি, ডাল , তরকারি, মাছের ঝোল। তবে মেয়েটি খুব চট পটে আর বুদ্ধ্বিমতী । রান্নার হাত ভাল । যদিও বাংলা এক বর্ণ বলতে পারেনা, তামিল মেয়ে খ্রিষ্টান , তবু দুজনে দুরকম ভাষায় বেশ চালিয়ে যাচ্ছেন, তার সব থেকে বড় কারণ নাতি বিরজু, ছোট থেকে দক্ষিণে থেকে, এখানকার ভাষা খুব ভাল জানে ।
মায়া আমার ওষুধ গুলো কোথায় রেখেছি জান ! কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছিনা । কেন যে কিছু মনে রাখতে পারিনা আজকাল । রান্না ঘরের দরজায় বিমানের অসহায় অবস্থা দেখে মায়ার ভিতরটা মমতায় ভরে ওঠে। কতটা পথ জীবনের একসঙ্গে কাটিয়ে ছেন তারা। বিয়ের সময় মায়া ষোলো আর বিমান কুড়ি , বড়দের পুতুল খেলা যেন। এতটা পথ পেড়িয়ে এসে মাঝে মাঝে ই মায়া র বুকে তিরের মতন একটা সম্ভাবনা বিঁধে যায়, কতদিন আর কতদিন একসঙ্গে থাকা । কবে কার রাস্তা মৃত্যুর দরজায় এসে ধাক্কা খাবে। কে বলে ষাট পেরলে জীবনের রঙ মুছে যায়, তখন মানুষ শুধু বাঁচার জন্য বাঁচে ! এর থেকে ভুল কথা আর হয় না, অন্তত মায়ার কাছে । মায়া এখনো ভীষণ ভাবে জীবন উপভোগ করতে চায়, জীবনের নানা অজানা, অচেনা, পথ, সুর, গন্ধ, রূপ তার এখনো দেখা বাকি । বিমান আর মায়া, আরও অনেক দিন এক সুতোয় বাঁধা থাকতে চায় । প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল বিমান কে একলা রেখে এসেছে। কে জানি কেমন আছে, কি করছে। দুর্গা পূজ্কাছে এসে গেছে এখন বাড়িতে অঢেল কাজ । শাশুড়ির সব রকম আচার এখনো মেনে চলে মায়া একা হাতে । সারা বাড়ি পরিষ্কার করতে হবে, রঙ করতে হবে, সবার জন্য উপহার, আরও নানা সুখ কর কাজের কথা মনে এসে যায়, হটাত ই বিরজু এসে হাত ধরে টানা টানি শুরু করে, চল চল দিদু, দেখ এসে বারান্দায় আর একটা দিদা বসে আছে। বিরজু বার বছরের বালক ,সে সব বয়স্কা মহিলা কে দিদাসম্বোধন করে ।
বিরজুর হাত ধরে মায়া বারান্দায় এলেন । মেয়ের একতলার এক চিলতে ছোট্ট বারান্দা, তার সিঁড়ি তে এক বয়স্কা তামিল মহিলা বসে আছেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক, চোখে চশমা, পায়ে চপ্পল, পাশে একটি কাপড়ের পুঁটলি ।
হতভম্ব অবস্থায় বসে আছেন। মায়া কিছু প্রশ্ন করার পরে বুঝলেন মহিলা ইংরাজি বোঝেন না । অগত্যা বিরজু সহায় । জানা গেল মহিলা এক দলিত বিধবা তিরুভাল্লা জেলার বাসিন্দা, দুই ছেলের মা। গ্রামে বড় ছেলের সঙ্গে থাকেন। ছেলের নিজের চারটি ছেলে মেয়ে, সামান্য রোজ গার, তাতে এত গুলি মানুষের অন্ন সংস্থান, ছেলে মেয়ের লেখা পড়া, খুব ই অসুবিধার মধ্যেয় পড়েছিল ছেলে । মাকে তাই কিছু মাসের জন্য ছোট ভাই এর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে । ট্রেনে টিকিট কেটে হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছিল আর বলে ছিল চেন্নাই তে নেমে অপেক্ষা করতে, সেখানে ছোট ভাই এসে নিয়ে যাবে।
সকাল থেকে স্টেশনে অপেক্ষা করে ও যখন ছেলের দেখা মিলল না তখন নিজেই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছেন। ছোটো ছেলে যেযে রোডে একটা খাবার দোকানে কাজ করে ।
দু ছেলের মা, মনে মনে ঠিক ই বুঝেছেন ছেলেরা তাঁকে কাঁধ থেকে বোঝা নামানোর মতন করে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছ । চোখে জল, বুকে কষ্ট তবু ছেলেদের নামে দোষারোপ করলেন না। চুপ চাপ ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রয়েছেন মায়ার দিকে । মায়া বুড়ি-মা কে চা আর বিস্কিট দিয়ে, মেয়ে কে ফোন করলেন। ভয়ানক বিরক্তি সহকারে মেয়ে-জামাই এসে হাজির,
কি আশ্চর্য বলতো, পাড়ায় এত লোক থাকতে তোমার মা-জননী কেই উদ্ধার কর্মে নামতে হল ! তাছাড়া বাঙালি হলে তাও বুঝতাম, যতসব...।তারপর থানায় ফোন করল । কিছুক্ষণের মধ্যেই থানা থেকে ছোট ছেলের খোঁজ পেয়ে থানায় ডেকে পাঠালেন। আকাশ, মায়া ,বিরজু আর বুড়ি-মাকে নিয়ে থানায় গিয়ে দেখে, ইতি মধ্যেই খবর পেয়ে বড় ছেলে ও হাজির, মাথা নিচু করে দু-ছেলে থানার বড় বাবুর কাছে ক্ষমা চাইতে, তিনি বললেন মার কাছে ক্ষমা চাও, আর ভবিষ্যতে যদি মাকে কোনও কষ্ট দিয়েছ তো এত সহজে ছাড় পাবেনা। দুই অনুতপ্ত ছেলে ক্রন্দনরতা মাকে আদর করে ফিরিয়ে নিল ।
বাড়ি ফেরার পরে বিরজু বলে উঠল- আমার মা-বাবা পৃথিবীর সব থেকে ভাল বাবা-মা। কেন রে? তোমরা কখনো দিদা কে এরকম করে রাস্তায় বের করে দেবেনা বল? নানা কখনো ই নয়- ছেলের মাথার উপর দিয়ে বাবা মায়ের চোখাচোখি হয়ে গেল একবার।
মায়ার কলকাতা ফেরার দিন কাছে এসে গেছে , আজ বাদে কাল ফিরবেন । রাতে শুয়ে পড়ে মনে হল বিরজু ঘুমায় নি, কেবল এপাশ ওপাশ করছে । কি হয়েছে রে বিরজু, জেগে আছিস কেন ! আর যায় কোথায় 'হাউ মাউ' করে কেঁদে অস্থির ছেলে । কি হয়েছে বলত আমায় । দিদু তুমি কাল আমাকে তোমার সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যাবে? নিয়ে যেতে পারি কিন্তু তোর মা বাবা কে বলতে হবে তো।
না দিদু কিচ্ছু বলবেনা ওদের, ওরা ভাল নয়, আমি আর এখানে থাকব না।
এবার মায়া উঠে বসে খাটের পাশের আলো জ্বালালেন । কি হয়েছে ?
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিরজু একটা কোঁচকানো কাগজ বাড়িয়ে ধরল।
কাগজ টা সোজা করে মায়া দেখেন সেটি একটি চিঠি, সরকারপুল মানসিক হাসপাতাল, কলকাতা থেকে, আকাশ দাশগুপ্ত কে লেখা চিঠি, জানুয়ারী ২০০১১ প্রায় তিন বছর আগেকার চিঠি,
আমাদের প্রথম চিঠি তারিখ ২৩/০২/২০০৫ নম্বর SK/M/2034 এর পর এটি তৃতীয়
চিঠি। আপনার বাবা শ্রী শ্যামল দাশগুপ্ত (৮৯)অত্যন্ত কঠিন মানসিক অবসাদ গ্রস্ত হয়ার পরে আপনি তাঁকে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করেন । আপনার বাবা এখন নব্বই ভাগ সুস্থ , বাকি জীবন টা পারিবারিক পরিবেশে নিজের মানুষ দের সেবা সুস্রসায় ভাল থাকবেন। আপনাকে আগে ও বলেছি আবার ও বলছি, বাবাকে এখান থেকে নিয়ে জান। গত তিন বছর আপনারা কেউ ওনার সঙ্গে দেখাও করতে আসেন নি। এ ধরনের রোগী মানুষের স্নেহ ভালবাসা ও সান্নিধ্য ভালবাসে আর এটাই আপনার বাবার এখন একমাত্র চিকিৎসা।
দয়া করে নিজের বাবাকে প্রত্যাখ্যান বা ত্যাগ করবেন না, এ রকম ব্যাবহার পেলে এ ধরনের রুগী পুনরায় গভীর হতাশা ও অবসাদে চলে যেতে পারেন ।
আমরা আশা করব এ চিঠি পাবার পরে আর কোনও যোগাযোগ করার দরকার হবে না।
সান্ত্বনা চ্যাটার্জি
এ১৬৬ লেক গার্ডেন্স
কলকাতা ৭০০০৪৫
৯৮৩০৩২২৬০১
--
Santwana Chatterjee