google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re নিবন্ধ ।। জ্যেষ্ঠ মানেই শ্রেষ্ঠ নয় ।। কাকলী দেব - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

নিবন্ধ ।। জ্যেষ্ঠ মানেই শ্রেষ্ঠ নয় ।। কাকলী দেব

জ্যেষ্ঠ মানেই শ্রেষ্ঠ নয়

কাকলী দেব 


আমাদের ছিল জয়েন্ট ফ্যামিলি , বাবার দাদু ফরিদপুরের বসতবাটি বিক্রি করে , দেশভাগের অনেক আগেই এসে বহরমপুরে বড় বাড়ী তৈরী করে ,  সেখানেই থেকে গেছিলেন। তাঁর ছিল  ছয় ছেলে।  তারপর সেই ছয় ছেলে একে একে বিবাহিত হল এবং তাদের সন্তান সন্ততি হল। এরা সবাই একই বাড়ীতে থাকত। তখনকার সময়ে সমাজের এটাই ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যৌথ পরিবার প্রথা ছিল বেশীরভাগ পরিবারেই। 
এর ভাল খারাপ সবরকম দিক ছিল।  আমার বাবা খুব অল্প বয়স থেকেই কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে এবং চাকরী সূত্রেও কলকাতায় থাকত। আমি ছোট বেলা থেকে, কাকা পিসিদের বিয়েতে যেতাম সেই বাড়ীতে। খুব কাছ থেকে যৌথ পরিবারের নানা রকম দিক গুলি দেখার সুযোগ হয়েছে। 
একটা ব্যাপার খুব দেখতাম, যখন আমরা সেখানে প্রথম দিন গিয়ে উপস্থিত হতাম তখন বাড়ীর সমস্ত বয়স্ক মানুষকে আগে প্রনাম করতে হত।  আমার যত ঠাকুমা দাদুরা ছিল সবাইকে প্রনাম করাটা ছিল বাধ্যতামূলক একটা ব্যাপার।  তবে মা আর আমিই করতাম, বাবা একটু দূরে থাকত এসব থেকে। আমার রাশভারী বাবাকে এসব নিয়ে কেউ কিছু বলতনা। বাবার ছোট ভাই বোনরা, মানে যৌথ পরিবারে আমার যত কাকা পিসিরা, তারা সবাই এসে মাকে প্রনাম করত, বাবা প্রণাম নিতনা, বদলে তাদের জড়িয়ে ধরত। 
আবার, বিয়ে টিয়ে মিটে গেলে যেদিন ওখান থেকে চলে আসব আবার আর একপ্রস্হ প্রনামের পালা চলত। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার যত দাদু ঠাকুমা কাকা পিসি দের প্রনাম করতে গিয়ে পিঠ ব্যথা হয়ে যেত। 
বড় হতে হতে আমার বাবা আমাকে প্রায়ই একটা কথা বলত, সেটা হল, "জ্যেষ্ঠ মানেই শ্রেষ্ঠ নয় '।  যখন তখন , শুধু বয়সে বড় হবার কারণে অন্য কে প্রনাম করার এই রীতির অপ্রয়োজনীয়তা বোঝাতে। বাবা বলত, তাকেই প্রনাম করবে যাকে তুমি শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গণ্য করো। তোমার চোখে অন্য মানুষের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা থাকলে,  তাহলেই তুমি সেটা প্রকাশ করার জন্য তাকে প্রনাম কোরো ।
ছোট বেলায় বাবার এসব কথার অর্থ পরিষ্কার হতনা। প্রাপ্ত বয়সে এসে বুঝতে পেরেছি, যখন দেখেছি একটি নিন্দনীয় মানুষকে ও  শুধু বয়সের কারণে প্রণাম করতে হচ্ছে  , সামাজিক প্রথার অঙ্গ হিসেবে। আমাদের সংস্কৃতি শিখিয়েছে সম্পর্ক এবং বয়সকে মান্যতা দিতে , তা সামনের মানুষটি যতই খারাপ হোক না কেন !  একজন মানুষ মিথ্যাচারী ,দূর্নীতিপরায়ণ, লম্পট হওয়া স্বত্বেও শুধু কিছু সময় আগে পৃথিবীতে আসার কারণে , তার থেকে উন্নত মানুষের প্রণাম গ্রহণ করার অধিকারী হচ্ছে। বয়স বাড়লে একজন মানুষের স্বভাবের তো কোনও পরিবর্তন হয়না ! সে অল্প বয়সেও যতটা হিংসুটে বা ঝগরুটে ছিল বেশী বয়সেও তাই থাকে। অন্য মানুষের প্রতি সম্মান আসা উচিত মনের ভেতর থেকে , তা তার স্বভাবের গুণে হতে পারে বা সে কোনও বিশেষ গুণের অধিকারী  বলে হতে পারে, তার আশ্চর্য প্রতিভার কারণে হতে পারে। কিন্তু শুধু ' বয়স ' , সম্মান পাওয়ার মাপকাঠী হতে পারে কিনা , এটা নিয়ে আমরা ভাবিনা।
  নতমস্তক হয়ে অন্য মানুষের পদস্পর্ষ করতে শেখানো হয় একেবারে ছোট বেলার থেকে।বড় হলে, তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় নিতে হবে ,যদিও  জানি সে নিতান্তই খারাপ একজন মানুষ বা যার মধ্যে খারাপ গুণাবলির আধিক্য ! বয়স্ক মানুষকে সম্মান দেখানোর জন্য তাকে সাহচর্য দেওয়া বা তাকে ভালবেসে জড়িয়ে ধরা অনেক বেশী জরুরী। সেখানে প্রনাম করা বাহুল্য মাত্র। 
আমাদের সিলেবাসের শিক্ষা আর সামাজিক সংস্কৃতি প্রশ্ন করতে শেখায় না।  যা কিছু চলে আসছে তাই বিনা বাক্য ব্যায়ে মেনে নিয়ে চলতে বলে। 
হাজার হাজার বছর আগে যে প্রথার সৃষ্টি তা কতটা যুক্তিযুক্ত আজও ? 
শ্রদ্ধা দেখানো আর সত্যিই শ্রদ্ধা করার মধ্যে পার্থক্য আছে।


পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এই রীতি ভারতবর্ষের মত একটি প্রাচীন সভ্যতার তৈরী, কিন্ত কথা হচ্ছে প্রাচীন এই রীতিনীতি গুলির যথার্থতা এই সময়ে ঠিক কতটা ? 

আজকাল আমার মন থেকে না এলে আমি আর শুধু বয়স্ক বলে, তাকে  প্রণাম করি না। 

                                        
                      




 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন