Featured Post
গল্প ।। রঙ বদলায় ।। সুব্রত দত্ত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
রঙ বদলায়
সুব্রত দত্ত
অনিন্দ্যের আজ খুশির দিন। কারণ, IISER-এর জুলজির অধ্যাপক পদের অফার লেটার পেয়েছে। নিউ ইয়ার্স ইভ সেলিব্রেশনের মুহূর্তে সুখবরটা দিয়ে শ্রীপর্ণাকে চমকে দেবে আজ। ক্যাবে উঠে পড়ে সে। কলকাতার সব মানুষেরই গন্তব্য যেন পার্ক স্ট্রিট। দূরে ক্যাব ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে সে ভিড় ঠেলে। এরমধ্যে ফোনটা বেজে ওঠে,
-বলো পর্ণা।
-এত দেরি করছো, তাই আমরা শুরু করে দিয়েছি।
-আজ তোমাকে একটা দারুণ খব...
কেটে দিলো! দেরি দেখে নিশ্চয়ই রেগে গিয়েছে। সে করুক। খবরটা শুনলেই রাগের বদলে খুশি উপচে পড়বে। রেস্তোঁরার ভেতরে ডিশ আর কাচের গ্লাসের জলতরঙ্গের সুর আর খাবারের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। উচ্চ গ্রামে গানের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্যের মেলবন্ধনে চলছে হুল্লোড়। অনিন্দ্য শ্রীপর্ণাকে খুঁজে বেড়ায়। চারিদিকে খুঁজতেই চোখ আটকে যায়। ঐ তো শ্রীপর্ণা! কিন্তু এই অবস্থা কেন? পেছন ফিরে আছে, ওটা সঞ্জীব না? ওকে জড়িয়ে শ্রীপর্ণা চোখ বন্ধ করে নেশায় বুঁদ হয়ে নেচে চলেছে। অনিন্দ্য নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ছিঃ পর্ণা ছিঃ! মুখটা ঘুরিয়ে নেয় সে ঘৃণায়। তারপর ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়।
এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে দেখে মা বাবা অবাক হয়ে যান। মা বলেন,
-এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি? ডিনার সেরে এসেছিস?
-না মা, বাড়িতেই খাবো একটু দেরিতে।
অনিন্দ্য নিজের ঘরে চলে যায়। দশটার দিকে শ্রীপর্ণা ফোনে নেশা জড়ানো গলায় বলে,
-হ্যালো, কি হলো? এলে না কেন?
অনিন্দ্য কোনও উত্তর দেয় না। শ্রীপর্ণাই বলে,
-আজকের এই বিশেষ রাতে তোমাকে ভীষণ মিস করছি ডার্লিং। চলে এসো , আজ আমরা সারা রাত ...
-জাস্ট শাট আপ। তুমি এতদিনের একটা সম্পর্ককে
এভাবে ...
-কিসব বলছো, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
-তাই? আমি দেখে এসেছি তোমার বেলেল্লাপনা, I just hate you. And don't try to contact with me.
-অনি, শোন প্লিজ। তুমি ভুল কর...
অনিন্দ্য ফোন কেটে দেয়। আরো কয়েকবার কল করে শ্রীপর্ণা। অনিন্দ্য রিসিভ করে না।
রোজকার মত আজও তিনজন একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। কিন্তু তাল কেটে যাওয়া কিছু শব্দহীন মুহূর্ত অতিবাহিত হয় মাত্র। মা নীরবতা ভেঙে বলেন,
-তোর কি হয়েছে রে? আজ শ্রীপর্ণার সাথে দেখা হয়েছে তো? চাকরি তো হলো। এবার ওর বাবা মাকে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য আসতে বল।
অনিন্দ্য বলে,
-বিয়ে! ওকে? আর ভাবছি না।
-কেন, কি হলো আবার!
এবার অনিন্দ্য ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে,
-কেন বিরক্ত করছো মা? বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে।
তবে ওকে কখনই নয়।
বাকি খাবার ফেলে অনিন্দ্য উঠে পড়ে। ব্যালকনিতে বসে সিগারেট ধরায়। ফোন বেজে ওঠে। শ্রীপর্ণা! বিতৃষ্ণায় অনিন্দ্য কেটে দেয়। তারপর কল লিস্ট, হোয়াটস্যাপ আর ফেসবুকে শ্রীপর্ণাকে ব্লক করে রাখে। ভাঙা বিশ্বাসকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে চায় না সে। সারা রাত সিগারেটের পর সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়, ঠিক শ্রীপর্ণাকে নিয়ে নতুন জীবন গড়ে তোলার স্বপ্নের মতো।
দিন বয়ে চলে আপন গতিতে। অনিন্দ্য অধ্যাপনায় ব্যস্ত। বাবা মায়ের পছন্দের মেয়ে রণিতাকে বিয়ে করেছে। রণিতা সরকারি কলেজে ইতিহাসে অধ্যাপনা করে। কলেজ সামলে সংসারে ভালোই মানিয়ে নিয়েছে সে। বাবা মা-ও খুব খুশি ফুটফুটে এক নাতনি পেয়ে। পাঁচ বছরের রুমু তার দাদাইয়ের সাথেই স্কুলে যাতায়ত করে।
ইনস্টিটিউটে অনিন্দ্য তিনজন রিসার্চারের মেন্টর। তাদের গবেষণার বিষয় ornithology-এর বিভিন্ন শাখা। ভাস্বতী, অর্চিতা আর সোমদত্তাদের পক্ষী-গবেষণায় field observation প্রয়োজন। তাই স্থান হিসেবে প্রাকৃতিক উপাদানে পরিপূর্ণ উত্তরবঙ্গকেই বেছে নেওয়া হয়। সেকথা মাথায় রেখে Project Title স্থির হয়। ভাস্বতীর Behavior of Birds in North Bengal, অর্চিতার Ecology of Birds in North Bengal এবং সোমদত্তার Causes and Prevention of Bird diseases in North Bengal. অনিন্দ্য Research methodology ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে বলে,
-আচ্ছা, ভারতের একজন বিখ্যাত পক্ষীবিশারদের নাম বলতে পারবে?
অর্চিতা বলে,
-সেলিম আলি স্যার।
-ঠিক। তিনি সর্বকালের সেরা। তাঁকে "ভারতের পক্ষীমানব" বলেও ডাকা হয়। তাহলে আর কিছু জানার আছে?
ভাস্বতী বলে,
-না স্যার, বাকি সব পরে জেনে নেবো।
-বেশ, তাহলে কিছু বই, এনসাইক্লোপিডিয়া, জার্নাল আর রিসার্চ পেপার থেকে তোমরা primary, secondary এবং tertiary source পেয়ে যাবে। আমি সেসবের নামগুলো বলে দেবো। সেগুলোর ডেটা সংগ্রহ করে রাখবে। আর তোমাদের কাজ শুরু করে দাও। প্রয়োজনে আমাকে জিজ্ঞেস করবে। Table work শেষ করে আমরা কিন্তু ফিল্ডে যাবো। তোমরা একটা করে ভালো বাইনোকুলার আর DSLR ক্যামেরা নিতে ভুলবে না কিন্তু! ল্যাপটপ তো থাকছেই।
ওরা তিনজন খুশিতে বলে ওঠে,
-ঠিক আছে স্যার।
অনিন্দ্য মেন্টর হিসেবে তিনজনের কাজের তদারকি করে যায়, যাতে কোনরকম ত্রুটি না থাকে। ডিসেম্বরে উত্তরবঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বন দপ্তর, পরিবেশ দপ্তর এবং পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি জোগাড় করে নেয়। সর্বত্র একজন গাইড অপরিহার্য। অবশেষে ১৬-ই ডিসেম্বর ওরা যাত্রা শুরু করে দার্জিলিং মেইলে।
এনজেপিতে নেমে শিলিগুড়ির এক হোটেলে স্নান আর লাঞ্চ সেরে ওরা যায় ৩০ মিনিটের দূরত্বে শুকনায়। সেখান থেকেই শুরু Mahananda Wildlife Sanctuary. তিস্তা আর মহানন্দা নদীর মধ্যবর্তী বনাঞ্চল। সারাদিন ঘুরে Rufous-necked Hornbill ও আরো কিছু পাখির দেখা মেলা মাত্র ছবিও তুলে রাখে। সূর্য ডোবার আগেই ক্লান্ত শরীরে ওরা হোটেলে ফিরে আসে।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ছোট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে। পথে রংটং-এ পেয়ে যায় Common green magpie, Great barney সহ রঙবেরঙের পাখি। দিনশেষে দার্জিলিং-এর হোটেলে রাত্রি যাপন। তারপর ক'দিন ধরে টাইগার হিল, কার্শিয়াং, পেডং,কালিম্পঙ, লাটপাঞ্চার, লাভা, লোলেগাঁও, ঝাণ্ডি হয়ে ২৯ তারিখে গজলডোবায় আসে ওরা। ইতিমধ্যে Leaf bird, Himalayan wheel thrush, Hunny Bazard, Mohan chura সহ প্রচুর পাখির হদিস পেয়ে গেছে। এসব দেখে ওরা ভীষণ পুলকিত। তবে লাভাতে Black-throated Bushtit-এর ছবি তুলতে গিয়ে ভাস্বতীর পা হড়কে খাঁদে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। অনিন্দ্য না ধরলে পড়েই যেত। সেজন্য ভাস্বতীকে প্রচন্ড বকুনিও খেতে হয়েছে।
গজলডোবায় এই সময়ে প্রচুর পরিযায়ী পাখিদের ভিড়। অনিন্দ্যরা ব্রেকফাস্ট সেরে একটা হোটেল থেকে লাঞ্চের জন্য ভাত, ডাল, সব্জি আর বোরোলি মাছের ঝোল নিয়ে নৌকোয় বেরিয়ে পড়ে "পাখিবিতান অভয়ারণ্য"-এর উদ্দেশ্যে। হোগলা বন পেরিয়ে ওরা বেয়ে চলে তিস্তার জল। পরিযায়ী পাখিদের মেলা বসেছে যেন! Mallard duck (এরা জোড়ে থাকে), River Lapwing এবং সব চেয়ে সুন্দর Northern Lapwing. আর Bar headed geese, Red crested pochard এরকম আরো রকমারি পাখি! ক্লান্ত শরীরে রিসর্টে ফিরে এসে পাখিদের নিয়ে আলোচনা চলছে। এখানে নেটওয়ার্কের ঝামেলা নেই বলে সবাই মনের আনন্দে ফোনেও কথা বলছে। ভাস্বতী হঠাৎ একটু দূরে গিয়ে মাঝে মাঝে অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন কিছু বলছে। অনিন্দ্যের নজর এড়ায় না। সেও রণিতাকে সুন্দর সব জায়গার বৰ্ণনা দিয়ে বলে,
-তোমাকে বললাম, তবু এলে না। এলে আরো ভালো লাগতো।
-না মশাই, তাহলে ঐ তিনটে কচি মেয়ের সান্নিধ্যের আনন্দটাই মাটি হয়ে যেত।
-ধ্যাৎ! এসব বলে আমার মৌতাতটাই নষ্ট করে দিলে!
-ঠিক আছে। শরীর ঠিক রেখে দৌড়ঝাঁপ করবে। ফিরে
এসে ইতিহাসটা বলবে।
-ইতিহাস! মানে?
-আহা, আজ যা ঘটছে, কাল তা-ই তো ইতিহাস হয়ে
যাবে!
-ওঃ, আমাকেও তোমার ইতিহাসের ছাত্র বানিয়ে
দিলে! ঠিক আছে। রুমুকে বলো, শিলিগুড়ির হংকং
মার্কেট থেকে ওর জন্য একটা হাতি কিনে নিয়ে
যাবো। রাখছি, শুভরাত্রি।
পরেরদিন সকালের গন্তব্য গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক। একটা রিসর্টে তিনটে ডবল বেডেড কটেজে ওঠে ওরা। ব্রেকফাস্ট খেয়ে সাফারিতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে। গা ছমছমে রোমাঞ্চে ভাস্বতী, অর্চিতা আর সোমদত্তা রোমাঞ্চিত। শীতের বাতাসে মাতাল করা এক বন্য গন্ধ! হঠাৎ জিপসির গতি কমে যায়। অর্চিতা জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো?
গাইড নিচু স্বরে বলে,
-এইমাত্র হাতির দল এই রাস্তা পার হয়েছে। এটা তারই গন্ধ!
ভাস্বতী অনিন্দ্যের গা ঘেঁষে কাঁধে হাত রেখে বলে,
-স্যার, বড্ড ভয় করছে। এই হুড খোলা গাড়ি থেকে তো আমাদের শুঁড়ে পেঁচিয়ে তুলে নিয়ে যেতে পারে!
-হ্যাঁ, নিতেই পারে। যে নিয়ে যাবে, তার সঙ্গে ঘর করবে! আর এতোই যদি ভয়, তাহলে একাজে এলে কেন?
-জানতাম না স্যার!
গাড়ি এগিয়ে চলে। ময়ূর ময়ূরী দেখে সোমদত্তা বলে,
-ময়ূরী পেখম মেললে দারুণ লাগবে!
অনিন্দ্য ভ্রু কুঁচকে বলে,
-উঁহু, ময়ূরী নয় ময়ূর পেখম মেলে। প্রকৃতি পুরুষকেই বেশি সুন্দর করে সৃষ্টি করেছে। মোরগ, ময়ূর থেকে সিংহ - সবক্ষেত্রেই।
এরপর অদ্ভুত এক পাখির ডাক শুনে গাইড বলে,
-এটা Laughingthrush.
মাথায় সাদা ঝুঁটি, গলা বুক সাদা, পাখনা বাদামি আর লেজটা কালো। খুব সুন্দর! আরো কিছু পাখির দেখা মেলে। উপরি পাওনা হরিণ, বাইসন আর গণ্ডার। রিসর্টে বিকেলে পাখিদের পর্যবেক্ষণ নিয়েই আলোচনা হয়। ভাস্বতী শেষে বলে,
-স্যার, কাল তো আমাদের অবজার্ভেশনের শেষ দিন, মানে ক্যাম্প ফায়ার। বারবিকিউ-এর সাথে রাত বারোটায় নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেশন করা যায় না? প্লিজ স্যার।
বাকি দু'জনেও তার কথায় সায় দেয়। অনিন্দ্য সম্মতি জানাতেই ওরা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।
শেষদিনেও সাফারিতে যায়। সব মিলিয়ে পাঁচশ'র বেশি পাখির ইনফরমেশন জোগাড় করা হয়েছে। তবু ভাস্বতীর বুনো হাতি দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপটা থেকে যায়। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পুরো রিসর্ট আলোকসজ্জায় তৈরি। অনিন্দ্যরা আটটায় হালকা ডিনার সেরে ন'টায় বারবিকিউ-এর প্রস্তুতি নেয়। ওদের একে অপরকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে কিছু বলতে দেখে অনিন্দ্য জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো তোমাদের?
কেউই মুখ খুলছে না। অনিন্দ্য ধমক দিয়ে বলে,
-সারাদিন তো কিচির মিচির করো। এখন চুপ কেন?
ভাস্বতী সাহস করে বলে,
-স্যার, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
-হুঁ, বলো।
-আজকে এক বিশেষ দিন বলে আমরা একটা জিনিস আনিয়েছি। আপনি না বলা পর্যন্ত সেটা বের করতে পারছি না।
-(ধমকে) কি জিনিস সেটা বলবে তো!
-বি...
-বি?
-বিয়ার স্যার!
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অনিন্দ্য বলে,
-আমাকে জিজ্ঞেস না করেই?
ঠোঁট উল্টে ভাস্বতী বলে,
-ঠিক আছে! তাহলে ওগুলো ফেলেই দিই স্যার।
-নাঃ, ফেলতে হবে না। Enjoy this night to make it memorable.
ওরা লাফিয়ে ওঠে। অর্চিতা চেঁচিয়ে বলে,
-চিয়ার্স! "অরণ্যের দিনরাত্রি"!
অনিন্দ্যকেও সঙ্গ দিতে হয়। মেয়েদের এমনিতেই ঠান্ডা কম অনুভূত হয়। তার ওপর সামনে আগুন জ্বলছে। গরম কাপড় খুলে ফেলেছে ওরা। বিয়ারেও একটু নেশা লাগে বটে। হঠাৎ বাজির শব্দ শোনা যায়। নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের অঙ্গ হবে হয়তো! কিন্তু মশাল জ্বালিয়ে কয়েকজন দৌড়ে এদিকেই আসছে! ওরা চিৎকার করছে,
-ভাগো ভাগো, মহাকাল আয়া।
হাতির ডাক! হতভম্ভ অনিন্দ্য চিৎকার করে বলে,
-পালাও, যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দাও।
দরজা বন্ধ করার আগেই ভাস্বতী অনিন্দ্যের ঘরে ঢুকে পড়ে। অনিন্দ্য বলে,
-তুমি এখানে কেন?
-স্যার হাতি!
বলেই ভাস্বতী অনিন্দ্যকে জড়িয়ে ধরে। অনিন্দ্য তাকে ছাড়াতে চায়। সে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে। অনিন্দ্য কোনমতে দরজা বন্ধ করে বলে,
-কি করছো এসব! হাতি তো ঘরে ঢোকেনি। ছাড়ো আমাকে।
চুপ করে বসো।
অনিন্দ্য বিছানায় বসিয়ে দেয় ভাস্বতীকে। ভাস্বতী তাকে টেনে শুইয়ে দেয়। শরীরী সাহচর্য আর নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় অনিন্দ্যও নিজেকে হারিয়ে শেষে আত্মসমর্পণ করে।
ভাস্বতী চলে গেছে তার নিজের ঘরে। অনিন্দ্য একা অনুশোচনায় বিদ্ধ হতে থাকে। রণিতার সামনে দাঁড়াবে কোন মুখে! ছিঃ! সামান্য এক মুহূর্তের ভুলে নিজেকে এভাবে পাঁকে নিমজ্জিত করলো সে? এই ভুল শোধরানোর কোনো পথ নেই যে! ভাবনার জগতে ডুবে যায় সে। না, আছে। উপায় আছে। খুন অথবা আত্মহত্যা। কলকাতায় ফিরে যা করার করতে হবে।
পদাতিক এক্সপ্রেসে অনিন্দ্য সারারাত ছটফট করেছে। বর্ধমান পেরিয়ে সে আপার বার্থ থেকে নেমে দরজার দিকে এগোয়। অচেনা নম্বর থেকে কল আসে,
-হ্যালো, কে?
-গুড মর্নিং, হ্যাপি নিউ ইয়ার! বন্য মধুচন্দ্রিমা কেমন
লাগলো?
-কে বলছেন?
-বিশুদ্ধ গঙ্গাজল হয়ে ন'বছর আগে নিউ ইয়ার্স ইভে ফেলে
দেওয়া পাঁক-কে চিনতে পারছো না?
-শ্রীপর্ণা, তুমি!
-হ্যাঁ গো চরিত্রবান পুরুষ।
-তার মানে, ভাস্বতীকে ...
-হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো। তোমার বউয়ের ফোন নাম্বারও
জোগাড় করেছি।
-প্লিজ পর্ণা, শোনো...
-হাঃ হাঃ হাঃ! ধীরে বৎস ধীরে। ক্রমশঃ প্রকাশ্য। বাই।
শ্রীপর্ণা ফোন কেটে দেয়। ভাস্বতী সবই লক্ষ্য করছিলো। ট্রেন নয়, অনিন্দ্যের গড়ে তোলা নিজস্ব পৃথিবীটা যেন দুলে ওঠে! সে টলতে টলতে গিয়ে দরজার হ্যান্ডল ধরে দাঁড়ায়। এই ঠাণ্ডাতেও ঘামে ভিজে যায় শরীর। নিচে তাকিয়ে দেখে, রেললাইনের ধারের পাথরগুলো নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অনিন্দ্য কি করবে? সব প্রশ্নচিহ্ন মুছে দিতে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেবে? নাকি অন্য কোনো পথ? অনিন্দ্য ভাবছে ...। তাকে বেরোতে দেখে ভাস্বতীও এসির দরজা খুলে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-স্যার ...
একরাশ বিরক্তিতে অনিন্দ্য ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
-চুপ, একদম চুপ করে থাকো। তোমার মত এমন বেঈমান জীবনেও দেখি নি। শ্রীপর্ণা তো সব পরিষ্কার করে দিল!
-স্যার, প্লিজ একটু শুনুন। পর্ণাদি আমার পিসতুতো দিদি। আপনার সাথে ফিল্ড ওয়ার্কে যাচ্ছি শুনে, আপনাকে আমার প্রেমে ঘায়েল করার চ্যালেঞ্জ জানায়। আমিও চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করি। তবে কাল রাতের সব ঘটনা বলিনি। শুধু বলেছি, হাতির ভয়ে আপনার ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি আপনাকে সত্যিই ...
অনিন্দ্য উত্তেজনায় কাঁপছে। সে বলে,
-তুমি তো জানো আমি বিবাহিত। তাহলে এমনটা করলে কেন?
-ভালোবাসি।
-অসম্ভব! এটা হয় না।
-কেন হবে না স্যার। আপনার আশেপাশে এমন অনেক
সম্পর্ক আছে।
-থাকতেই পারে। কিন্তু আমি পারবো না। তুমি দাঁড়িয়ে কেন
এখনো? Go to hell!
-স্যার প্লিজ, বুঝতে চেষ্টা করুন বিষয়টা। কেউ জানবে না।
-আমার মন? সেও জানবে না? তাছাড়া রণিতার সামনে
দাঁড়াবো কিভাবে?
ভাস্বতী অনিন্দ্যের দিকে এগোতেই অনিন্দ্য বলে,
-একদম এগোবে না বলছি!
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে,
-পারবে আমার সাথে এই চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিতে?
পারবে?
-স্যার! এমন কথা বলবেন না স্যার! আমি কিন্তু সত্যিই
আপনাকে ...
-Stop, don't try to convince me. You are also a slut
like Sreeporna.
-No sir, no. I ...
-Bye
ট্রেনটা লাইন বদল করার সময় সশব্দে একটা ঝাঁকুনি দিতেই অনিন্দ্য ঝাঁপ দেয় নিচে। একটা মানুষের আর্তচিৎকার মিশে যায় রেলগাড়ির জান্তব শব্দের ভিড়ে। ভাস্বতী চোখ ঢেকে চিৎকার করে ওঠে,
-স্যার!
হতবাক সে! চোখের সামনে এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি ভাস্বতী।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন