চিরবিদায় নাট্যকার অভিনেতা মনোজ মিত্র
শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্য জনিত কারণে অবশেষে বাংলা নাট্য ও চলচ্চিত্র জগত থেকে চির বিদায় নিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা ও নাট্যকার মনোজ মিত্র মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। স্কুল জীবনে তার বাঞ্ছারামের বাগান ও শত্রু সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই সময়ই মনোজ মিত্র হয়ে উঠেছিলেন তার ক্ষুরধার অভিনয় শৈলীতে এক প্রথিতযশা অভিনেতা। বাংলা নাট্য জগত থেকে সিনেমা জগত সর্বত্রই যেন এক নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছিল মনোজ মিত্রের অর্ণনীয় অভিনয়ে।যেকোনো চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম্য করে মঞ্চ ও সেলুলয়েডের পর্দায় যেভাবে অভিনয়শৈলীকে দর্শকের সম্মুখে উপস্থাপিত করেছিলেন তা এক কথায় অনবদ্য। একদিকে শিক্ষক নাট্যকার নাট্য অভিনেতা এবং তার পাশাপাশি চলচ্চিত্র অভিনেতা- সর্বত্রই তিনি ছিলেন সাবলীল।মনোজ মিত্রের জন্ম উচ্চ বাংলার সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহর গ্রামে। ১৯৫৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতক হন তিনি। এই কলেজে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন নাট্য জগতের বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তদের। যাদের সাহচর্য মনোজ মিত্রের জীবনকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছিল।পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন মনোজ। গবেষণাও শুরু করেছিলেন।১৯৫৭ সালে নাটকে অভিনয় শুরু মনোজের। ১৯৭৯ সালে তিনি সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিষয়েও শিক্ষকতা করেছিলেন। বরাবরই তার মধ্যে নাটক সম্বন্ধে চরম ভালোলাগা ও উন্মাদনা ছিল। সেই অন্তস্থ ভাবনার পরিপূর্ণতা বহিঃপ্রকাশে রচনা করেন প্রথম নাটক 'মৃত্যুর চোখে জল' ১৯৫৯ সালে। তদুপরি ১৯৭২-এ 'চাক ভাঙা মধু' নাটকের মাধ্যমে তাঁর খ্যাতি এবং পরিচিতি বাড়ে। এই নাটকের মধ্যে দিয়েই তিনি রাতারাতি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছান আপামর নাট্য অনুরাগীদের মননে। এরপরে অভিনয় করেন অবসন্ন প্রজাপতি', 'নীলা', 'মৃত্যুর চোখে জল', 'সিংহদ্বার', 'ফেরা'-র মতো একাধিক দর্শক সমাদৃত নাটকে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলা নাটক ও মঞ্চকে দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তাদের মননকে আকৃষ্ট করতে নাটক ও মঞ্চের সঙ্গে তাদেরকে জুড়তে মনোজ মিত্র অভিনয়টা করেছিলেন দরদ ও ভালোবাসা দিয়ে। শম্ভু মিত্র উৎপল দত্তের পর তিনি বাংলা নাট্য জগতের হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার ও অভিনেতা। নাট্য জগতের পাশাপাশি বাংলা সিনেমার দুনিয়াতেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, শক্তি সামন্ত, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকদের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন। খলনায়ক হিসাবেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল।নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেও দর্শকদের শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অভিনীত বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল 'বাঞ্ছারামের বাগান', 'শত্রু', 'তিন মূর্তি', গণশত্রু, ঘরে বাইরে'দামু' প্রমুখ। বহু দিন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে পড়িয়েছেন। ২০০৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।মনোজ মিত্রের মৃত্যু বাংলা সংস্কৃতি, থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জগতের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। তাঁর অভূতপূর্ব অবদান আজীবন স্মরণীয় থাকবে। শিল্পীর মৃত্যু হলেও শিল্প অমর ও অক্ষত ঠিক সেভাবেই মনোজ মিত্র তার মনন শীল প্রাণ জুড়ানো অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার দৌলতে বাঙালি দর্শকদের মনি কোঠায় রয়ে যাবেন। বাংলা নাট্য জগত ও চলচ্চিত্রে মনোজ মিত্রের নাম থেকে যাবে তার নাটক জীবন দর্শন ও অভিনয় সত্তা নিয়ে চলতে থাকবে বাঙালি দর্শকদের মধ্যে চর্চা আলোচনা ও গবেষণা।
রচনা -পাভেল আমান- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন