সাতশো পাহাড়ের দেশ
পশ্চিম সিংভূম জেলায় সারান্ডার জঙ্গলে অবস্থিত সাতশো পাহাড়ের দেশ থলকাবাদ। প্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের থেকে রাজনৈতিক গুরুত্বে যার পরিচিতি অনেক বেশি। এই গহন বনানীর অলিন্দের অন্দরে কান পাতলে আজও শোনা যায় সেই মুছে যাওয়া গুলি ,বারুদের আওয়াজ। শাল, শিমূল, কেন্দু গাছেরা সেই সব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা ফিসফিসিয়ে শোনাতে চায়। ২০০৩ সালে ফিলিপ ফরেস্ট রেস্ট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার আতঙ্ক, ২০১৩ সালে অপারেশন অ্যানাকন্ডার ভয়ার্তক স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে এ জঙ্গল। যে সংগ্রামে মারা গেছে অগণিত মাওবাদী , আর অসংখ্য সি আর পি.এফ জওয়ান ও তাদের বেশ কিছু অফিসার। ছিটকে আসা তাজা রক্তমাখা পাতারা ঝরে গেলেও সেই রক্তক্ষরণের বিস্মৃত স্মৃতি নিয়ে আজও বয়ে চলেছে পাহাড়ী ঝরনা তার রক্ত বর্ণের জলস্রোতে।
এখানে প্রকৃতি তার অপার নিগুঢ় রহস্যজালের মধ্যেই নিজের সৌন্দর্যের ঝাঁপি দুহাতে উজাড় করে রেখেছে। বাংলার প্রান্ত সীমা ছাড়িয়ে রুক্ষ ছোটনাগপুরের মালভূমির লাল মাটিতে ছোট বড় টিলার মত পাহাড় টপকে একে একে টাটা নগর, চাইবাসা, নোয়ামুন্ডি পেড়িয়ে বড়জামদা। সেখান থেকে SAIL এর বিনা পয়সার বাসে সোজা কিরিবুরু মাইনস্। সেখান থেকে নিজ ব্যবস্থায় সারান্ডার জঙ্গলের একদম ভিতরে থলকাবাদ। কিরিবুরু থেকে থলকাবাদ এই ৩৫ কিমি. কোন পাবলিক ট্রান্সপোট নেই তাই ওখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা আগে থেকে নিজেকেই করতে হবে। ফরেস্ট অফিসারকে আগে থেকে বলে রাখলে কিরিবুরু ফরেস্ট রেস্ট হাউস থেকে থলকাবাদে ঢোকার ও থাকার পারমিটের কাগজ বানিয়ে দেন । থলকাবাদ রেস্ট হাউসে রান্নাঘর ও কেয়ারটেকার থাকলেও ক্যান্টিনের কোন ব্যবস্থা নেই অতএব জঙ্গলের বুনো গন্ধ হৃদয়ের মেখে সীমাহীন নিঃস্তব্দতার মাঝে দুদণ্ড সময় কাটাতে চাইলে আগে প্রয়োজনীয় রেশন কিরিবুরু থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। সভ্য জগতের থেকে অনেক দূরে জঙ্গলের একদম ভিতরে ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় জেনারেটর চালাবার জন্য ডিজেলও সঙ্গে নিতে হবে।এটা ভুলে গেলে চলবে না।
সারান্ডার পথে এই কিরিবুরু আর মেঘাতিবুরু অতিক্রম করতে করতে লাল মোরামে বিছানো রাস্তায় গাঢ় সবুজের সমারোহ যেন চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে একটাই ছবি, ধোঁয়াশা মাখা সাতশো পাহাড় ও তাদের গায়ে চাপানো কেন্দু, পলাশ ও শালের জঙ্গল। আরো কিছুটা পথ পেরিয়ে এলে চমক লাগে ! যেন মনে হয় কারা যেন আস্ত একটা কলকাতা শহরকে ধাপে ধাপে খুঁড়ে ফেলেছে। রাস্তার ধার থেকে নিচে লাল ধুলো মাখা মাইনস্ এর লোক গুলোকে যেন পিঁপড়ের মতো দেখতে লাগে আর মেশিনপত্র গুলোকে দেশলাই এর বাক্সের মত । পশ্চিম দিক থেকে আসা সূর্যের আলো মাইনস্ এর উপর পড়ে যেন তাকে জমাট বাঁধা রক্তের খনি বলে ভ্রম হয়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাইনস্ এর বিশাল বিশাল মেশিন এর পাশ কাটিয়ে গাড়ি সারান্ডার জঙ্গলের একদম গভীরে প্রবেশ করে।
বন পাহাড়ের এই মায়াবী পথ ভীষন কূহকিনী। জমাট বাধা প্রায়ান্ধকারে গাছের ডাল যেন দুহাতে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে এসে গলাটিপে ধরতে চায়। কখনো কখনো তার শাখা প্রশাখা অযাচিত ভাবে গাড়ির শরীরে হাত বুলিয়ে ধাক্কা দেয়। মনে একটা ভয় জাগানো শিহরণ জাগে। জঙ্গলের একদম গভীরে এসে পৌঁছালে একটা বুনো গন্ধ নাকে ঝাঁঝ লাগে। এ গন্ধ ঠিক মিষ্টি নয়, এ গন্ধের সঙ্গে মিশে রয়েছে আদিমতা, বন্যতা, গা শিরশির করা একটা জোলো ভাব। তাই এ জঙ্গলকে ভয় পাওয়া যতটা সহজ ভালোবাসা ততটা সহজ নয়। কখনো রাস্তা এসে পড়ছে টিলার খাঁজে। কোথাও বা পাহাড়ী ঝোরার রক্তাভ রূপ যেন রাস্তাকে সঙ্গ দিচ্ছে।
জঙ্গলে সন্ধ্যের অন্ধকার ছেয়ে গেলে থলকাবাদ রেস্ট হাউসের মূল ফটকের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায় । জঙ্গলের ভিতরে কয়েক বিঘা পাথুরে জমিতে বেশি কিছুটা উপরে এই থলকাবাদ রেস্ট হাউস। চারদিকটা প্রায় দশফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ১৯৬২ সালে জন ফিলিপ সাহেব এই রেস্ট হাউস তৈরি করেন। ২০০৩ সালে মাওবাদী আক্রমণে সমস্ত রেস্ট হাউসটা ভষ্মিভূত হয়ে যায়। ২০১৬ সালে সরকার আবার তাকে পুনঃনির্মাণ করেন। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে বনদপ্তর যেন একটা আস্ত তিন তারা হোটেল সাজিয়ে রেখেছে।। সাধারণ পর্যটকরা তো এ পথে বিশেষ পা মাড়ান না। তবে কাদের জন্য এত সুখ বৈভব কাদের জন্য কে জানে ! এখানে সামনেই খোলা বারান্দা। চারিপাশে অন্ধকার বনানীর অপার নির্জনতা আর রহস্যময়ী রাত্রির মায়াবী হাতছানি। মাথার উপর সপ্তর্ষিমন্ডলের সাতঋষি জ্বলজ্বল করে নিচের ঘুমন্ত পৃথিবীতে রাতের মায়া ভরা উষ্ণতা ছড়াতে ব্যাস্ত। শেষ পূর্ণিমার ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোতে ভেসে যাচ্ছে গভীর জঙ্গলের বন্ পথ, দূরের সাতশো পাহাড়ের উপত্যাকা। চাঁদের আলোয় চাল ধোয়া রঙের চাদর দিয়ে সুবৃহৎ নিঝুম বনানি তার পশুপাখী,ঝর্ণা ,নদী সকলকে হৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছে। অন্ধকারে নিস্তব্ধ পৃথিবী ও হিমেল রাত্রি পরস্পরের কাছাকাছি এসে কি যে কানাকানি করছে। সকালের ভয়ার্ত বন যেন রাতের অন্ধকার স্নেহময়ী মা। গভীর বনের পাতায় পাতায় তাদের অব্যক্ত হৃদয়ের গভীরে যে অর্থহীন ভাষা লুকিয়ে রয়েছে তাকে বুঝতে হলে একবার আসতেই হবে এখানে।
খুব ভোরে রাতের অন্ধকার কেটে গেলে শিশিরে সিক্ত বনবীথি যেন নতুন করে সেজে ওঠে। গাছের শাখায় শাখায় পাখিদের প্রভাতী সুররের মূর্ছনায় জঙ্গল আবার জাগে ওঠে। এখানে কোনো ফরেস্ট সাফারি হয় না। তাই গা ছমছমে গভীর এই জঙ্গলের বুকচিরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে হবে ৫ কিমি দূরে লেগেত্রা ফলস্ দেখতে। দুপুরে ৫ কিমি দূরে পয়োব ফলস। বন পাহাড়ির এ পথে কোনো সাধারণ গাড়ি না যাওয়াতে ওখানে যেতে হবে সেই পায়ে হেঁটে বা ট্রাক্টরে।
কিভাবে যাবেনঃ
সকাল ৬ টা বেজে ৫ মিনিটের হাওড়া বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে বেলা ১২ টা থেকে সাড়ে ১২ টার মধ্যে বড়জামদা স্টেশন।সেখান থেকে থেকে ৩ মিনিট হেঁটে শইল্ এর বিনা পয়সার বাসে কিরিবুরু। কিরিবুরু পৌঁছে ড্রাইভার রামচন্দ্র বাবুর সাথে যোগাযোগ করে সেখান থেকে সোজা থলকাবাদ রেস্ট হাউস। যাওয়ার আগেই কথা সেরে রাখুন ওনার সাথে (ফোন নম্বরঃ ৭৫০৪৪৪৮৩৫৯ খরচ ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা ) ফেরার জন্য তাকেই আগাম বলে রাখুন।
কোথায় থাকবেনঃ
থলকাবাদ যাওয়ার আগে ছাইবাসার DFO সাহেবকে ১ মাস আগে থেকে ফোন করুন। ফোন নম্বর হল- ৯০০৬৭৭৩১৬৫। ভাবেই DFO ছাড়া কারোর সাথে যোগাযোগ করবেন না। প্রত্যকের সচিত্র পরিচয়পত্র সাথে রাখুন বেশ কিছু ফটোকপি। বিভিন্ন CRPF ক্যাম্পে দেখেও জমা করতে হতে পারে।
কিরিবুরু থেকে আপনার সকল বাজার ও ডিজেল তুলে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ড্রাইভার রামচন্দ্রের সহায়তা নিতে পারেন।
======================