দাঁইহাটের রাস উৎসব
অসিত কুমার পাল
আমি চাকরিসূত্রে প্রায় এক যুগ সময় বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত খুব ছোট একটা শহরে কাটিয়েছিলাম । ব্যান্ডেল আজিমগঞ্জ রেল পথের ধারে অবস্থিত এই শহরটির নাম দাঁইহাট , যেটা নাকি এই রাজ্যের দ্বিতীয় প্রাচীনতম পুরসভা । ভাগীরথী নদী তীরে অবস্থিত দাঁইহাট শহরকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে তার রাস উৎসব । আমরা অনেকেই জানি কোচবিহার , নবদ্বীপ এবং শান্তিপুরে রাস উৎসব খুবই বিখ্যাত , কিন্তু জাঁকজমক ও স্থানীয় মানুষের উৎসাহের দিক থেকে বিচার করলে তাদের থেকে কোনও অংশেই কম নয় ছোট এই শহরের রাসযাত্রা ।
দাঁইহাটে বেশ কয়েকটি দুর্গা পূজা হলেও সেটার আকর্ষণ তত বেশি নয় , কারন দাঁইহাটের প্রধান আকর্ষণ হল রাস উৎসব । দুর্গাপূজার পরেপরেই শহরবাসী রাস উৎসবের প্রস্তুতি শুরু করে দেয় । প্রতি বছরে অগ্রহায়ণ মাসে রাসপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে দাঁইহাটের এই শহরের অলিগলিতে অন্তঃত পঞ্চাশটি পূজা অনুষ্ঠিত হয় । আশপাশের এলাকা থেকে আগত লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহনে দু দিনের এই উৎসবটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে । চন্দননগরের শিল্পীদের দিয়ে পূজা প্যান্ডেলগুলির আলোকসজ্জা করা হয় । রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলাকে উপলক্ষ্য করে এই উৎসব পালিত হলেও দাঁইহাটের রাস উৎসবে কালী গনেশজননী কার্তিক ইত্যদি নানা দেবদেবীর পূজাও হয়ে থাকে ।
দিনের বেলায় পুজো অর্চনা হলেও সন্ধ্যের পরে অন্তঃত ত্রিশটি ঠাকুরের শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে । বাদ্যযন্ত্রের বিকট আওয়াজ ও রঙিন আলোর ঝলকানি সহকারে সেই শোভাযাত্রা প্রত্যক্ষ করার জন্য সংকীর্ন রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ ভাবে লক্ষাধিক মানুষ হাজির থাকে । মেলা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন খোলা জায়গায় নানা রকমের খেলনা ও খাদ্যদ্রব্যের দোকান সহ মেলা বসে । মেলার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রশাসনের তরফ থেকে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় । মেলা উপলক্ষ্যে কাটোয়া ও নবদ্বীপের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশেষ ট্রেনও চালানো হয় ।
স্থানীয় মানুষের মতে দাঁইহাটের রাস উৎসব নাকি ৫০০ বছর পুরনো । এই শহরের রাস এত পরিচিতি লাভ করেছে কেন এই প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন ইতিহাসবিদ গন বলেন - ভাগীরথীর তীরে এই এলাকা একসময়ে জঙ্গলাকীর্ন ছিল । অনুমানিক ৭০০-৮০০ বছর আগে এখানে শক্তির সাধনা সাধনা শুরু হয়েছিল । তখন অন্যান্য এলাকা থেকে তন্ত্রসাধক গন এসে তাদের সাধনা শুরু করেছিলেন । শোনা যায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণের উদ্দেশ্যে নবদ্বীপ থেকে কাটোয়া যাওয়ার পথে দাঁইহাটের এসেছিলেন । তার পরেই এখানে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটে । দাঁইহাট হয়ে ওঠে শাক্ত ঔ বৈষ্ণব ধর্মের মিলনক্ষেত্র । এরই ফলশ্রুতিতে দাঁইহাটে রাশ উৎসবের প্রচলন হয় । পরবর্তী কালে এখানে রাসের নানা বিবর্তন ঘটেছে , পাশাপাশি পুজোর সংখ্যাও বেড়েছে ।
প্রথমদিকে দাঁইহাটের রাস ছিল পট চিত্রের পূজা । পরে শাক্তধর্মের প্রভাবে এখানে রাস উপলক্ষ্যে মা শবশিব, মা বড় কালী, উগ্রচণ্ডী এই সব জাগ্রত দেবীর আরাধনাও শুরু হয় । বর্তমানে এদের পাশাপাশি কৃষ্ণ কালী, রাইরাজা, বকাসুর বধ, মাতঙ্গীমাতা প্রভৃতি পুজো দাঁইহাটে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে । ইদানীগ দাঁইহাটের রাস উৎসবের বাজেট ও জাঁকজমক বহুগুণ বেড়ে গ্যছে।
-------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন