দুটি অণুগল্প ।। সুদীপ ঘোষাল
সাধুবটতলা
তিনকড়ি সাধু একমুখ দাড়ি নিয়ে বটতলায় বসতেন মৌন হয়ে।দুচারজন এসে বসতেন তার কাছে।তিনকড়ি কথা কম বলতেন।একজন জিজ্ঞেস করলেন,কোথা থেকে এলেন? সাধু বললেন না কিছু। মুখ তুলে হেসে বললেন,মনে করুন না, আপনার ঘরের লোক।একথায় সকলেই খুশি হতেন।ধীরে ধীরে সাধু এলাকাবাসীর মন জয় করলেন।গ্রামবাসীর নিমন্ত্রণে জুটে যেত আহার, পোশাক ও সম্মান।সাধু সকলের সুখদুখমাখা জীবনে নিত্যসঙ্গি হতেন আপনজনের মত।বটতলায় সাধুর কুটির তৈরি হল।পাশে পান আর চায়ের দোকান হল।বেশ জমজমাট হয়ে গেল সাধুবটতলা।
সাধু চুপ করে সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে ছেড়ে দেন মহাকালের হাতে।ধরা দেয় সবকিছু যার প্রত্যাশা সাধুবাবা করেন না।সাধু যে কখন লোকের কাছে সাধুবাবা হয়ে গেল সে নিজেও জানে না।লোকের কৌতূহল আর নেই তাকে নিয়ে।সাধু এক উচ্চ আসনে সকলের অন্তরে অবস্থান করলেন কয়েকবছরের মধ্যেই।
তার ভক্তরা তেলসিঁদূর মাখিয়ে ত্রিশূল পুঁতলো বটতলায়।ভক্তিভরে লোকে দিতে শুরু করল চালটা,কলাটা।সাধু দেখল কী করে একটা লোক মানুষরূপী দেবতাদের সান্নিধ্যে ভালোমানুষ হয়ে যায়।
এই তিনকড়ি সাধুর একটা পেছনের ইতিহাস আছে।সি এ পাশ করেও ঈশ্বরবিশ্বাসী তিনকড়ি নিজের বসতবাটি ছেড়ে বসেছিল নিরালায় এক বটতলায়। তারপর মানুষের ভালবাসায় সে মানুষকে ঈশ্বরজ্ঞানে বিশ্বাস করতে শুরু করে।একে একে জুটে যায় ভক্তের দল।এই ভক্তদলের মাঝে খুঁজে পায় অরূপরতনকে।মানুষই যে ঈশ্বরের আর এক রূপ একথা সে প্রচার করে যায় এখন অবিরত।করোনাকালে তার দল মানুষকে সাহায্য করে ভক্তদলকে সঙ্গে নিয়ে।তিনকড়ি ভাবে,কালের বিচারে কে যে কখন নিজেই বিচারক হয়ে বসে তা কেউ বুঝতে পারে না।এখন তিনকড়ি ভাবে,শরীরটা আছে।সে সম্ভোগের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।দেহের অণু পরমাণু অংশ ভিজে।কিন্তু মন যে শুষ্ক। মন ছুটেছে পদ্মবনে। সেখানে অরূপরতনের রূপ দর্শনে মোহিত তার মন। দেহবাদে তার আসক্তি নেই।ক্ষণিকের আনন্দ নয়, অসীম আনন্দের অনুসন্ধানী তার মন।
-----------------
***********
তালডোঙা
ভাদু জেলে মাছ ধরে। তার আগে তার দাদুও মাছ ধরে সংসার চালাতেন। বাড়ির পাশেই কাঁদর। অনেকে বলেন ঈশানী নদী। ভাদু অত কিছু জানে না। কাঁদরে চান, কাঁদরে টান তার। একটা তালগাছের গোড়া ফাঁপা করে ডোঙা বানানো হয়েছে কাঁদর এপার ওপার করার জন্য। ডোঙার তলাটা মাঝে মাঝে রঙ করা হয়। ডোঙায় চেপে কাঁদরে জাল ফেলা শিখেছে তার দাদুর কাছে ভাদু। তারপর মাছ ধরে বাঁশের কঞ্চির তৈরি ঝাঁপিতে ভ'রে মাছ বিক্রি করত গ্রামে গ্রামে। ছেলে ভোলাকে গাঁয়ের স্কুলে ভরতি করেছিল সাত বছর বয়সে। এখন সে হাই স্কুলে পড়ে। কিন্তু মাষ্টারমশাইরা বলেন ভাদুকে, তোর ছেলেকে বাড়িতে পড়তে বলিস। খুব ফাঁকিবাজ। এবার নম্বর খুব কম পেয়েছে।
ভাদু রাতে ছেলের কাছে বসতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই সে চলে যায় হরিনামের আখরায়। সেখানে হরিনাম হয়। ভাদু হারমনিয়াম বাজায়। বড় সুন্দর তার হাত, সবাই বলে। এদিকে ছেলে ভোলা বই গুটিয়ে অন্ধকারে বসে থাকে কাঁদরের ধারে। পড়াশোনা তার ভাল লাগে না। কাঁদরের ধারে অনিলের সঙ্গে বসে বাঁশি বাজায়। অনিল বলে, তোর বাবা শুনলে মারবে ভোলা, সাবধানে থাকিস।
ভোলা বলে, এই সবুজ আমাকে বড় টানে। এই জল আমাকে শান্তি দেয়। চান করার সময় এক ডুবে সে কাঁদর পেরিয়ে যায়। অনিল ভোলার খুব ভাল বন্ধু। সে সবসময় ভোলার সঙ্গে থাকে, থাকতে ভালবাসে।
ভোলা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করল। ভাদু বলল, আর স্কুলে যেয়ে লাভ নাই রে ভোলা। রোজগারের ধান্দা কর।
ভোলা তাই চাইছিল। সে বলল,বাবা আমি জাল ফেলা শিখব। তার বাবা ভাদু বলল,তা শেখ। কিন্তু তুই তো ভালই জাল ফেলিস। আমি চাইছিলাম রামের সঙ্গে তু কেরালা যা। সোনার দোকানে কাজ শিখে লেগা। তারপর এখানে এসে একটা দোকান খুলবি। কত নাম হবে তখন তোর দেখবি। ভোলা বলল,না বাবা আমি কেরালা যাব না। বাবা ভাদু বলল,আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। তু আর অনিল কাল কেরালা চলে যা। মেলা পয়সা হবে, নামডাক হবে। তা না হলে জলে পচে মরবি।
বাবার ভয়ে তারা কেরালায় চলে এল। দোকানে কাজ করে, কাজ শেখে। তাদের দোকান বাজার, কেনাকাটা সব কাজ করতে হয় ভোলাকে। বাঁশি বাজাতে দেয় না। তার মনে পড়ে কাঁদরের ধারে গেলেই মনটা ঘাসের গন্ধে ভুরভুর করে উঠত। একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা তুলে দিত। বাঁশির সুরে কাঁদরের জল নেচে উঠত। ভোলার বাবা, মার কথা মনে পড়ত। কিছু ভাল লাগত না। তার বন্ধু অনিল কাজ করে অনেক দূরে আর একটা দোকানে। সন্ধ্যা হলে দুজনের কথা হত। অনিল বলত, ভাল করে থাক। অনেক পয়সা নিয়ে বাড়ি যাব। কত খাতির হবে, দেখবি, অনিলের বাবা, মা নেই। সে ছোট থেকে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। তাই তার পিছুটান কম। সে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করে।
কিন্তু ভোলার কিচ্ছু ভাল লাগে না। প্রায় দুমাস পরে সে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হল। মালিক বেগতিক বুঝে অনিলকে সঙ্গে করে ভোলাকে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
বাড়িতে এসে ভোলা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। অনিল মামার বাড়ি গেল একটা বড় ব্যাগ নিয়ে।
ভোলা কিছুই আনতে পারে নি। সে রোগে ভুগে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। মা তার বাবার ওপর রেগে গিয়ে বললেন, আবার যদি তুমি ওকে কেরালা পাঠাও তো আমার দিব্যি রইল। বাবা ভাদু আর ভোলাকে কেরালা যেতে বলেনি। শুধু বলেছিল, এখানে ও খাবে কি? আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না। তার মা বলেছিল, আমাদের একমুঠো জুটলে ওরও জুটবে।
তারপর অনিল আবার কেরালা চলে গেল। ভোলা দুমাস বিছানায় পড়ে রইল। তারপর মায়ের সেবাযত্নে সে সুস্থ হয়ে উঠল।
তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল। ভাদু জেলে মরে গেল। তার হরিনামের দল তাকে উদ্ধারণপুর নিয়ে গেল ট্রাকটরে চাপিয়ে। ভোলা সেই হরিনামের দলে ভাল বাঁশি বাজিয়েছিল। সবাই বলল, সন্দেবেলায় পেত্যেকদিন হরিনামের আসরে যাবি। বাঁশি বাজাবি।
আজ অনিল এসেছে পাঁচবছর পরে। গ্রামের মোহিনী ঠাকরুণ বলল, মামার একটু জায়গা নিয়ে গ্রামে সোনারূপোর দোকান কর। আমরা তোর খদ্দের হব। অনিল এইরকম কিছু একটা করার কথা ভাবছিল। মামাকে বলে একটা ঘর করল রাস্তার ধারে। তারপর অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দোকানের শুভ উদ্বোধন হল। খুব ধূমধাম করে দোকান শুরু হল।
এদিকে ভোলা কাঁদরে জাল ফেলে মাছ ধরছে ডোঙায় চেপে। পাশ দিয়ে কাঠগোলার বড়বাবু যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ও জেলে ভাই মাছ পেলে? ভোলা মাথাটা উঁচু করে বলল, পেয়েছি বাবু একটা কাতলা। তা কেজি খানেক হবে। বড়বাবু একটা দুশ টাকার নোট বার করে মাছটা নিলেন। তারপর চলে গেলেন।
ভোলা টাকাটা কোঁচরে গুঁজে বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করল। সুরে সুরে আকাশ ভরে উঠল চিরকালের সুরে।
=============
সুদীপ ঘোষাল নন্দন পাড়া খাজুরডিহি পূর্ববর্ধমান ৭১৩১৫০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন