Featured Post

কবিতা ।। হে নববর্ষ, এসো নবরূপে ।। অজিত চৌধুরী

হে নববর্ষ, এসো নবরূপে। অজিত চৌধুরী  নববর্ষ-জাগে হর্ষ নতুনের আগমনে, নব দিশা জাগে নব আশা জাগে  সকলের মনে-প্রাণে। যত কিছু গ্লানি,খুন হানাহানি  পিছনেই ফেলে আসি, নববর্ষ এসে নূতন আবেশে   নূতনেই ভালোবাসি। চারিদিকে আজ আলপনা সাজ বর্ষ বরণের গান, পুরাতন ফেলে আনন্দ উদ্বেলে ভরে উঠুক মন-প্রাণ। তাই আজ প্রাতে পবিত্রতার সাথে  বরণে ভরে যে বুক, এইতো সবার সুখ। করি যে বরণ নববর্ষে স্মরণ ধূপ দীপ শঙ্খ বাজিয়ে, সকলের তরে সুখ শান্তি ভরে  নিয়ে এসো তুমি আজি এ।

গল্প || পর্দা || মৃণাল কান্তি দেব

পর্দা 

মৃণাল কান্তি দেব 



  "তারপর?"

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ঈষৎ উৎসুক হয়েই জিজ্ঞাসা করল দেবায়ন।

    "তারপর? তারপর আর কিছু নেই। "

এই বলে ঝিমিয়ে পড়া আলোর মতো হাসলো কথা।

    "অবশ্যই কিছু থাকে। কিছু থাকেই। কারণ বহমান স্রোতে অনেককিছুই পুনরুত্থিত হয়। "

 দেবায়ন সহাস্যে বলে ওঠে।

    "পুনরুত্থান? না থাক! আর কোনোরকম উত্থানই চাই না। তাহলে পতনেরও ভয় নেই। আর এতো হিসেবেরও ভয় নেই। "

    দেবায়ন প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎই তার দৃষ্টি গেলো ভেজা হাওয়ায় উড়তে থাকা নীলচে পর্দাগুলোর দিকে। কথা ততক্ষনে চায়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দেবায়নের ওই দৃষ্টিতে থাকা ভাষাকে বোঝার চেষ্টা করছে।

    "এই ডিজাইনগুলো সত্যিই অসাধারণ। কেন জানিনা আজকাল এগুলোকে খুব আপন

মনে হয়। " কথা বলে উঠলো।

    "কতটা আপন মনে হয়? " আবেগে উদ্ভাসিত হওয়া কথার দিকে তাকিয়ে দেবায়ন বললো। 

কথা উত্তর দিতে পারলো না। উত্তরের বদলে দেবায়ন পেলো শুধুমাত্র আলতো হাসির রোদ মাখানো দীর্ঘশ্বাস।

      ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমেছে । দেবায়ন রওনা দিয়েছে তার গন্তব্য রুদ্রগড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা আবারো ঘুরে তাকালো সেই পর্দাগুলোর দিকে।অবাধ্য হাওয়ার স্রোতে তার মনের পর্দায় প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করলো দুটি শব্দ -আপন আর পুনরুত্থান। সাথেই সাথেই যেনো দ্বিধা,দ্বন্দ্ব আর লুকোচুরি খেলা দেখতে থাকা মনের রাজপথ মেঘাচ্ছন্ন আকাশের অবাধ্য বিদ্যুৎতরঙ্গকে আপন করে কাঁপিয়ে দিলো তার শরীর। দীর্ঘ সময় পর সে বুঝেছে কোন পর্দায় জীবন আছে আর কোন পর্দায় প্রতারণা আছে। জীবনের প্রকৃত ছন্দ মেশা কোনো পর্দা যেন পর্দাবিহীন বাস্তবের প্রতিচ্ছবিকে বরণ করে। কথা ভাবতে থাকে দেবায়নের সেই আগের মতোই ব্যক্তিত্বপূর্ণ হাসি,নিয়ন্ত্রিত আবেগ আর সংবেদনশীল মনকে নিয়ে। সে অনুভব করতে পারছে পরিণত ও স্বচ্ছ হাওয়া কীভাবে রঙীন মায়ার পর্দা উঠিয়ে দিয়ে উপহাসের হাসি হাসতে থাকে। কথার মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন টাউন লাইব্রেরীর পাশে থাকা ক্যান্টিনটাতে জন্ম নিয়েছিলো এক দৃষ্টিকোণ ও আদর্শগত সংঘাত। 

    "দেবায়ন দা, সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত নিয়েই ফেললাম। " কথা মুচকি হেসে বলে উঠলো। 

    "কোন সিদ্ধান্ত? তোমার আই এ এস অফিসার হওয়ার বিষয়টাতো? " দেবায়ন প্রত্যয়ের সুরে বললো।

    "তোমার মাথায় তো শুধু একটা বিষয়ই ঘুরছে। আরে না গো, আমি রঞ্জনদার দেওয়া অফারটা নিয়ে বলছি।" কথার চোখে মুখে অদ্ভুত এক হাসি।

    "মানে, তুমি সেই নীতিহীন রাজনীতির মধ্যে নিজেকে জড়ালে ? নিরপেক্ষতা আর স্বাতন্ত্রতাকে এভাবে বিসর্জন দেওয়ার আগে আরো একবার ভাবতে পারতে। " দেবায়ন সাথে সাথে বলে উঠলো।

"অনেকে নীতিহীন বলে আমিও নীতিহীন হয়ে যাবো এটা তুমি ভাবলে কীভাবে? আর নিরপেক্ষতা বিসর্জনের কথা যখন উঠলো তাহলে আমিও বলতে পারি, তোমরাও  তো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নও। "দেবায়নের উদ্দেশ্যে যুক্তির বাণ নিক্ষেপ করলো কথা।

    "অস্বীকার করছি না। কিন্তু অপরে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে শিকেয় তুলেছে বলে নিজেকেও সেটা শিকেয় তুলতে হবে? আর অফিসারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে তুমি বলছো! কতজণ অফিসারকে তুমি এযাবৎ দেখেছো? ব্রেকিং নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরেও একটা বিশাল ক্ষেত্র আছে। আজ যদি সবাই নিরপেক্ষতা, আদর্শ, নীতিকে বিসর্জন দিতো তাহলে সমাজটার অস্তিত্বই থাকতো না। " দেবায়ন তীব্রভাবে বলে ওঠে। 

    "আর সেই যুক্তিতে আমিও বলছি দেবায়নদা, রাজনীতিতেও সব মানুষ নীতিহীন, আদর্শহীন নয়। "

    "ঠিক। একদম ঠিক। তুমি যদি সত্যিকারের সৎ, নীতিপরায়ন রাজনীতিবিদদের সঙ্গলাভ করতে আমি কিছুই বলতাম না। কিন্তু যাদের তুমি সৎ শুভাকাঙ্খী মনে করছো তারা কেউই সৎ,শুভাকাঙ্খী নয়। কথা,এই ফিল্ড এ ঢুকতে গেলে আগে থেকে সবকিছু যাচাই করতে হয়, অনেক কিছু বুঝতে হয়, সর্বোপরি মানুষ চিনতে হয়। একটা বিষয় মাথায় রেখো, পলিটিক্যাল সায়েন্স আর পলিটিক্সের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।বৃহত্তম চক্রব্যুহতে ঢুকতে চলেছো তুমি। তুমি বুদ্ধিমতী। যা করবে বুঝেশুনে করবে। "

      দেবায়ন নানারকমভাবে কথাকে বুঝিয়েছিল। আর কথা বুঝতেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনোকিছুতেই সে রঞ্জনের দেওয়া রাজকীয় অফারের মায়াজাল থেকেও বেরোতে পারেনি। দেবায়ন যখন অন্য একটা কেস নিয়ে শহরের বাইরে ঠিক তখনি রঞ্জনদের দলে যোগদান করলো কথা। দেবায়ন অবশ্য পুরো ঘটনাটাই দেখেছিলো ডিজিট্যাল মিডিয়ার রেকর্ডেড লাইভে। আঘাত পেয়েছিলো,অভিমান করেছিল কিন্তু রাগ করেনি। মনে মনে শুধু এটা চেয়েছিলো কথা যেন তার স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখে সফল হয়। 

   শহরে ফিরে এসেও দেবায়ন কথার সাথে দেখা করেনি কারণ সে চায়নি কথা অপ্রস্তুত হয়ে যাক কিংবা তার সাথে মতাদর্শগত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক।এদিকে যত সময় গড়িয়েছে কথা আরো বেশি করে নিজেকে সক্রিয় রাজনীতির মধ্যে জড়িয়েছে। সাধারণ নেত্রী থেকে দক্ষ যুবনেত্রী হতে তার বেশিদিন সময় লাগেনি। আর দেবায়নও তার ঠাসা কাজের মাঝে কথাকে নিয়ে ভেবেছে, ভয় পেয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ একদিন দেবায়নকে আসতেই হল কথার কাছে। কথারই কিছু রাজনৈতিক সঙ্গীসাথীরা যত্রতত্র দুষ্কর্ম করে বেড়াচ্ছে এটা কি কথা আদৌ জানে, বা জানলেও কেন কিছু বলছে না সে প্রশ্ন নিয়েই দেবায়ন এলো। কিন্তু কথা বিশ্বাসই করলো না। প্রতিবাদী কথার সামাজিক সমস্যা দেখেও নির্লিপ্ত থাকাটা আরো একবার আঘাত দিলো দেবায়নকে। দেবায়ন শুধু শেষে একটা কথাই বলেছিলো, "তুমি পলিটিক্সের গ্রামার বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করেছো। কিন্তু পলিটিক্যাল পর্দাটা সরিয়ে একটিবার সমাজজীবনের গ্রামারটা শেখো। ওটা না শিখলে পলিটিক্সও তোমার সঙ্গ ছাড়বে। "

       সেই শেষ দেখা, শেষ কথা। তারপর কেটে গিয়েছে পাঁচ পাঁচটি বছর। দেবায়নও ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছে দিল্লি। কিন্তু রূদ্রগড়ে থাকা সমাজবিরোধীদের ধরার জন্য তাকে ফিরতেই হল ডিপার্টমেন্টের কথায়। এরই মাঝে কার্যত রাজনৈতিক আঙিনা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে কথা। আর সেই সরে যাওয়ার কারণ জানতেই দেবায়ন এসেছিলো কথার কাছে। কথা মেঘাচ্ছন্ন প্রহরের রঙে জানিয়েছে কীভাবে তাকে

বোড়ে বানিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছে তার সঙ্গীসাথীরা। নিয়মিত খেলার গুটি হতে হতে  সে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে, জনসাধারণের কাছে আজ কেবলই এক ধান্দাবাজ খেলোয়াড়।

      দেবায়নের সাবধানবাণী সে শোনেনি। কিন্তু এতো বছর পর দেবায়ন তাকে সেই নিয়ে দোষারোপ তো করেইনি,বরং তাকে ভাবতে বলেছে আবারো।কথার আজ মনে পড়ছে, যেদিন সে প্রথম দেবায়নের কোয়ার্টারে গিয়েছিলো ওই নীলচে ডিজাইনের পর্দাগুলোকে খুবই সাধারণ বলে মনে করেছিল। কিন্তু কয়েকবছরে চোখ থেকে মিথ্যের রঙীন পর্দা যত সরেছে ততো বেশি করে নীলচে পর্দার ওই ডিজাইনে মিশে থাকা সারল্যতা তার কাছে আপন হয়ে উঠেছে। হাওয়ার সাথে ছিটকে আসা বৃষ্টির শীতল ফোঁটাগুলো যেন চোখের পর্দাকে আরো একধাপ উঠিয়ে দিয়ে তাকে বলছে সেই ভালোবাসার কথা, যেটা শুরু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক যুক্তি দিয়ে আর যেটা এখনো বেঁচে আছে বিশ্বাস, আস্থা, টান আর অভিমানের সীমারেখায়।

কথার খুব ইচ্ছে করছে দেবায়নের সাথে একটিবার কথা বলতে। ফোনটা হাতে নিয়ে সে দেবায়নকে কল করলো। রিং হয়ে কেটে গেলো। একবার দুবার করে অসংখ্যবার তাকে কল করলো। প্রতিবারই সেই এক রেজাল্ট। কথার টেনশন হচ্ছে। দেবায়নকে নিয়ে কথার কখনো এতো টেনশন হয়নি। আজ হচ্ছে। হঠাৎই কথার ফোনে ডিজিট্যাল মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ। 

    "মিশণ রুদ্রগড় সাকসেসফুল। নেতৃত্বে ছিলেন প্ৰখ্যাত আই পি এস অফিসার দেবায়ন মুখার্জী। রুদ্ধশ্বাস অপারেশনে ধরা পড়েছে অস্ত্র ও ড্রাগ পাচারকারীদের একটা  বড়ো অংশ। গ্রেফতার হয়েছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ রঞ্জন সান্যাল। এনকাউন্টারে আহত হয়েছেন দেবায়ন মুখার্জী।" কথা থমকে যায়। ঝোড়ো হাওয়ায় উড়তে থাকা পর্দাকে সাক্ষী রেখে কথা বলে ওঠে, "আমি আসছি দেবায়নদা।" নীলচে পর্দাগুলো দুলতে থাকে। 

       

===============

 

 

   মৃণাল কান্তি দেব                        

মৃণাল কান্তি দেব 

(Content Analyst, Researcher of World literature and Regional history , Reciter ) 

ঘাটাল, কোন্নগর 

পশ্চিম মেদিনীপুর 

পিন -৭২১২১২





মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

প্রচ্ছদ।। ৮৩তম সংখ্যা ।। মাঘ ১৪৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ।। প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮১তম সংখ্যা ।। অগ্রহায়ণ ১৪৩১ নভেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮৪তম সংখ্যা ।। ফাল্গুন ১৪৩১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮২তম সংখ্যা ।। পৌষ ১৪৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল