
শৈশবের স্মৃতি পটে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ
শিউলী ব্যানার্জী (মুখার্জী)
বাংলা নববর্ষ আপামর বাঙালির কাছে একটা বিশেষ দিন । নিজেদের বাঙালি আর বাঙালিয়ানায় হয়তো সাজিয়ে তুলতে এই বাংলা নববর্ষের জুড়ি নেই। একটা নতুন আঙ্গিকে ধরা দেয় এই বাংলা নববর্ষ । আজ যখন চারিদিকে এত আধুনিকতার প্রসার , চাকচিক্য ঝলমলে আবরন , আভরন যাই বলি না বাঙালি যেন সব কিছু নিয়েই এক অন্য রূপে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু যতই দিন বদল হোক আধুনিকতার পরশ লাগুক মনে গ্রাম কি শহর সব যখন ইন্টারনেট পরিষেবায় বিশ্বায়নের আবহে নিজেদের পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করে নিচ্ছে তখন আজও শৈশবের ফেলে আসা দিন গুলিতে বৈশাখের আগমনে নববর্ষের সেই আনন্দ সেই আপামর বাঙালির একটা প্রানের ছোঁয়া খুঁজে পাই । তখন স্কুলে পড়ি প্রতিবছর আমাদের সময় স্কুলের পরীক্ষা বছরে দুবার করে হোত হাফইয়ার্লি আর অ্যানুয়ালি। যাই হোক ঠিক চৈত্র মাসে আমাদের হাফইয়ার্লি পরীক্ষা হোত আর পরীক্ষা শেষে একদিন কি দুদিন পর শুরু হোত চৈত্র শেষের গাজন উৎসব ও শেষ দিন পহেলা বৈশাখ নববর্ষ । তাই পরীক্ষা শেষে মনের মধ্যে খুব আনন্দ থাকতো গাজন আর নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ কে ঘিরে। বাবা প্রতিবছর সব ভাই বোনদের জন্য নতুন দুটো করে সুতির জামা প্যান্ট কিনে দিতো। সেগুলো পেয়ে আনন্দের সীমা থাকতো না , যেটা সবচেয়ে ভালো জামা হতো সেটা পহেলা বৈশাখ পরতাম। আমার কাকুও প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে একটা করে নতুন জামা কিনে দিতো। তাই চৈত্র সংক্রান্তি থেকে পহেলা বৈশাখ তিনদিন গাজন চলতো তিনটে নতুন জামা , কি খুশি আর মনের আনন্দটা বোঝানো যেতো না। বাড়িতে মা , কাকিমা ও ঠাকুমার জন্য ও পহেলা বৈশাখে পরবে বলে একটা করে নতুন সুতির শাড়ি কিনে আনা হতো। পহেলা বৈশাখ আসছে তার জন্য কত পরিকল্পনা .... ।।তখন
আমাদের বাড়িতে পহেলা বৈশাখের দিন ভোর থেকে ওঠা হোত । ঘর দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া হোত। কারন পহেলা বৈশাখের দিন বাড়িতে লক্ষ্মী গনেশের পূজো .....তাই সব প্রস্তুতি ও জোগাড় খুব ভালো করে করতে হতো। উঠোন জুড়ে আলপনা দেওয়া হোত।দরজায় আম পল্লবের মালা টাঙানো হোত। আমাদের পুরোহিত বিশু জেঠা সকাল দশটায় এসে পূজো সেরে দিতো। আমরা স্নান করে নতুন জামা পরে ঠাকুরের প্রসাদ খেতাম।তারপর গুরুজনদের প্রনাম করতাম পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন গুরুজনদের আর্শীবাদ নিয়ে শুরু করতে হতো।
তারপর দুপুরে কত রকমের রান্না হোত । ভাত , মুগের ডাল , দু রকম তরকারি, খাসির মাংস, ভাজাভুজি, চাটনি , সঙ্গে অবশ্যই মাটির ভাঁড়ের দই। আমার দাদু দই খেতে ভীষন ভালোবাসতো । কি আনন্দে সবাই একসাথে কাঁসার বড় বড় থালায় , কাঁসার বাটিতে খাওয়া হোত আর সঙ্গে কাঁসার গ্লাসে জল। সবাই আসন পেতে আমাদের বড় দরদালানের মেঝেতে বসে খাওয়া হোত। কি সুন্দর দিন আর সময় । একসাথে বসে খাওয়ার আনন্দই আলাদা ছিল। হ্যাঁ আর একটা জিনিস ছিল আম পোড়ার সরবত। আমাদের বিশাল বেড়ে দুটো বড় বড় আম গাছ ছিল। একটা ফজলি আমের গাছ ছিল। অনেক পুরনো ও বড় আমগাছ ফজলি আমগুলো পুরো গাছের ডালে ভরে থাকতো। পহেলা বৈশাখের দিন সেই আম পুড়িয়ে সরবত হোত। তখন দোকানে দোকানে পহেলা বৈশাখের দিন হালখাতা চালু ছিল। দোকানে পূজো হতো আর ঐ দোকান থেকে যারা স্হায়ি খরিদ্দার ছিল তাদের ঐ দিন একটি করে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করা হোত। আমাদের বাড়িতে তিন চারটি দোকান থেকে ঐ রকম হালখাতার নিমন্ত্রণ কার্ড আসতো। বাবা বিকেলে আমাদের নিয়ে যেতে সঙ্গে করে আর সেই দোকান থেকে একটা করে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার আর একপ্যাকেট মিষ্টি দিত এই ভাবে চার পাঁচ প্যাকেট তো মিষ্টি হয়েই যেতো। বাড়িতে তখন পহেলা বৈশাখ মানে একটা দারুণ সুন্দর দিন। এদিকে পহেলা বৈশাখ শিবের গাজনের শেষ দিন। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরেই ফুলজাম রাজ রাজেশ্বর মন্দিরে শিবের গাজন চলতো সেখানেই বিকেলে হেঁটে হেঁটে নতুন জামা পরে সবাই মিলে গাজন মেলা দেখতে যেতাম।
সন্ধ্যায় ফিরে এসে বাড়িতে বড়দাদু, পিসিরা , ও আমরা সব ভাই বোনেরা মিলে হারমোনিয়ামে রবি ঠাকুরের গান গেয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতাম। গানে কবিতায় সন্ধ্যার পরিবেশটি জমে উঠতো। তার পর রাতের খাবার লুচি, আলুর দম, পায়েস , আর মিষ্টি । সত্যিই সেই সময় পহেলা বৈশাখ ছিল এক নিখাদ বাঙালিয়ানায় ভরা যদিও বিশাল চাকচিক্য ছিল না একেবার সহজ সরল সাদা মাটা ভাবে বাংলা নববর্ষ পালন একেবারে ঘরোয়া ভাবে যেখানে থাকতো মাটির ঘ্রান, একান্নবর্তি পরিবারে একসাথে মেঝেতে বসে খাওয়া দাওয়া, পরনে নতুন সুতির জামা, শাড়ি, সাদা ধবধবে ধুতি, পাঞ্জাবি ...গরম ভাতে ঘি , কাগজি লেবু , শাকভাজা দিয়ে শুরু আর শেষ পাতে দই আর অবশেষে পানের ডাবর থেকে খিলি করে বানানো এক খিলি পান বড়দের জন্য ।কি সুন্দর সোনালি সে সব দিন আর সোনালি নববর্ষ উৎযাপন। যদিও বর্তমানে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ আসে নতুন বছরের আগমন নিয়ে কত রকম ভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া তাতে হাজারো আড়ম্বর হোটেল রেস্তরাঁয় বিজ্ঞাপন পহেলা বৈশাখের সূচনায় বাঙালির ভুরিভোজ। কিনে খাওয়া ব্যাপার। কিন্তু মা কাকিমাদের নিজেদের হাতে পহেলা বৈশাখের সেই বিশেষ মেনু আজ আর নেই যাতে ছিল এক অপূর্ব ভালোবাসার ছোঁয়া যা স্বাদে গন্ধে পহেলা বৈশাখের রসনাকে আরো পরিপূর্ণ করে দিত। তাই পহেলা বৈশাখ নববর্ষ আজও আসে , বর্তমানের আধুনিকতায় তা অনেক খানি আধুনিক ও ঝলমলে রূপে ধরা দেয় পালনও হয় কিন্তু শৈশবের সেই সোনালী নববর্ষ আজও তার অপূর্ব সৌন্দর্য্য নিয়ে মনের স্মৃতিতে উজ্জ্বলভাবে বিরাজ মান যা মনকে আজও নিয়ে যায় সেই ফেলে আসা আমাদের একান্নবর্তি পরিবারের আনন্দ ভরা দিন গুলিতে।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন