নববর্ষের সেকাল ও একাল
হিমাদ্রি শেখর দাস
নববর্ষের সেকালে, বিশেষ করে জমিদারদের সমাজে, ১লা বৈশাখ ছিল এক বিশাল উৎসব। প্রজাদের সাথে জমিদারদের মিষ্টিমুখ করানো, গান-বাজনা, যাত্রা, মেলা - এই ছিল নববর্ষের একটি বিশেষ দিক. বর্তমানে, নববর্ষ উদযাপন আরও বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ব্যক্তিগত হয়েছে, যেখানে পুরনো ঐতিহ্য বজায় রাখার সাথে সাথে নতুন ধরনের আনন্দ ও বিনোদনের ব্যবস্থা দেখা যায়.
জমিদারেরা এই দিনটি প্রজাদের নিয়ে পুণ্যাহ করতেন, যা নববর্ষের সাথে সম্পর্কিত ছিল. তারা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন, গান-বাজনার আয়োজন করতেন, এবং মেলা বসাতেন.
চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন "বিষু ফুল" এবং নিম পাতা দিয়ে মালা গেঁথে ঘর ও পূজার ঘর সাজানো হতো.
গাজনের মাস। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীলষষ্ঠী ব্রত । মহাদেবের মাথায় জল- এই ছবি আজও বহাল বাঙালি সংস্কৃতিতে । আজও জেলা, শহর, শহরতলির আনাচে কানাচে দেখা মেলে গাজন উৎসবের, দেখা মেলে গাজন সন্ন্যাসীদের । সময় একটু পিছিয়ে গেলে দবন্তি ঝাঁপ, বান ফন্ডা, ছাদক ঘূর্ণি, জ্বলন্ত কাঠকয়লার উপর খালি পায়ে হাঁটা সবই ছিল তখনকার চিত্র । একইভাবে ছিল নীলষষ্ঠীর দিনে শিবের মাথায় জল ঢেলে গঙ্গাস্নান সেরে পালকিতে করে কোনও সতী সাবিত্রীর ঘরে ফেরা।
ঘেরাটোপে ঢাকা পালকির পর্দা সরিয়ে তাঁকে দেখার উপায়টুকু নেই । চোখ আটকে যেত পরনে লাল রংয়ের হাতকাটা মেরজাই, হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি পরা বেহারার দলের দিকেই । পালকি কাঁধে ছুটছে তাঁরা । পিছনে পিছনে লাঠি নিয়ে ছুটছে দারোয়ান । পালকির ঘেরাটোপ দেখেই বোঝা যেত কোন বাড়ির পালকি যাচ্ছে । জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পালকির ঘেরাটোপ ছিল টুকটুকে লাল রঙের । পাড়ের রং হলুদ ।
সেই সময় সময় চৈত্র সংক্রান্তির দিনে কেরাঞ্চিতে চড়ে চড়কের গাজন দেখতে যেত নর্তকীর দল । তখনকার কলকাতায় জনপ্রিয় গাড়ি ছিল কেরাঞ্চি । এই মেলায় তখন গৃহস্থ ঘরের মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল । শুধু গাজন নয়, বাইরের অন্য অনেক উৎসব আনন্দে মেতে উঠতেই বাধা ছিল তাদের । অন্দরে তারা তাই নিজেদের সাজগোজ, খাওয়াদাওয়া, প্রচুর আনন্দ মিটিয়ে নিতেন ।
১লা বৈশাখের দিনকে নতুন বছর হিসেবে উদযাপন করা হতো, এবং এই দিনটিকে নতুন আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করা হতো.
সারা মাস ধরে চলতো বৈশাখী মেলা। কদমা, বাতাসা, খই, মুড়কি, নাড়ু ইত্যাদি বিক্রি হতো বৈশাখী মেলায়। বিক্রি হতো হাতপাখা, খেলনা হাতি, খেলনা ঘোড়া, একতারা, ডুগডুগি, ঢোল ইত্যাদি। উৎসবমুখর আমেজ ছিল মেলাতে। বিনোদনের জন্য মেলায় বৌ-নাচুনি, পুতুল নাচ, চরকা ঘুরানোসহ নানাবিধ আয়োজন থাকতো। এই দিন মানুষ নতুন কাপড় পরতো, আনন্দ উল্লাসে সময় কাটাতো এবং প্রার্থনা করতো সারা বছর যেন এমনই আনন্দঘন থাকে।
একালের নববর্ষ
নববর্ষের উৎসব আয়োজনে রমনার বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান যুক্ত হয় ষাটের দশকে। সামাজিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালন জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ছায়ানটের ভূমিকা অনেক। আশির দশকে সংযোজন হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার। বের হয় এক আনন্দ মিছিল। নাম 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। ঢোল, খোর-করতালের মুখরিত হয়ে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সেদিনের মঙ্গল শোভাযাত্রা পেয়েছিল সর্বজনীন মর্যাদা। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অচিরেই দেশের সব মানুষের নজর কাড়ে। , শুরু হলো নবরূপে নববর্ষের পথচলা। অনেক বছর ধরে শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময়, বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা বরণ করে আসছে নববর্ষকে। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনে সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন যা সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই দিনটিতে বাঙালি পুরুষরা পাঞ্জাবি এবং নারীরা শাড়িতে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। এছাড়াও এই দিনটি সংস্কৃতি চর্চারও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই নববর্ষের উৎসব ঘিরে বাঙালিরা নানারকম সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করে নতুন বছরকে আপন করে নেয়। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। সকলের এই প্রত্যাশা ১৪৩২ হয়ে উঠুক মানুষের কল্যাণ, সুখ-শান্তি ও মঙ্গলের।
বর্তমানে নববর্ষের উদযাপন আরও বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ, যেখানে গান, নাচ, মেলা, খেলাধুলা, এবং বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন কর জমিদারদের প্রভাব ছিল বেশি, যেখানে এখন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং ব্যক্তিগত উপাদান নববর্ষের উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে.
কবি জয় গোস্বামীর স্মৃতিচারণ -
যে বাড়িতে আমাদের বসবাস ছিল, ঠিক তার পাশের বাড়ির অধিবাসীরা ছিলেন কাপড়ের দোকানের মালিক। তাঁদের বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের কারনে ১ বৈশাখ এলে বিকেলে আমি আর আমার ভাই তাদের কাপড়ের দোকানে, যেতাম। সেখানে উৎসব লেগে যেত মিষ্টি, গজা , নিমকি তৈরি হত। দোকানে কোকাকোলা খেতাম এবং হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট ও একটি ক্যালেন্ডার নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। ওই দিন শুধু এই দোকানই আমাদের গন্তব্য ছিল না। মুদির দোকান, মিষ্টির দোকান, গম ভাঙানোর দোকান, ভ্যারাইটি স্টোর্স মনোহারি দোকান থেকে আমন্ত্রণের চিঠি আসতো চিঠিতে ১ বৈশাখের সন্ধেবেলা ওঁদের দোকানে যেতে লিখতেন আমাদের। সেসব আসত আমার মায়ের নামে। মা যেতেন না। আমি আর আমার ভাই যেতাম। ফলে ১ বৈশাখের দিন আমরা, মানে আমি আর আমার ভাই আমাদের বন্ধুদের ওই কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সব দোকানেও গিয়ে পেতাম মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার। মোটকথা, ১ বৈশাখ আমাদের কাছে ছিল একটা উৎসব।
এখন আমি কলকাতায় বাস করি। যেহেতু আমি লেখালেখি করি, তাই নববর্ষের দিনটা এখন অন্যরকম কাটে আমার। এদিন বিকেলবেলা আমি কলেজস্ট্রিট যাই। আনন্দ পাবলিশার্সে যাই। সেখানে নকুড়ের সন্দেশ আর ডাবের জল দেওয়া হয়। আমি খাই না। খেতে পারি না। কিন্তু সেখানে অনেক কবি ও লেখকের সঙ্গে এদিন সাক্ষাৎ হয়। তাঁরাও সেখানে আসেন। আমি তো এখন আর বাড়ি থেকে তেমন বেরোই না। ফলে এমনও হয়, হয়তো কোনও কোনও লেখক বা কবির সঙ্গে বছরের ওই একটি দিনই আমার দেখা হল! ফলে খুবই ভাল লাগে। তাঁরাও আমাকে পেয়ে খুশি হন। সেখানে খুবই আপ্যায়িত হই।
আনন্দ থেকে বেরিয়ে আমি যাই দে'জ পাবলিশিং হাউসে। সেখানেও খুব আপ্যায়িত হই। সেখানে গিয়ে চা খাই। সেখানেও অনেকে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। অনেক লেখক-প্রাবন্ধিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। দে'জে একটা বিশেষ ব্যাপার ঘটে। সেখান থেকে উঠে আসার সময়ে একটি খাতায় কিছু লিখে আসতে হয়। ১ বৈশাখের সন্ধেটা সেখানে কেমন লাগল, কেমন কাটালাম সেটা দু'লাইনে লিখতে হয়। সেটা লিখে তারপর সেখান থেকে বেরোই।
১. ইটিভি ভারত -২০২২
২. আমার ১লা বৈশাখ -জয় গোস্বামী, (এপ্রিল ২০২১)
৩. বাঙালির বৈশাখ এ কাল সেকাল - মাসুম আউয়াল ( মে,২০২৪)
৪.উইকিপিডিয়া
------------০--------
হিমাদ্রি শেখর দাস বাঁশদ্রোণী কলকাতা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন