স্বপ্নউড়ান
দিয়া, বছর ত্রিশের এয়ার ইন্ডিয়ার কেবিন ক্রু। দিয়া দশবছর এয়ারলাইনের কর্মরতা আর সাথে খুবই নিষ্ঠাবান মেয়ে। দিয়ার বাবা ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। বাবাকে দেখেই দিয়ার ছোট থেকেই উড়ানের স্বপ্ন দেখত।
দশবছর কর্মরত জীবনে দিয়া ক্রমশই প্রশংসা এবং সম্মান কুড়িয়েছে। দিয়ার ত্রিশবছরের জীবনে অনেককিছু ঘটে গেছে, তবুও সে মনের ও উড়ানের শক্তিতে ভর করে নিষ্ঠার সাথে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
আজ সকাল থেকেই দিয়ার হঠাৎ মনটা কেমন যেন উতলা হচ্ছিল। সে কাজে ঠিকমতো মন লাগাতে পারছিল না, তবুও নিজের নিষ্ঠা থেকে তো নড়লে চলবে না। সে নিজের পালনীয় কাজগুলি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করছিল। এয়ারকন্ডিশন রুমেও দিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। না আর সে পারছিল না যাত্রীদের ঠিকমতো সেবা করতে। তাই সে ঘন্টাকয়েক রেস্ট নেওয়ার জন্য গ্রীন রুমে চলে গেল।
দিয়া বরাবরই খুব সাহসী মেয়ে। জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝাট সময়ের সাথে সাথে তাকে আরো সাহসী ও শক্ত করে তুলেছিল। তবে আজ তার মনটা এত দুর্বল লাগছে কেন? গ্রীন রুমে রেস্ট নিতে এসেও তার তবুও মনকে শান্ত করতে পারছিল না। বারবারই পুরোনো স্মৃতিগুলি তার চোখের সামনে ভীড় করছে কেন আজ?
না, মনে করতে চাই না আমি পুরোনো স্মৃতি, নিজের মনে সে বিড়বিড় করে বলতে থাকল।
নিজেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, না দিয়া, না তুই এত দুর্বল হতে পারিস না... তোকে সারাজীবন শক্ত হয়েই চলতে হবে আর কারোর জন্য না হোক অন্তত মানুষের জন্য। নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছিল আজ।দিয়ার চোখটা বন্ধ হয়ে আসল। রোজ উড়ান ভরতে ভরতে নিজেই আজ স্বপ্নের উড়ানে পাড়ি দিল।
রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছের সারি, সুন্দর মনোরম আবহাওয়া। দিয়া ছাদখোলা অডি গাড়ীতে বসে আর পাশে তাকিয়ে দেখল ড্রাইভারের সীটে সৌম্য বসে আছে।
দিয়া অবাক সুরে বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি সৌম্য?
হেসে সৌম্য উত্তর দিল, লং ড্রাইভ-অনেক দূরে ভালোবাসার দেশে।
দিয়া হেসে বলল, পাগল হলে নাকি তুমি আজ? ভালোবাসার দেশ হয় নাকি!
দিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে সৌম্য বলল, পাগলই তো, তোমার ভালোবাসায় পাগল।
দিয়া সৌম্যর কাঁধে মাথা রেখে বলল, এমন পাগল হয়ে থাকবে, কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
ড্রাইভিং করতে করতেই সৌম্য দিয়ার কপালে চুম্বন করে বলল, কোনোদিনও না, সারাজীবন সবসময়ই তোমার পাশে থাকব।
দিয়া আর সৌম্য প্রেমসাগরে ডুব দিতেই তাদের গাড়ীর সামনে একটি বড় ট্রাক এসে পড়ে। দিয়া চীৎকার করে ওঠে, সৌম্য-ও-ও।
দিয়ার ঘুম ভেঙে যেতেই সে তার সামনে সৌম্যকে দেখতে পেয়ে নিজের অজান্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
সৌম্যও এয়ার লাইনসে পাইলট পদে কর্মরত ছিল। সেও দিয়ারই মত কাজের প্রতি খুব নিষ্ঠাবান ছিল। যাত্রীদের সুরক্ষিতভাবে দেশ-বিদেশ পৌঁছে দেওয়া ছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বছরপাঁচেক আগে সৌম্যর সাথে দিয়ার প্রেমকাহিনী শুরু হয়েছিল। সেই প্রেমকাহিনী ধীরে ধীরে বিবাহ আসরে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের মেহেন্দি দিয়ার হাত থেকে উঠতে না উঠতেই একদিন এক প্লেন দুর্ঘটনার উড়ো খবরে দিয়ার জীবনের সমস্ত আলো নিভে গিয়েছিল।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। দিয়া নিজেকে অনেক কষ্ট করে জীবনের পথের নির্দিষ্ট রেখায় দাঁড় করিয়ে জীবনে চলা শুরু করেছিল।
জ্ঞান ফিরে দিয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৌম্যের দিকে অবাক চোখে তাঁকিয়ে থাকল।
সৌম্য দিয়াকে স্পর্শ করে বলল, দিয়া চিনতে পারছ না আমায়? আমি তোমার সৌম্য।
দিয়া সৌম্যকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কোথায় চলে গেছিলে আমাকে ছেড়ে। সবাই বলেছিল তুমি নেই--মিথ্যা বলেছিল সবাই। আমি জানতাম তুমি বেঁচে আছ--তুমি ফিরে আসবে একদিন। কিন্তু, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? কেন এতদিন তুমি কোনো ফোন করোনি?
দিয়াকে শান্ত করে সৌম্য বলল, শান্ত হও দিয়া, সব বলছি। দিল্লী থেকে আমেরিকা উড়ান ভরে যাত্রীদের নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম। তারপর আমেরিকা বিমানবন্দরে ল্যান্ডিং করার আগেই হঠাৎ বিমানের ইঞ্জিন বিকল হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। গুরুতর আহত হয়ে বহুদিন কোমাতে চলে গেছিলাম। জ্ঞান ফিরতেই তোমার নাম নিয়েছিলাম। আজই দেশে ফিরে গ্রীনরুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার নামের চীৎকার শুনে ছুটে এসে তোমার দেখা পেলাম। আর বাকীটা এখন তোমার সামনে দিয়া।
সৌম্যের হাতে হাত রেখে দিয়া বলল, তোমাকে কত খুঁজেছি সৌম্য, তোমারই অপেক্ষায় দিন কাটিয়েছি। আজ আমার অপেক্ষার অবসান হল। চলো সৌম্য আর দেরী করা ঠিক হবে না, খবরটা সবাইকে দিতে হবে তো। এরপর ক্যাপ্টেন সৌম্য দত্তের জীবিত অবস্থায় দেশে ফেরার খবরে পুরো বিমানবন্দরে হইচই পড়ে গেল। চারিদিক থেকে শুভেচ্ছা বার্তা ভেসে আসতে থাকল। ইতিমধ্যেও উভয়ের বাড়ীর লোকজনও বিমানবন্দরে হাজির হয়েছে। আজ চারিদিকে শুধুই খুশির খবর সাথে দিয়া-সৌম্যের জীবনেও। বসন্তের প্রস্ফুটিত রাঙা পলাশের মতো সৌম্য দিয়ার খালি সিঁথিকে রাঙিয়ে দিল। তারপর দুজন দুজনের হাত ধরে হাসিখুশি মুখে এক নতুন জীবনরেখার পথে চলার উদ্দেশ্যে আরো একবার নতুনভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হল।
******************************************
কলমে-রিংকু বিশ্বাস
ভীমপুর, নদিয়া-৭৪১১৬৭
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন