google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re অভিজ্ঞতাঃ রণেশ রায় - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

সোমবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৯

অভিজ্ঞতাঃ রণেশ রায়




নতুন বছর, নতুন সূর্য


রাত বারোটা। একবিংশ শতাব্দীর ১৮ পার হয়ে ১৯শে পদার্পন। পার্কস্ট্রিট থেকে পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে নববর্ষ বরণ উৎসব। মদের ফোয়ারা। তার সঙ্গে বাজি। নব্য বাঙালির অভিনব সাজ। পার্কস্ট্রিটসহ শহরের সব হোটেলগুলোতে আলোর ঝলকানি। খাদ্যতালিকায় দেশবিদেশের বিভিন্ন ধরনের খাবারের উঁকি। রাস্তায় গাড়ি রাখার জায়গা নেই। শিশুদের কোলে নিয়ে বাবা মা যেমন উপস্থিত তেমনি যুবক যুবতীদের যুগল উপস্থিতি। আর শহরে পাড়াগুলো তাদের দখলে যাদের আর্থিক তেমন জোর নেই কিন্তু আছে বাড়ির সামনে পাঁচিলে বসে মজলিস গড়ে তোলার অদম্য উৎসাহ। আছে নববর্ষের হাতছানি। সেখানে চুল্লুর সমাহার।

কোন এক পল্লীর এক বাড়ির দোতলায় নিজের ঘরে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা শুভর। বয়স হয়েছে। এমনিতেই ঘুম আসে না। আসব আসব করেও চলে যায়। তার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে লুকোচুরি। এর মধ্যে আজ বাজির শব্দ, রাতের নিশুতি ভেঙে কাদের বা কোলাহল। ঘরের বাইরে পাঁচিল ধরে কিছু কিশোর যুব। মুখে কথার ফোয়ারা। বাংলা ক খ গ শ ব ল  বর্ণের কথামালায় আকাশ বাতাস মুখরিত। ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে শুভর কানে মধুবর্ষন করছে । নীচে ওদের মজলিসে একে অপরের প্রতি হুমকি। কিছুক্ষন আলাপচারিতার পর শুভর ঘুম ভয়ে পত্রপাঠ বিদায় নিয়েছে। শুভ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কি আর বলবে, বলার কি আছে ? রোজই অল্প বিস্তর হয়। আজ বাঙালির বিশেষ সাহেবী উৎসব। তাই সব কিছুতে সরকারি বেসরকারি ছাড়। একটু বাড়াবাড়ি আর কি! একটা সভ্য সমাজে এধরনের বাড়াবাড়ি মনকে উৎফুল্ল করে তোলার কথা। পরিবেশ আনন্দ মুখর হয়ে ওঠে! যেন উৎসবের বাগানে মধুকরের গুঞ্জন। কিন্তু বেরসিক শুভর এতে আগ্রহ নেই। শুভ প্রহর গুনে যায়। যত রাত বাড়ে তত মুখর হয়ে ওঠে এই আনন্দ মেলা। সে এই রস থেকে বঞ্চিত।

রাতের শেষ প্রহর বিদায় নিতে চলেছে। নতুন বছরের নতুন সূর্যকে আহবান জানিয়ে চলেছে ছেলে ছোকরার দল তাদের মুখরোচক শব্দমালায়। প্রতিটি কথাই যেন কবিতার মালা গেঁথে চলেছে। নতুন বছর শুরুর নমুনা রেখে যাচ্ছে। জানিয়ে যাচ্ছে আগামী বছর প্রতিটি রাতই কেমন অম্ল মধুর হয়ে উঠবে। শুভর কাছে ওদের ওই বাক্যবন্ধনী কেমন ঘুম পাড়ানি গান গাইবে। আর তার রাত কেমন কাটবে। শুভ কিছু বলবে না বলেই শুয়ে আছে। কিন্তু আর চুপ থাকতে পারল না। স্ত্রী বারণ করা সত্ত্বেও বারান্দায় গিয়ে মুখ বাড়িয়ে ছেলেদের উদ্দেশ্যে তার অসুবিধের কথা চিৎকার করে জানায় শুভ। তার অধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে বলে প্রতিবাদ করে। ছেলেদের মধ্যে একজন বলে, জ্যেঠু অন্যায় হয়ে গেছে। শুভ বোঝে না কি করবে। হাসবে না কাঁদবে। সে ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ে। বোঝে ওরা তাকে নিরস্ত্র করার মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করেছে। মিষ্টি বুলেট নিক্ষিপ্ত হয়েছে। শুভ বোঝে এটা প্রথম পদক্ষেপ। আস্তিনের নীচে পরের তেতো বুলেটটা হয়তো লুকোনো আছে। কথা বাড়ায় না। আর ব্যাপারটা এগোয় না।

শুভর স্ত্রী ভীত সন্ত্রস্ত। সে বলে তুমি একা কি করতে পার? সবাইতো দেখছে শুনছে। কেউ কিছু বলছে না। শুভ জানে একা তার ক্ষমতা কিছুই নেই। ঝুঁকিটা বেশি। ও এও জানে আসে পাশের বাড়ির একজন আধজন কিভাবে নিজের ব্যবসা বা অন্য কোন স্বার্থে এদেরই কাউকে কাউকে ব্যবহার করে। আর এ ধরণের যে গুটিকতক লোক আছে তারাই সকালে উঠে সবচেয়ে আগে শুভকে অভিনন্দন জানাবে। বলবে ছোরাগুলো বহুত বেড়েছে। খুব ভালো করেছেন। সবাই কিন্তু সেরকম নয়। অনেকেই বরং বলবে ওদের সঙ্গে না লাগাই ভালো। কেন গেলেন। যদি আপনার কিছু হত? আমরাও তো কিছু করতে পারতাম না। এরা কিন্তু নিজেরা এগিয়ে না আসতে পেরে লজ্জিত। কিছু হলে এদেরও কার্যক্ষেত্রে কাউকে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যেত। শুভর অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। কিন্তু আজের পরিবেশে এরা গুটিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। যতক্ষণ পারা যায় ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়। শুভও যেমন প্রায় সারারাত চুপ করে ছিল। তাই ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে দোষ দেবার নেই। বরং যারা এদের ব্যবহার করে আবার শুভকে অভিনন্দন জানায় তারাই ভয়ঙ্কর। যাই হোক সেটা ভেবে লাভ নেই। শুভ ভাবে।

শুভর স্মৃতিতে সত্তরের দশকের তার ছোটবেলা ফিরে আসে। স্নায়ু জগতে স্মৃতি একান্তে বিচরণ করে। শুভর সঙ্গে সে আলাপচারিতায়, প্রেমালাপে ব্যস্ত। শুভর মনে পড়ে। স্মৃতি তাকে জানায়। তখন কোন বাড়ির সামনে এই বয়সী ছেলে ছোকরার দলের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেত না তা নয়। ভেসে আসত বোমা গুলির শব্দ। ওরা নিজেদের মধ্যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ত। শুভর মনে পড়ে সেই বিতর্কের বিষয় ছিল সম্পুর্ন আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের ছেলেমেয়েরা যে ভাষায় যা নিয়ে কথা বলত বিতর্ক করত সেই বিষয়গুলোই ভাষা পেত পাড়ার ছেলে ছোকরাদের চেঁচামেচি বিতর্কে। উত্তপ্ত ওয়ে উঠত জ্যোৎস্নার রাত। কেন দেশে এত বেকার, এর সমাধান কি, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এক একটা ভিয়েতনাম, রাশিয়ায় কি হয়েছে, চিনে কি হচ্ছে, ভারতে কি হওয়া উচিত এসব নিয়ে আলোচনা। এরই মধ্যে জিপের আওয়াজ, ছেলে ছোকরারা উধাও। আবার কেউ হয়তো গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ওরা গায়, ' আমরা আমাদের গান গাই ওরা গাইতে দেয় না' অথবা
' রাণার চলেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে'। ঘরে বাবা কাকারা সন্ত্রস্ত থাকলেও ওদের কথাবার্তা শুনে কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়ত। বাড়িতে কাকিমা মাসীমারা এদের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ত। ওদের দুঃসাহস তাদের শঙ্কিত করত। আবার তারা এসব শুনে অনেক কিছু জানতে পারত। রাতে ঘুম আজের মতোই বিঘ্নিত হত। কিন্তু তারা ছেলে ছোকরার ওপর বিরূপ হত না মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও।

শুভ ভাবে একাল আর সেকালের পার্থক্যটা কোথায়। কিন্তু আজের ছোরাদের ওপর সেরকম রাগ করতে পারে না। ওরাতো আমাদেরই ছেলেমেয়ে। সমাজটা বদলেছে। যেভাবে বদলেছে এদের মানসিক গঠন সেভাবে বদলাচ্ছে।
তাদের সাংস্কৃতিক জগতে নতুন সূর্যের উদয়। আজ ভোগবাদে সবাই আপ্লুত। পরিবার ভেঙে ছোট হয়েছে। সেই দৌলতে রোজগার অল্প হলেও অন্যান্য খরচ বাঁচিয়ে মোটরসাইকেল বা নেশা পণ্যের জন্য খরচের টাকা জুটে যায়। আত্মকেন্দ্রীকতার দর্শন আজের জীবনে জোরালো হয়েছে। সেকালে রাষ্ট্রের চোখে এরা সমাজবিরোধী ছিল। আজ রাষ্ট্র সেটা ভাবে না। তাদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দরকার নেই। কারন তারা রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক নয়। বরং কায়েমী স্বার্থের কাছে বলি প্রদক্ত। তারা যেভাবে কিশোর যুবকদের দেখতে চায় তারা তাই হয়েছে। তারা সমাজবিরোধী নয় বরং সমাজমুখী। কায়েমী স্বার্থে সমাজটা যেমনভাবে সেজেছে সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলেছে। সমাজ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আবার শৃঙ্খলার প্রাঙ্গনে মুক্ত আকাশ। সমাজ তাদের অনেক ছাড় দিয়েছে। ফুর্তি করার ছাড়। আনন্দ অনুষ্ঠানে ছাড়। ধম্ম কম্মে ছাড়। ফায়দা তুলে রোজগারের ছাড়। এককথায় গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা। সমাজের বাঁধন শিথিল হয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত। এরা সমাজ বদলের দাবি তোলে না। গনতান্ত্রিক সংবিধানের পক্ষে বিপজ্জনক নয়। শুভরাও বদলে গেছে। তাদের বাস আজ কাঁচের স্বর্গে। সুতরাং এটা অনিবার্য। যা হবার সেটাই হয়েছে। শুভ বোঝে আজ কলকাতার সকালে ননিউইয়র্ক বা লন্ডনের সূর্য উদীয়মান।
===========================

০১/০১/২০১৯



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন