Featured Post
প্রবন্ধ ।। মাতৃভাষায় শিশুশিক্ষা ।। তৃষা সানা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মাতৃভাষায় শিশুশিক্ষা
তৃষা সানা
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন "শিক্ষার সাধনাকে পরভাষার দ্বারা ভারাক্রান্ত করলে চিরকালের মতো তাকে পঙ্গু করার আশঙ্কা থাকে।" প্রবোধ চন্দ্র সেন তার লিখিত 'রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা' পুস্তকে লিখেছেন - "শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ"। শিশুরা তাদের চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারা চারপাশের পরিবেশ থেকে যা কিছু দেখে, শোনে, অনুভব করে আর বোঝে তার মাধ্যমই শেখে। দেখে শুনে বুঝতে অসুবিধা হলেই তারা বাবা, মা, দাদা, দিদি, বাড়ির বড়দের ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে প্রশ্ন করে। শিশুদের শিক্ষায় বড়দের দেওয়া এই উত্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এর মাধ্যমে তাদের শেখার পরিসর ব্যাপ্ত হয়। এই দেখা শোনা ও বোঝার প্রধান মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষা তো শুধু মায়ের মুখের ভাষা নয়, বাড়ির বড়রা এবং আত্মীয়-স্বজন এই ভাষাতেই কথা বলে। এই ভাষায় শিশু কল্পনা করে, মনে মনে ভাবনা চিন্তা করে, মনের ভাব ও ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই প্রকাশ করে। আবার আনন্দ, ভালোবাসা আদরের ভাষাও এই মাতৃভাষা, তাই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বড়রা যেমন চিন্তাভাবনা করি শিশুরাও তেমনি মনে মনে অনেক কিছু চিন্তা করে। শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন যে বড়দের চিন্তার পরিমাণের তুলনায় শিশুদের চিন্তার পরিমাণ কিছু কম নয়। শুধু চিন্তার ধরণ আলাদা, বিষয়টা একটা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝে নিই, বড়রা ভাবে যে, আজ সারাদিন কি কি কাজ করতে হবে, কোথায় কোথায় যেতে হবে, কোনও সমস্যা থাকলে কি পদ্ধতিতে তার সমাধান হবে, সমাধানের অন্য কি কি উপায় আছে ইত্যাদি। একই রকম ভাবে শিশুরা ভাবে আমার খেলনাটা আজ ভেঙ্গে ফেলেছি - মা জানতে পারলে নিশ্চই বকবে, পুতুলটা খুব সুন্দর - একে একটা নতুন পোশাক পরাবো, মায়ের কালো ওড়নাটা পেলে মাথায় দিয়ে চুল বানাবো, হোমওয়ার্ক শেষ করতে না পারলে ম্যাডাম বকবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ ওরাও অনেক কিছু চিন্তা করে। চিন্তা করতেও ভাষার ব্যবহার করে মনে মনে আর শিশুর চিন্তার ভাষা হল মাতৃভাষা। মাতৃভাষার ব্যবহার সম্পর্কে ধারনা, শব্দভাণ্ডার, ভাষা ব্যবহারের জ্ঞান, তাদের চিন্তা শক্তিকে বাড়াতে ও সর্বোপরি চিন্তার মাধ্যমে মূর্ত ও বিমূর্ত ভাবনার পরিধি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই মূর্ত চিন্তা হল সেই চিন্তা যেখানে, যে ব্যক্তি বা বস্তু সামনে আছে তার সম্পর্কে চিন্তা করা হয়। মূর্ত চিন্তা শিশুর জন্মের প্রথম দু বছরের মধ্যেই শুরু হয়। যেমন খেলনা, পুতুল, বাড়ির ব্যবহৃত জিনিস এইসব উপাদান যা শিশুর সামনে আছে তা নিয়ে ভাবনা। আর বিমূর্ত চিন্তা হল সেই চিন্তা যেখানে যে বস্তু, ব্যক্তি বা ঘটনা সামনে নেই বা সামনে ঘটেনি সেই বিষয় নিয়ে মনের ভাবনা। এই বিমূর্ত ভাবনা শুরু হয় শিশুর আট বছর বয়সে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশে, সৃষ্টিশীলতার বিকাশে, সর্বোপরি শিশুর মানসিক বিকাশে মাতৃভাষার ব্যবহার করা খুবই জরুরী। শিশু নিজে নিজের সাথে কথা বলে মাতৃভাষায়। ছবি আঁকে, নিজের মনে পুতুল নিয়ে খেলা করে, খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতে সে নিজেই নিজের সাথে কথা বলে, খেলনা নিয়ে বাড়ি বানায় গাড়ি বানায় আবার ভেঙে ফেলে। মনের মত না হলে আবার নতুন করে বানায় এইসব করতে করতে সে নিজেই নিজেকে নির্দেশ দেয়। নিজের ভুল ত্রুটি খুঁজে বের করে আবার নতুন করে গড়ে। শিশু এই নিজে সাথে নিজের কথা বলে মাতৃভাষায়।
শিশু মাতৃভাষা শেখে না - আত্মস্থ করে। শুনতে শুনতে বুঝে নেয়, বুঝতে বুঝতে এই ভাষার শব্দচয়ন পদ্ধতি, বাক্য গঠনের ধারা, শব্দের অর্থ, অর্থের বিভিন্নতাকে নিজের মধ্যে একাত্ম করে নেয়। শিশুরা যখন বড়দের সাথে কথা বলে বা অন্য শিশুদের সাথে কথা বলে তখনই মাতৃভাষা তার মাধ্যম হয়ে ওঠে। মাতৃভাষায় মনের কথা প্রকাশের সুযোগ না পেলে তাদের অনেক কথা না বলা থেকে যায়, অনেক কিছু বুঝতে না পারলেও জানতে চাইতে পারে না। মাতৃভাষায় শিশু আত্মপ্রকাশের যে স্বাধীনতা অনুভব করে, অন্য ভাষায় তা সম্ভব হয় না। একটি শিশু মাত্র তিন সাড়ে তিন বা চার বছর বয়সে বিদ্যালয়ে যায়। তার বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম যদি অন্য ভাষা হয় তবে কি ঘটে? ধরলাম বিদ্যালয়ের মাধ্যম ইংরেজি, অথচ একটি শিশু বাড়িতে কথা বলে বাংলায়। বিদ্যালয়ে প্রথম দিন শিক্ষিকা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, What is your name? সে চুপ করে আছে, তিনি আবার জানতে চাইলেন What is your name? সে তখনও চুপ করে আছে। প্রশ্নটা বুঝে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু প্রশ্নটা সে বুঝতেই পারছে না। শিক্ষিকার মুখের ভাব দেখে সে শুধু এটুকু অনুভব করতে পারল যে, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না, তার ফলে শিক্ষিকাও খুশি হলেন না। বিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই তার নিজেকে অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হল। উত্তর দিতে না পারায় একটা খারাপ লাগা তার স্মৃতির পাতায় লেখা হয়ে গেল। তার মা তাকে শিখিয়েছিলেন - তোমার নাম কি? তোমার বাবার নাম কি? মায়ের, দাদুর, ঠাকুমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? এই সব কিন্তু ইংরেজিতে শেখাননি। বাড়ি ফিরে সব শুনে মা বুঝলেন এ তাঁরই ভুল। তিনি তো বাচ্চাকে শেখাননি What is your name? এই ভুল শুধরে নিতে পরদিন থেকে তিনি বেশি বেশি ইংরেজি শেখাতে শুরু করলেন।
ইংরেজি শেখাবার চেষ্টায় বাড়ির বড়রা বিশেষ করে বাবা মা, গৃহশিক্ষক বা শিক্ষিকা পরদিন থেকে তার সাথে কথা বলার সময় বা পড়াবার সময় বহু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা শুরু করে দিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ বাক্যটিও ইংরেজিতে বলেন না। বাংলা বাক্যের মধ্যে দুটি, চারটি, ছটি ইংরেজি শব্দের ব্যাবহার করেন। এর ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, কোনটা বাংলা শব্দ কোনটা ইংরেজি শব্দ শিশুটি বুঝতেই পারেনা। কোনটা বলবে? আর কোনটা বলবে না? ইংরেজি বললে কিভাবে বলবে? বাংলা বললেই বা কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারে না। সে ক্রমে ক্রমে বাড়িতে ও বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি মিশ্রিত একটি ভাষা রপ্ত করে কোন রকমে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখে নেয়। দুটি ভাষার কোনটাই তার সঠিকভাবে শেখার অবকাশ হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শিশুরা যখন একটু বড় হয়ে উঁচু ক্লাসে ওঠে তখন নিজের থেকে কোন বিষয়ে কিছু লিখতে দিলে খুব বিপদে পড়ে। ভাষার দক্ষতার বিষয়টি হারিয়ে যায়। নিত্য দিনের কাজ হয়তো তাতে আটকায় না তবে সাহিত্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে কেমন যেন অনীহা তৈরি হয়। প্রয়োজন ছাড়া শুধুমাত্র সাহিত্য রস আস্বাদনের জন্য এরা বই পড়ে না।
বাড়ি হল শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। জন্মের পর থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রথম চার বছর শিশু বাড়ি থেকেই শেখে। বাড়িতে যেহেতু মাতৃভাষার ব্যবহার হয়। তাই বাড়িতে বাংলা ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে বা অন্য ভাষা মিশিয়ে নয়, শুদ্ধ মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষার সূচনা হোক।
শিশু মনস্তত্ত্ববিদ গণের মতে শিশু প্রাথমিক স্তরে ও মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করবে তারপর দ্বিতীয় ভাষা শেখালে সেটিও সে সমান্তরাল ভাবে রপ্ত করতে পারবে। পরবর্তীকালে আরও বড় হলে তৃতীয় ভাষাও সে রপ্ত করতে পারবে। ভাষা শেখা আর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভাষাকে ব্যবহার করার মধ্যে পার্থক্য আছে। শিশুরা একসাথে একাধিক ভাষা শেখার ক্ষমতা রাখে কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হবে সেই ভাষা যে ভাষায় শিশু চিন্তা করবে, কল্পনা করবে, বুঝবে, বোঝাবে প্রশ্ন করবে স্বপ্ন দেখবে। আর সেই সব পথ এক জায়গায় গিয়ে মেশে - তা হলো মাতৃভাষা।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর যে সমস্ত শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেখানে মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদানের সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন (১৯৫০), মুদালিয়ার কমিশন (১৯৫২-৫৩), কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬), ঈশ্বর ভাই প্যাটেল কমিটি (১৯৭৭), জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬)। শিশু শিক্ষাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর ও সার্থক করে তোলার জন্য মাতৃভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষও এই বাংলা ভাষায় কথা বলে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বর্তমান বাংলাদেশ, পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার তাদের উপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও মিছিল শুরু হয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই এক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী মিছিলের উপর পাকিস্তানি পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান সহ আরো অনেকে। মাতৃভাষা রক্ষায় রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দিতে যারা আত্মবলিদান দিয়েছিলেন, তাঁদের সম্মান জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয়।
মাতৃভাষা একাধারে যেমন শিক্ষার মাধ্যম তেমনি মানুষের অস্তিত্ব, পরিচিতি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। একটি রাজ্য তথা দেশের পরিচিতি ঘটাতে সেখানকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অতীব মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। তাই মাতৃভাষাকে আমাদের অতি সযত্নে আগলে রাখতে হবে তবেই সেও আমাদের গৌরবের শীর্ষে উন্নীত করবে।
=================
তৃষা সানা
কল্যানী, ব্লক - B, নদীয়া, ৭৪১২৩৫
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন