ডবলিউবিসিএস পরীক্ষার ইনটারভিউ দিতে ঢুকে দেখলাম, ছজন পরীক্ষক টেবিলের উল্টোদিকে বসে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। জানি, এনারা প্রত্যেকেই প্রশাসনের এক একজন দুঁদে আমলা। নমস্কার করতেই গম্ভীর গলায় চেয়ারম্যান বললেন,-----টেক ইওর সীট অ্যান্ড টেল মি ফাইভ সেন্টেন্স অ্যাবাউট ইওরসেল্ফ ।
আমি বাংলায় বলতে শুরু করতেই বাধা পেলাম,
------স্পিক ইন ইংলিশ। আর য়ু নট কনফিডেন্ট ?
------আমি অবশ্যই কনফিডেন্ট স্যার। কিন্তু আমার মনে হয়, যেহেতু আমি বাঙালী আর বাংলা আমার মাতৃভাষা, তাই আমি ইংরেজির চেয়ে বাঙলাতেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারব।
------সে কী কথা ! আপনি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চাকরী করবেন, আর ইংরেজী বলবেন না ?
------দরকার হলে, এবং আপনারা চাইলে অবশ্যই বলব স্যার। তবে আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে।
------তাই নাকি ! কী প্রশ্ন ?
------স্যার, কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে দেখলাম, কলকাতা হাইকোর্ট থেকে একটা বিশেষ টিমকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, কোর্টের কাজকর্ম কিভাবে বাংলায় করা হচ্ছে সেটা দেখেশুনে আসতে। কারণ, বহু ইংরেজী না জানা মানুষ বিভিন্ন কাজে কোর্টে আসেন। কাজকর্ম বাংলায় হলে তাঁদের খুব সুবিধে হয়। তাছাড়া, দুএক জন অসৎ উকিল ইংরেজী না-বোঝা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নানাভাবে ঠকাচ্ছেন। যতদূর জানি, অবাঙালী পরীক্ষার্থীদের ডবলিউবিসিএস পাশ করার পর লিখিত এবং মৌখিক বাংলা পরীক্ষাও পাশ করতে হয়, কারণ বাংলা পড়তে বা বলতে না পারলে সাধারণ মানুষের সাথে তাঁরা কাজ করবেন কিভাবে ? এইভাবে আলাদা ইংরেজী কথা বলার জন্য কিন্তু কাউকে পরে পরীক্ষা দিতে হয় না। এরপর যদি আমাকে ইংরেজীতে কথা বলতে হয়, তাহলে মনে হয় সরকারী নীতির দ্বিচারিতা করা হবে।
আমার কথা শুনে সব পরীক্ষকেরা কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে যান। সম্ভবত এর আগে কেউ তাঁদের এইভাবে কিছু বলেনি। এরপর আমার বাংলায় কথা বলা নিয়ে তাঁরা অবশ্য আর কোনও আপত্তিও করেননি।
🌑
আমি শ্রম দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনার পদে যোগ দিলাম। পশ্চিমবঙ্গ দোকান ও সংস্থা আইন, ১৯৬৩ অনুসরে আমাকে বেশ কিছু কাজ করতে হত। কোনও দোকান কর্মচারীকে যদি মালিকপক্ষ বেতন কম দেন, বা না-দেন, তাহলে তিনি শ্রমদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন। তখন উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে, আমাকে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হত। এটাকে অফিসে বলা হত "পে কেস"। এমন প্রায় তিরিশটি পে-কেস আমার কাছে এল। আমি খুব মন দিয়ে কাজ শুরু করলাম ।
মাস দেড়েক পর একটি কেসের শুনানি শেষ হল। এবার আমার ফাইনাল অর্ডার দেবার পালা। দেখলাম, আমার লেখা অর্ডারটা প্রায় চারপৃষ্ঠা হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারী অফিসের বহু কর্মচারী ফাঁকিবাজ। এতবড় অর্ডার টাইপ করতে অনেক টাইপিস্টেরই মহা আপত্তি। আমার মেজাজ গেল গরম হয়ে। সেটা ১৯৯১ সাল, তখন অফিসে কম্পিউটার, বা জেরক্স কিছুই আসেনি। আমি বাড়িতে বসে পুরো অর্ডারটা কার্বন কপি করে বাংলায় লিখে ফেললাম।
বাংলায় হাতে লেখা অর্ডারটা নিয়ে অফিসে আমার সিনিয়র জয়েন্ট কমিশনারকে দেখিয়ে বললাম,
------স্যার, একটা পে-কেসের অর্ডার বাংলায় বানিয়েছি। এটা পাঠিয়ে দেব ?
ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন,
------কি বলছেন ! বাংলায় পে কেসের অর্ডার ? বাংলা টাইপিস্ট পেলেন কোথায় ? এই অফিসে তো নেই !
------আমি হাতে লিখে ফেলেছি স্যার !
------বলেন কী ! দেখি দেখি !
সবটা দেখে উনি চমকে গেলেন। সাথে সাথেই আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের বাড়িতে খোদ শ্রম কমিশনারের কাছে। সেখানে গিয়ে বললেন,
------স্যার, এই ছেলেটি মাস তিনেক আগে জয়েন করে আজ একটা চার পৃষ্ঠার পে কেসের অর্ডার লিখে এনেছে। আমার পঁচিশ বছরের সার্ভিস লাইফে পে কেসের বাংলায় লেখা অর্ডার চোখে দেখিনি।
কমিশনার সাহেব অবাঙালী। কিন্তু দেখলাম চমৎকার বাংলা পড়তে এবং বলতে পারেন। আমার পিঠ চাপড়ে কফি খাওয়ালেন।
দুদিন পরেই শ্রমমন্ত্রীর ঘরে আমার ডাক পড়ল। মন্ত্রীমশাই আমার সাথে কথা বলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিলেন,
------আপনার তৈরি করা অর্ডার টা আমি পড়েছি। খুব ভাল লেগেছে। আমাদের দেশের বহু মানুষ ইংরেজীতে লেখা বিভিন্ন লেবার ল পড়তে পারেন না। আপনি ধীরে ধীরে এইসব আইনের একটা করে সংক্ষিপ্তসার তৈরি করুন। টেকনিক্যাল জটিলতায় ঢুকবেন না, সবাই যেন পড়ে মূল বিষয়টিকে বুঝতে পারে।
আমি সেইভাবে শ্রম আইনগুলোর সংক্ষিপ্তসার বাংলায় তৈরি করেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে সেগুলো যখন ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়, তখন মনে হয়েছিল আমার হাড়ভাঙা পরিশ্রম সার্থক।
====================
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, কলকাতা-৯২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন