যুগান্তরে -- আগমনীর সুরে সুরে
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
নিশাবসানের সাথে সাথে জেগে ওঠে ধরণী। জেগে ওঠে নতুন প্রাত্যহিকতার আরো একটি স্বপ্ন নিয়ে --- চিরন্তনের নিত্যনিয়মে। একটু একটু করে প্রভাতআভায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে দিবসনিসর্গ। ঋতুচক্রে আবারো নতুন মোড়! শারদীয়ার রঙ লেগেছে আজ প্রকৃতির অঙ্গজুড়ে। ঘাসের ডগায় ডগায় কুয়াশার অন্তরঙ্গ স্পর্শ! সুখাবহ অনুভূতির সবটুকুজুড়ে তাই ভিজেভিজে কেমন একটা হিমেল রোমাঞ্চ। টুপটাপ ঝরে পড়ছে ডাগর যুবতীর মতো শিউলী। অবিরাম আলতো ছোঁয়ায় ভিজেমাটিতে শিহরণ লাগে। স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে মন। ভাবনায় ভেসে ওঠে ফেলে আসা আরো কত আশ্বিনের ভালোলাগা! দিনেরআলো আরো চেকনাই হয়ে ওঠে। নদীর দুধার বরাবর বিছিয়ে থাকা কাশবনের বেসামাল আবেগ দুলেদুলে গড়িয়ে পড়ে। তাকে সামনে রেখেই, উৎসবের বল্গাহীন আনন্দ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে ধরার বুকে। মাথার উপরে তখন ঝকঝকে নীলাকাশ। কারোর যেন খেয়ালই নেই --- যার অনাবিল বিস্তারে, অসীম স্বচ্ছতায় চিত্রবৎ প্রতিবিম্বিত হয়েছে পৃথিবীরই উচ্ছ্বাস। ওই দেখ --- অলস ভেসে চলেছে সফেদ ফেনার মতো নিরম্বু মেঘের দল। আদিগন্ত নীলিমায় --- এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্তে। প্রকারান্তরে যেন প্রতিটি মুহূর্তেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে --- বৎসরান্তে আনন্দময়ীর আগমনবার্তা। শুধু স্মরণ করিয়েই নয়, ছায়ায়-প্রতিচ্ছায়ায় তাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাটির পৃথিবীতে --- দিক থেকে দিগন্তের কানায়-কানায় ভরা যত জলাশয়ের টলটলে জলে। শুনতে পাচ্ছো --- অশ্রুত সেই সানাইয়ের সুর। আগমনীর। মন উচাটনের প্রাণ টানটান করা সেই সুর ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে-বাতাসে। প্রাণময় পৃথিবীর সকল সজীব চেতনা তাই তো আজ উচ্ছলিত, উথলিত মেনকার সাথেসাথে। শরৎ-রাঙা এই সময়টায় গিরিরাজের উত্তুঙ্গ হিমালয়ে কিছুতেই আর মন টেকে না মেনকার। রাজরাণীর রাজৈশ্বর্য হেলায় সরিয়ে রেখে, নেমে আসেন সবুজ বাংলার পর্ণকুঠিরে। বঙ্গদেশের অতি সাদামাটা সাধারণ একজন জননীর রূপে। যার অন্তরে আর পাঁচজন মায়ের মতই তীব্র অপত্যস্নেহতাড়িত সদা-উতলা এক মাতৃসত্তা বিরাজমান। অস্থির উত্তেজনায় প্রতীক্ষা করেন তিনি কন্যা উমার জন্য। কৈলাশ থেকে উমা আসবে বাপেরবাড়িতে। একবছর পরে। তিনটি দিনের জন্য। উমার পথচেয়ে মেনকার এমন আকুলিবিকুলি প্রতীক্ষা --- হয়তো সেই স্মরণাতীত যুগ থেকেই! কিন্তু মধ্যযুগের শেষভাগে --- অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে উমা-মেনকা সহসাই যেন ধরা দিয়েছিল শাক্তপদাবলির দিকপাল পদকর্তাদের চোখে। রামপ্রসাদ সেন। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। রামলাল দাস। রসিকচন্দ্র রায়। দাশরথি রায়। হতে পারে, বৈষ্ণবসাধকদের মতই শাক্তসাধকেরা সেইসময় তাদের সাধনমার্গের অবলম্বন হিসেবে অনাবিল বাৎসল্যকেই বেছে নিয়েছিলেন। নিবেদিত-প্রাণ সেই অনন্য-সাধনায় বশীভূত দেবীমাতৃকা অকুণ্ঠিতচিত্তে তার জগজ্জননী রূপ পরিহার করে ধরা দিয়েছিল ভক্তহৃদয়ের স্নেহজালে। তাই স্বর্গীয় চরিত্র ---- দূর্গা, চণ্ডিকা, কালিকা --- মানব-দেবের অসীম-দূরান্তর ঘুচিয়ে অবলীলায় হয়ে উঠেছিল বঙ্গদেশের আপনজন। কখনো কন্যাসমা। এইসব শাক্তসাধকেরা ভাবজগতের ঐশীসাধনার সমান্তরালে নিরলস সমৃদ্ধ করে গেছে বাংলা সাহিত্যকেও। বাল্যলীলা, আগমনী, বিজয়া ইত্যাদি বারোটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হওয়া সমৃদ্ধ বাংলাসাহিত্য পদাবলী --- তারই ফলশ্রুতি। মাতা মেনকার কন্যা উমার সাথে মিলিত হওয়ার, তার সাথে সাক্ষাৎ পাওয়ার সুতীব্র ব্যাকুলতাই ফুটে উঠেছে শাক্ত পদাবলীর আগমনী পদগুলির পরতে পরতে। অন্যদিকে চারদিন পিতৃগৃহে থাকার পর কন্যার আবার কৈলাশে প্রত্যাবর্তন, এবং সেই বিচ্ছেদবেদনার কারণে মাতৃহৃদয়ের যে হাহাকার ---- তাই উপজীব্য হয়ে উঠেছে "বিজয়া" পদগুলির মধ্যে। এই অনবদ্য পদাবলী-সাহিত্য সৃষ্টির ভাবনা যতটা না স্বর্গীয় তার চেয়ে অনেকবেশি সামাজিক এবং মানবিক।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসতত্ত্ব অনুসরণ করেই শাক্ত পদাবলীর সৃষ্টি। তাই শাক্তপদাবলীতেও ভক্তিরসেরই প্রাধান্য। শাক্ত-শাস্ত্রমতে এই ভক্তিরসকে আবার পাঁচটি রসরূপে কল্পনা করা হয়েছে, যথা --- বাৎসল্য, বীর, অদ্ভুত, দিব্য ও শান্ত। শক্তিসাধনায় ভক্তিভাবের প্রধান উৎস হলো দিব্য মাতৃভাব। তাই শক্তিসাধনার যে স্বরূপ আমরা রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তের মতো শাক্তকবিদের অবিস্মরণীয় সৃষ্টির মধ্যে প্রত্যক্ষ করি তা' হলো --- ভক্তিব্যাকুল অন্তরের সবটুকু উজার করে "মা" "মা" বলে ডাকতে ডাকতে ব্রহ্মময়ীর চরণতলে আত্মসমর্পণ করা। তাকে পাবার জন্য পাগল হয়ে ওঠা। কিন্তু ঘটনা হলো --- শুধু দিব্য মাতৃভাবই নয় --- কোথাও কোথাও বাৎসল্যরসের মাধুর্যেও উজ্জ্বল এই শাক্তপদাবলীর গীতিকাব্যগুলি। আসলে শাক্তপদাবলী দুটি ধারায় প্রবাহিত। একটি দেবীকালিকা বা শ্যামাকেন্দ্রিক শ্যামাসঙ্গীত। অপরটি দেবীচণ্ডিকা বা উমাকেন্দ্রিক উমাসঙ্গীত। পদাবলী-সাহিত্যের এই উমাসঙ্গীত ধারায় আমরা কিন্তু সুস্পষ্টভাবে বাৎসল্যরসের প্রভাব লক্ষ্য করি। এখানে উল্লেখযোগ্য --- বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়া --- মূলত এই তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত উমাসঙ্গীতকে শাক্তপদাবলীতে সঙ্গীত হিসেবেই ধরা হয়েছে। আগমনীকে আবার দুটো ভাগে ভাগ করা যায় ---- পূর্ব আগমনী ও উত্তর আগমনী। পূর্ব আগমনীর সূচনা শরৎকাল শুরুর অব্যবহিত পর থেকেই। কন্যা উমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মা মেনকার আকুলতা, মেয়েকে স্বপ্নে দর্শন, তাকে শ্বশুরালয় থেকে নিয়ে আসার জন্য স্বামী গিরিরাজের কাছে অনুনয়-বিনয়, ভিখারী স্বামীরঘরে মেয়ের দুর্দশাচিত্র কল্পনা, গিরিরাজের কৈলাশযাত্রা, মেয়ের সাথে বাবার সাক্ষাৎ এবং মহাদেবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা --- এই পর্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এইপর্যায়ের প্রধান দুটি চরিত্র হলো --- মেনকা এবং গিরিরাজ। উত্তর-আগমনী পর্যায়ে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর মা-মেয়ের আনন্দঘন মিলন, উচ্ছ্বাস, মানাভিমান ইত্যাদি দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। মেনকা আর উমাই হলো এই পর্যায়ের প্রধান চরিত্র।
বর্ষাঋতুর অবসান নিশ্চিত হওয়ার সাথেসাথেই, বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতি আবার উজ্জীবিত হয়ে ওঠে আকাশে-বাতাসে ভেসে আসা শরতের আগমনীবার্তায়। বছর ঘুরে আবার এলো শরৎ। গোটা একটা বছর দেখাসাক্ষাৎ নেই মেয়েটার সাথে! উমার চাঁদমুখখানি একটিবার দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে মায়ের মন। শরতের আগমনের সাথেসাথে আজ তাই বড্ড উতলা মেনকা। মেয়ের একটু ছোঁয়া পেতে তার যেন আর তর সয় না!
"শরতের বায়ু যখন লাগে গায়
উমার স্পর্শ পাই, প্রাণ রাখা দায়।"
কাজে মন নেই। উদাস চিত্ত। সবসময়ই ভাবে --- কবে যে আবার মিলিত হবে মেয়ের সাথে! যত দিন যায়, একদিকে যেমন মেয়েকে কাছে পাওয়ার পুলকিত উত্তেজনায় তীব্র হতে থাকে চিত্তচাঞ্চল্য, অন্যদিকে তেমনি কঠিন হয়ে ওঠে সেই সুতীব্র চঞ্চলতাকে কাতরপ্রাণে এমনতরো বয়ে বেড়ানো! বস্তুত, উমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে মেনকার সারাটা বছরের প্রতিটা মুহূর্ত কাটে! বিয়ে কী বস্তু --- বুঝে ওঠার আগেই মাত্র আট বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল উমার। গৌরীদান প্রথা মেনেই এই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল! সেযুগে পৌরাণিক আখ্যান অনুসারে বাল্যবিবাহকে মহিমান্বিত করতেই প্রচলিত ছিল এই গৌরীদান প্রথা। পিতামাতার কাছে এই প্রথা মেনে কন্যার বিবাহ দেওয়া --- একটি অতিশয় পুণ্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হতো। এহেন পুন্যকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে ধনাঢ্য পিতা তার আদরিণী কন্যাকে হতদরিদ্র পাত্রের হাতে সম্প্রদান করতে পিছপা হতেন না। গিরিরাজ তার কন্যা উমাকেও বিবাহ দিয়েছিলেন হতদরিদ্র, নেশাগ্রস্ত, বর্ষীয়ান মহেশ্বরের সাথে। সংসারবিমুখ দেবাদিদেব সারাদিন ছাইভষ্ম মেখে ভূতপ্রেত পরিবৃত হয়ে ঘুরে বেড়ান শশ্মানে-মশানে! সুলোচনা, সুবদনা, অসামান্য রূপলাবণ্যে অপরূপা মেয়ে তার উমা ---
"মায়ের রূপের ছটা সৌদামিনী
দিন যামিনী সমান করেছে।"
তার কিনা এমন স্বামী! ভাবতে, মেনে নিতে কষ্ট হয় মেনকার। স্বামী তো সারাদিন ভবঘুরের মত ঘুরেঘুরে বেড়ায়। নেশাভাঙ করে। হয়তো তার মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকায় না কখনো। কত দুঃখকষ্টেই না সতীন নিয়ে ঘর করতে হয় বেচারিকে! কল্পনায় চাক্ষুষ করা সন্তানের সেই অপরিসীম ক্লেশভোগ --- যেন ফালাফালা করে দিয়ে যায় তার মাতৃহৃদয়কে। উৎকণ্ঠায় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে মনে মনে। স্বামীকে সামনে পেয়ে একরকম প্রতিজ্ঞাই করে বসেন ----
"গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।
বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয় ---
এবার মায়ে-ঝিয়ে করব ঝগড়া, জামাই বলে মানব না।"
তবুও মায়ের প্রাণে স্বস্তি নেই! শতকাজের মাঝেও মন পড়ে থাকে সেই মেয়েরই চিন্তায়। মন যেন তার বারবার বলে ওঠে --- মেয়ে তার ভালো নেই! জাগ্রত মুহূর্তগুলো তার সদা অশান্ত --- উদ্বেগে উচাটনে। রাতে ঘুমিয়েও নিস্তার নেই। দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠে। আতঙ্কিত গলায় স্বামীকে ডেকে তুলে বলেন ---
"আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে
গিরিরাজ, অচেতনে কত না ঘুমাও হে
এই এখনি শিয়রে ছিল, গৌরি আমার কোথা গেল হে।"
তার আদরের উমা স্বপনে দেখা দিয়েই অন্তর্হিত হয়েছে। ভিখারীর সংসারে অভাবের জ্বালায়, সতীনের গঞ্জনায় বাছা তার নিশ্চয়ই খুব কষ্টে আছে! স্বপ্নে দেখা মেয়ের মুখখানি দেখে তেমনি মনে হয়েছে তার। মায়ের কাতর প্রাণে কু ডাকে! তার আদরের দুলালি আর বুঝি সহ্য করে উঠতে পারছে না ---- দিনরাত দুর্বিষহ পরিশ্রম। ভয়ানক দুর্দশা। বদলে গিয়েছে তার চেহারা! কালি ঢেলে দিয়েছে তার সোনার বরণে! চোখের জলে বুক ভাসিয়ে স্বামীকে জানায় তার সেই দুঃস্বপ্নের কথা। তার আশঙ্কার কথা। ----
"বাছার নাই সে বরণ, নাই আভরণ,
হেমাঙ্গি হইয়াছে কালীর বরণ।
হেরে তার আকার চিনে ওঠা ভার
সে উমা আমার, উমা নাই হে আর।"
শুধুমাত্র স্বামীকে তার আশঙ্কা-উদ্বেগের কথা শুনিয়েই স্বস্তি খুঁজে পান না মেনকা। তার কাছে করুণ আকুতি জানান মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য ---
"যাও যাও গিরি অনিতে গৌরি
উমা বুঝি আমার কাঁদিছে।
উমার যতেক বসন ভূষণ
ভোলা বুঝি সব বেচে খেয়েছে।"
বাপ আর মায়ের ভাবনায়, সব যুগেই, কোথাও যেন একটা ফারাক থেকে গেছেই। সন্তানের স্বার্থে মা কখনো কোথাও এতটুকুও আপোস করে না। সমাজ-সংসার এটা খুব ভালোই জানে, হয়তো বিশ্বাসও করে যে --- এমন ব্যাকুলতা মাকেই সাজে। বাপকে বুঝি ততটা নয়। সাত-পাঁচ ভেবেই তাকে পা ফেলতে হয়। কখনো সাবধানে, কখনো সতর্কতায়। তাই মেনকার আবেদনে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিতে পারেন না গিরিরাজ। মেয়ে তার আটবছর বয়সেই কৈলাশে স্বামীর ঘর করতে চলে গেছে। মেয়েকে তিনিও দীর্ঘদিন দেখেন নি। তার বুকেও বিচ্ছেদের কাতরতা। কিন্তু তিনি ভালোমতই জানেন --- শরৎঋতুর শুক্লাসপ্তমীর আগে উমাকে কৈলাশ থেকে নিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। তাই তিনি মেনকার অনুরোধে কোনো তৎপরতা দেখান না। নিশ্চুপ থাকেন। স্বামীর এই নিরুৎসাহী নিরবতা অসহ্য ঠেকে মেনকার কাছে। বিরক্ত হন। ক্ষোভে-দুঃখে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেন তাকে ----
"আজি কালি করে দিবস যাবে
প্রাণের উমারে অনিবে কবে?
প্রতিদিন কি হে আমায় ভুলাবে
এ কি তব অবিচার।"
অবশেষে শরৎ সমাগত। ঘনিয়ে আসে শুক্লাসপ্তমীর তিথিও। প্রতীক্ষা শেষ হয় মেনকার। শেষ হয় তার দুর্বিষহ উৎকন্ঠার মুহূর্তগুলোও। বছর ঘুরে আবার এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ --- উমার পিতৃগৃহে আগমনের। শুধু মেনকার গৃহেই নয়, উমাকে বরণ করতে চতুর্দিকে সাজসাজ রব পড়ে গেলো ----
"নগরী-রমণী উলু উলু ধ্বনি আনন্দে দিচ্ছে বারে বারে।
চল, বরণ করিয়া গৃহে আনি গিয়া"
এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে ---- আজ আমরা দেবী দুর্গার যে রূপ দেখি, তা' হলো মার্কেন্ডেয় পুরাণ বর্ণিত দেবীর অসুরনাশিনী রণরঙ্গিণী রূপ। পদাবলী-সাহিত্যের শাক্তকবিগণের কাছে দেবীর ওই ভয়ঙ্করী রূপের চেয়ে কোনো শান্তভাবের রূপই বেশি পছন্দের ছিল। আর এই পছন্দের বার্তাটুকু কেউ কেউ খুব স্পষ্ট করেই ব্যক্ত করেছেন তাদের রচনায়। যেমন --- রসিকচন্দ্র রায়ের লেখা একটি সঙ্গীতে আমরা মেনকার মুখে শুনতে পাই -----
"গিরি, কার কণ্ঠহার আনিলে গিরিপুরে?
এ তো সে উমা নয় --- ভয়ঙ্করী হে, দশভূজা মেয়ে!
** ** ** **
মুখে মৃদু হাসি, সুধারাশি হে, আমার উমাশশীর;
এ যে মেদিনী কাঁপায় হুঙ্কারে ঝঙ্কারে।
হায় এ হেন রণ-বেশে, এল এলোকেশে,
এ নারীরে কেবা চিনতে পারে!"
আবার দাশরথী রায়ের পাঁচালীতে দেখি ---- দেবীকে অমন ভয়ঙ্করী মূর্তিতে দেখে, কন্যা হিসেবে তাকে গ্রহণ করার তীব্র অনীহা ঝরে পড়েছে মা মেনকার কণ্ঠে ----
"কৈ হে গিরি, কৈ সে আমার প্রাণের উমা নন্দিনী!
সঙ্গে তব অঙ্গনে কে এলো রণরঙ্গিণী?"
শশীভূষণ দাশগুপ্ত তার "ভারতের শাক্ত-সাধনা ও শাক্তসাহিত্য" গ্রন্থে এইবিষয়ে খুব সুন্দর বলেছেন ---
"কিন্তু একটু লক্ষ্য করিলেই দেখিতে পাইব, জল ও দুগ্ধের মিশ্রণের ভিতর হইতে হংস যেমন দুগ্ধকেই পান করিবার চেষ্টা করে, বাঙালীর কবিমনোহংসও তেমনই ভাবে মায়ের মধুরূপিণী ও ভয়ঙ্করী মূর্তির মিশ্রণ হইতে সহজাত প্রবণতাবশে মধুরূপিণীকেই বাছিয়া আস্বাদন করিবার চেষ্টা করিয়াছে।"
তাই আগমনীর দেবী পৌরাণিক না হয়ে উঠে, মেয়ের রূপে হয়ে উঠেছে অতি ঘরোয়া ও সামাজিক।
মেয়েকে কাছে পেয়ে আনন্দ-আতিশয্যে মায়ে যেন আত্মহারা। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া আকাশের চাঁদটা যেন আবারো ফিরে পেয়েছেন মেনকা! এক বৎসরকালের বিচ্ছেদ-যাতনা অবসানের পর এমন মধুর মুহূর্তটি --- এককথায় যেন অপার্থিব! কত কথা, কত প্রশ্ন মায়ের --- এক নিঃশ্বাসে যেন সবকিছু বলে ফেলতে চান তিনি। সেইসঙ্গে ঝরে পড়ে কতদিনের সঞ্চিত অভিমানও ---
"কেমনে মা ভুলেছিলি এ দুঃখিনী মায়?
পাষাণ নন্দিনী তুইও কি পাষাণীর প্রায়?
সম্বৎসর হলো গত, তোর বিরহে অবিরত
কেঁদেছি কহিব কত, আমি মা তোমায়।"
তারপর? আনন্দস্রোতে কোথা দিয়ে যেন ভেসে গেল তিন-তিনটে দিন। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী। রাত পোহালেই আবার উমা ফিরে যাবে কৈলাশে! মায়ের প্রাণে আবার ঘনিয়ে আসে বিষন্নতা। উমার আসন্ন বিদায়-মুহূর্তটিকে স্মরণ করামাত্রই তার ব্যাকুল-হৃদয় নিঙড়ে বেরিয়ে আসে ----
"কাল এসে, আজ উমা আমার যেতে চায়!
তোমরা বলগো, কি করি মা,
আমি কোন পরাণে উমাধনে মা হয়ে দিব বিদায়।"
বেদনায় মেনকার মাতৃঅন্তর যখন এক গভীর শূণ্যতার অনুভবে হা-হুতাশ করে ওঠে, তখন নবমীর রাতকে ধরে রাখার জন্য সে কায়মনোবাক্যে রত হয় করুণ প্রার্থনায় ----
"রজনী জননী, তুমি পোহায়ো না ধরি পায়,
তুমি না সদয় হলে উমা মোরে ছেড়ে যায়।"
তবু বৃথা এ প্রার্থনা! অনভিপ্রেত সেই মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে! নবমীর রাত পোহায়! বুকখালি করে ঝরে পড়ে মেনকার দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত আঁচে মাতৃচেতনায় আবার জেগে ওঠে যুগ-যুগান্তরের সেই নিষ্ঠুর উপলব্ধি ---
তণয়া পরের ধন বুঝিয়া না বুঝে মন,
হায় হায় এ কী বিড়ম্বনা বিধাতার।
অবশেষে সেই চরম মুহূর্ত! উমার বিদায়ের ক্ষণ! বুকে দুঃখ থাকে তবু সত্যিকে মেনে নিতেই হয়। হৃদয়ের এমনই স্বভাব যে --- বারেবারে স্নেহদূর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষকে তার যুক্তিবোধ দিয়েই আবার শক্ত করতে হয় নিজেকে। মেনকার এসব অজানা নয়! তবু পশুপতি যখন উমাকে নিতে আসে, বুকফাটা কষ্টের একটা ঘোরের মধ্যেই যেন আর্তনাদ করে ওঠে ---
"বিছায়ে বাঘের ছাল দ্বারে বসে মহাকাল,
বেরোও গণেশ-মাতা, ডাকে বারেবার।
তব দেহ হে পাষাণ, এ দেহে পাষাণ প্রাণ,
এই হেতু এতক্ষণ না হলো বিদায়।"
কিন্তু মহাকালের কাছে বৃথা সে আর্তনাদ ---
"শুণিয়া না শুনে কাণে, ঢলে পড়ে হাসিয়ে"
অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে, মেনকা অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় জানায় মেয়েকে ---
"এস মা, এস মা উমা, বলো না আর "যাই" "যাই"।
মায়ের কাছে, হৈমবতি, ও-কথা মা বলতে নাই।
বৎসরান্তে আসিস আবার, ভুলিস না মায়, ওমা আমার।
চন্দ্রাননে যেন আবার মধুর "মা" বোল শুনতে পাই!"
রবীন্দ্রনাথের গতিশীল ভাবনায় শাক্ত পদাবলীর এই "আগমনী-বিজয়া" যেন কোনো চিরন্তনের অমলিন দ্যোতনা।
"আমাদের শরতে আগমনীটাই ধুয়া। সেই ধুয়াতেই বিজয়ার গানের মধ্যেও উৎসবের তাপ লাগিল। আমাদের শরতের বিচ্ছেদ বেদনার ভিতরেও একটা কথা লাগিয়া আছে যে, বারেবারে নূতন করিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়, তাই ধরার আঙিনায় আগমনী গানের আর অন্ত নাই। যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরিয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড়ো উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়ার উৎসব।"
এই কালজয়ী আগমনীর দুর্বার আবেদন আজো অমলিন বাঙালির হৃদয়ে। আজো মেনকার মাঝে গোটা বাঙালির মাতৃসত্তা বারবার খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। বছরে বছরে নিয়ম করেই শরৎ আসে। আসে আকাশে-বাতাসে-নিসর্গের রূপান্তরে। ভাবান্তরে। সময়বদলের সূত্র মেনেই। সময়ের সাথে বদলে যায় মানুষের চিন্তা, ভাবনা, অনুভব। আজকের মানুষের চেতনায় হয়তো অনেকটাই বদলে গেছে সাবেক শরতের ভাবনা-ধারণাগুলো। কিন্তু সবখানি নয়। বাংলার পর্ণকুঠিরে, মফস্বলের পাকা গৃহে, নগরীর বহুতল ফ্ল্যাটে ---বাঙালির সংসারে সংসারে --- মেনকারা আজো পার্বতীদের পথ চেয়ে থাকে শারদোৎসবের তিনটি দিন। এই তিনটে দিন শ্বশুরবাড়িতে মন বসে না আজকের উমাপার্বতীদেরও। শরতের আগমনের সাথে সাথেই মা-মেয়ের মনে শুরু হয়ে যায় এমন উচাটন --- যেন চিরন্তনের নিয়মেই। যা প্রকারান্তরে বয়ে চলেছে আগমনীর সুরে সুরে।
ঋণ স্বীকার :
"ভারতের শাক্ত-সাধনা ও শাক্তসাহিত্য"
শ্রী শশীভূষণ দাশগুপ্ত
"শাক্ত পদাবলী"
ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়
"শাক্ত পদাবলী - সাধনতত্ত্ব ও কাব্য বিশ্লেষণ"
শ্রী ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য
"রস প্রসঙ্গে শাক্তপদাবলি"
ড: প্রদীপ বিশ্বাস
*************************
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন