প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

অ ণু গ ল্প
মাত্র কয়েকটা ঝুপড়ি, বিশাল বিশাল অট্টালিকা রঙ বাহারি রঙের মধ্যে বিচিত্র ব্যালকনি, গলিটা চওড়া হলেও বিশেষ গাড়ি চলে না পাড়ার ছেলেরা সকাল বিকেল ক্রিকেট খেলেনামী দামী পদের অফিসার ও মালিকের সমাবেশ। কত উন্নয়নের মাথা বসে আছে এই গলিতেই, তার মধ্যে পলেথিনে মোড়া মাত্র কয়েকটা ঝুপড়ি।
কলকাতা যখন জেগে ওঠে সেই শরৎ উৎসবে পাড়াতে পাড়াতে বাঁশ পড়ে, ফ্লাটের করিডোরে উদয় হয় এই বৌদি, ওই বৌদি, সেই দাদা, কচিকাঁচা: সকাল অপেক্ষা বিকেলে, কিম্বা ছুটির দিনে জেগে ওঠে বিদ্যাসাগর সরণির এ-মাথা সে-মাথা। ঝুপড়ি কমে যায়, রাস্তা বড় হয় আপ ডাউন দুই সার মানুষের স্রোত, মাঝখানে বাঁশের ব্যারিকেট, তারপরে দুই ধারে পাড়ার চলাফেরা, তারপরে ঝুপড়ির পরিসর ঢাকা পড়ে রঙিন কাপড়ে। পুজোর মাসে পড়া কম - খেলা, আড্ডা, রিয়ার্সাল পাড়ার বৌ ও মেয়েদের রাতে চেয়ার পেতে গল্প হা হা, হিঃ হিঃ, গলা তুলে হাঁক ডাক, ঠাট্টা, ইয়ার্কি সুট করে আড়ালে গিয়ে একটু আলাপ, খুনসুটি ঝুপড়ির ছেলেমেয়েরাও মিশে যায় দুর্গা উৎসবে সন্ধে থেকেই খেলা, এ পাড়া সে পাড়া ঘোরাঘুরি, ফাঁক বুঝে যে যার মতো ভাত বেড়ে খেয়ে যাওয়া, আবার খেলা, গল্প, পাড়া ঘোরা, হাসি ঠাট্টা, দেখা।
তপতীর দশ বছরেই বুকটা একটু বড় হয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে তার মেয়েবেলার চিন্তা মা বাবা কি আর লেখা জোকা করে রেখেছে,হয়তো বারো তেরো হবে, ওসব তো হয়ে গেছে,রেখা বলে, সাবধান ছেলেরা চটকে দেবে ... মেয়ে বেলার বেলুন ফোলে পুজোর খোলা মেলায় চোখ চলে যায় এপাশ ওপাশ, কোন ছেলে ...কোন ছেলে চেয়ে আছে, কেবল তার দিকে!
হঠাৎ মেয়ে বেলা এসে বদলে দিল খেলামেলা মেশা বন্ধু বিষয় পুজোর দল বল। কটা দিন ব্যস্ত ভীষণ দিনে ডাস্টবিন দখল পুজোর কটাদিন প্যাকেট ভরে যাবে না খাওয়া ক্যাটবেরি, আইসক্রিম, বিরিয়ানি, আরো কত কি তে প্লাস্টিক, কাগজ, এটা ওটা, পুজোর পরেও আছে এখন কেবল দলে থাকা, কেবল এলাকা ধরে রাখা-লড়াইয়ের জন্য চাই সাহস আর দু চারটে ছেলে। ছেলেরা থাকলে অনেক সুবিধা আছে এই সময়ে কোথায় বড় লোকের ছেলে মেয়েদের না পরা প্রায় হাফের থেকে বেশি নতুন পোশাকআশাক বিতরণ হচ্ছে, কোথায় কম্বল দেবে, কোথায়... সব খবর নিয়ে আসবে ওরা সকাল বিকেল। দল করতে না পারায় আগের বছরটা মার গেছে জোগাড় হয়নি জামা কাপড়, শীতের চাদর বুকের লজ্জা আর শীত তাড়াতে হয় ছেঁড়া ওড়নায়।
এবার পুজোয় কনাদি একটা দারুন গান তুলেছে – ‘উমা এলো উমা এলো থাকবে না আর কোনো কষ্ট’, তপতীর খুব ভালো লাগে, গানটা শুনতেই দল বেঁধে রিয়ার্সাল দেখতে যাওয়া, নাচও হবে অনেক...
রাত হলে মেয়েবেলার অজানা ভয় তাড়া করে দুটো খেয়ে রোজ আবার দলে ভেড়া, আড্ডা চলে। তপতীর পছন্দ নয় সমবয়েসীদের সঙ্গে মিশে এখানে ওখানে শুয়ে পড়ে রাত কাটিয়ে দেওয়া কার কি আছে মনে, কত কি না ঘটে এই রাতে, শালা বাপটা রাগ করে বলে শুতে গেলে মার দুচ্ছাই। কি আর করা যাবে ঘুম পেলে কোন বাড়ির আড়ালে অন্ধকার দেখে ঝুপ ঝাপ শুয়ে পড়া কাগজ পেতে। ঘুমও আসে ছুটে দু চার কথার মধ্যে দু চোখ জুড়ে তবু মেয়েবেলা জেগে থাকে শরীর আগলে পাহারায় হঠাৎ মনে হল বুকে কি যেন! ঘুম ভেঙে তপতী দেখে পিন্টুর হাত তার জামার ভেতর। চিৎকার করে। সবাই জেগে ওঠে, বেশি গোলমাল করা যাবে না। বাবুদের ঘুম ভেঙে গেলে আর থাকতে দেবে না। পরের দিন বিচার হবে -- এই আশায় আশায় চেপে থাকা, মনে কেবল দারুন ধোলাই হবে। না, দুপুরে দেখা হল রেখা, সন্ধ্যা, মালতীর সঙ্গে ওরা গম্ভীর ভাবে বলল, তাকে নতুন দল খুঁজতে হবে, পুজোর মুখে কিছুতেই পিন্টুকে ছাড়া যাবে না ।
হঠাৎ আকাশ থেকে ঝরে পড়ল একতাল কালো। এখন কে তাকে নেবে দলে টেনে? কার কাছে বলি, কি করি, কি করি... মন খারাপে সারাদিন কাটে : বিকেলের নরম আলোয় প্যান্ডেলের ধারে কাছে একে একে যে যার দলে ভিড়ে করছে জটলা লক্ষ্য রাখতে হবে কার হাত থেকে কি পড়ল তারপর ছোঁ মেরে তুলে নিতে হবে ঝোলার ভেতর। প্যান্ডেলের পিছনে নির্জনে দাঁড়িয়ে ছিল তপতী একা। রেখা এলো উদ্ধত সেখানে, নিরুপায় তার হাত ধরে গলা নামিয়ে বলল সে, যা হবার হয়ে গেছে কাউকে যেন বলিস না, পিন্টুটা ভারী অসভ্য।
রেখা হেসে থুতনিটা নাড়িয়ে আদর করে চলে গেল। পুজোর বোধন হল সন্ধের আলোয় আলোয় হারিয়ে গেল সে তার মেয়েবেলার অলিতে গলিতে।
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন