প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

ছো ট গ ল্প
কি হলো মা, তুমি নাকি ডেকেছো আমাকে?
বলতে বলতে দীপ মায়ের ঘরে ঢুকে দেখল তার মা ওষুধের বাক্স খুলে কিছু একটা খুঁজছেন।
সেই দিকে তাকিয়ে সে বললো- এই তো দুই দিন আগেই আমি প্রেস্কিপশন মিলিয়ে তোমার সব ওষুধ এনে দিয়েছি, আবার কী হলো? আবার নতুন কিছু বাধিয়ে ফেললে নাকি?
দীপের এই ধরনের কথায় তার মা এখন মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাই বিশেষ কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বললেন, না না ওসব কিচ্ছু না, তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে তাই দাদুভাইকে বলেছিলাম তোকে ডেকে দিতে। আগে সুস্থ হয়ে একটু বোস তারপর সব বলছি।
দীপ মায়ের বিছানার পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে একটু বিরক্তির সুরে বললো, দেখো মা কাল অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে তার জন্য একটা প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে যা বলবে একটু তাড়াতাড়ি বলো।
তবে অনুরোধ করছি মেঘনাকে নিয়ে শুরু কোরো না ও এমনিতেই রোজ কানের কাছে ঘেনর ঘেনর করে বিরক্ত ধরিয়ে দিচ্ছে, তুমিও আবার শুরু কোরোনা ।
শিখাদেবী, মানে দীপের মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু বিষাদ মিশ্রিত মুচকি হেসে বললেন-
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে তোদের বেশ অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক । তবে বিশ্বাস কর আমার এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেইরে, কারণ আমি জানি আমি তোদের জায়গায় থাকলে আমারও এমনটাই হতো ।
এবার একটু থেমে গেলেন তিনি নীচে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন, ঠিক সেই সময় দীপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলে আবার শুরু করলেন- জানিস বাবু (শিখাদেবী আদর করে ছেলেকে বাবু বলে ডাকেন) আমি সমস্ত দিক ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই তোকে জানাতে চাই- মায়ের কথা শেষ করার আগেই দীপ বেশ জরের সঙ্গে বলে উঠলো- মানে, কি বলতে চাইছো? তুমি কি আবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবছো?
দয়াকরে ওসব কথা মাথায় এনো না মা, কারণ ও বাড়িটার অবস্থা যা হয়ে আছে, তাকে নতুন করে মেরামত করতে ফালতু ফালতু এক কাঁড়ি টাকা খরচ করার কোন শখ আমার নেই, তোমার যতো সব শ্বশুরের ভিটের স্মৃতি আগলে থাকার গল্প না থাকলে আমি কবেই ওটা বিক্রি করে দিতাম।
তাছাড়া তুমি ওখানে থাকলে তোমাকে মাঝেমধ্যে দেখতে যাওয়ার একটা ঝামেলা এসে যাবে, অসুস্থ হলে ওখান থেকে নিয়ে আসার অনেক ঝামেলা রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা, আর ওখানেও রাখা সম্ভব নয় কারণ ওখানে ঠিক মতো ডাক্তার, ওষুধপত্র কিচ্ছু পাওয়া যায় না সঙ্গে আত্মীয় স্বজনদের নানা কথাবার্তা – আরো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিল দীপ কিন্তু ছেলেকে মাঝপথে থামিয়ে শিখাদেবী বললেন, তোকে কি আমি ও কথা বলেছি, আমি ওসব কথা আগেই ভেবেছি।
দীপও এবার একটু জরের সঙ্গে বললো- ও তাই, তা বেশ ভালো কথা, তাহলে এখন বলো তুমি কি বলতে চাও?
শিখাদেবী ঠোঁটে একটুকরো হাসির ঝলক টেনে বললেন তোর আমার বান্ধবী বর্ণালীকে মনে আছে? ঐ যে তোর ছেলের স্কুলে যখন যেতাম তখন ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, এখন আর স্কুলে না গেলেও ওর সঙ্গে এখনো প্রায় ফোনে কথা হয়।
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে তা ভালো করেছ ওনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছ, ওনার সঙ্গে কথা বললে তোমারো একটু ভালো লাগবে।
হ্যাঁ, বলে শিখাদেবী বিছানার পাশের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বললেন, জানিস ও কিছু দিন আগে বেশ একা হয়ে গেছিল তবে এখন বেশ ভালো আছে। আসলে ওর ছেলে তো আগেই বিদেশে চলে গেছিল এখন নাতি- বৌমাও সেখানে চলে গেছে। ওরা চলে যাওয়ার পর ও একাই বাড়িতে থাকত, দুই বেলা দুইজন আয়ারও ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ছেলে-বৌমা কিন্তু কোনো কারণ বশত তারা আসতে না পারলে বেশ অসুবিধা হয়ে যেত, আর এমনটা প্রায়ই হতো। বিশেষ করে রাত্রেবেলা তো খুবই অসুবিধা হতো। আর শরীর খারাপ হলে তো কোনো কথাই ছিল না। তখন ও খুব ভেঙে পড়েছিল এবং খুব অসহায় বোধ করতো। তার পর ওর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী একটা বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ নেয়। ওই ডাক্তার বাবুই ওই বৃদ্ধাশ্রমটার কথা বলেন। তার পর ছেলে-বৌমাকে বুঝিয়ে এখন বেশ কয়েক মাস হলো ও ওই বৃদ্ধাশ্রমে আছে। ও বলছিল ও সেখানে খুব ভালো আছে, ওরা খুব যত্ন নেয়, এবং সমবয়সী অনেক বন্ধুও পেয়ে গেছে। তাদের নিয়ে খুব ভালোই সময় কাটে, একদম একাকীত্ব অনুভব হয় না।
দীপ মায়ের কথা শেষ করার আগেই একটু অভিমানের সুরে বললো, এ সব কি বলেছো তুমি, মানে কি বলতে চাইছো তুমি? আমরা তোমাকে এতো কষ্টদি যে তোমাকে এই সব কথা ভাবতে হচ্ছে। হ্যাঁ মানছি আমি কখনো কখনো একটু রূঢ় ভাবে বলে ফেলি আসলে নানা চাপে নিজেকে সামলে নিতে পারিনা তাই এমন ভাবে বলে ফেলি, কিন্তু বিশ্বাস করো একটুও মন থেকে বলি না আমাকে তুমি ক্ষমা করো মা, কথাটা বলতে গিয়ে ছেলের কন্ঠ ভারি হয়ে আসে।
ছেলের কথায় মা ধমক দিয়ে বললেন, ধুর পাগল আমি কি তাই বলেছি, এ সব বাজে অভিযোগ আমার স্বপ্নেও আসে না, তুই পুরো কথা না শুনেই যতো উলটো পালটা বকতে শুরু করলি, তুই আসল কথাটা বোঝার চেষ্টা কর। আমি এখন নিঃস্কর্মা, আগে তাও একটা কাজ ছিল তোর ছেলের স্কুলে যাওয়া এখন সেটাও আর নেই, ও এখন স্কুল গাড়িতে একাই যাওয়া আসা করতে পারে, আমি সারাদিন একা থাকি, এতো পেসার হাই সঙ্গে হাইসুগার কোথাও একা যেতে ভয় পায়, তোরাও চিন্তা করিস।
আর বাবু তুই তো জানিস আমি চিরকালই স্বাধীনচেতা মানুষ। আমি যখন স্কুলের চাকরিটাই জয়েন করে ছিলাম তোর ঠাকুমার তখন সে কি আপত্তি ঘরের বৌমার চাকরি করা নিয়ে, কারণ এ পরিবার রক্ষণশীল পরিবার এ বাড়ির মেয়ে-বৌরা কখনো কাজ করতে বাইরে যায় না। কিন্তু আমি সেসব কথায় কান দিয়নি যদিও তোর বাবা সঙ্গ দিয়েছিলেন তাই সম্ভব হয়েছিল।
তখন আমি বা আমরা আধুনিক ছিলাম তাদের কাছে, আজ তোরা আধুনিক আমরা পুরাতন, কাল তোর ছেলে-বৌমা আধুনিক হবে তোরা পুরাতন হবি। এটাই কালের নিয়ম একে বদলানো যায় না। আর এক কালের সঙ্গে আরেক কাল সমান্তরাল ভাবে চললেও মাঝে একটা শূন্য স্থান থেকেই যায়।
আর বাবা আমি তো এমন কিছু দূরে যাচ্ছি না, এই তো এই শহরের শেষ প্রান্তেই থাকবো তোরা যখন চাইবি আসতে পারবি এবং আমিও মন চাইলেই তোদের কাছে চলে আসবো তোদের বাবা বেঁচে থাকাকালীন গ্রাম থেকে যেমন আসতাম তেমনি।
আর একটা কথা এখানে খরচ খুব একটা বেশি না আমি যে পেনশন পায় তাতেই হয়ে যাবে, প্রথমে একটা এককালীন টাকা জমা দিতে হয় ওটা আমি আমার জমানো টাকা থেকে দিয়ে দিয়েছি। আমি জানি তোরা দুইজন যে পরিমাণ টাকা ইনকাম করিস তাতে আমার টাকা তোদের দরকার হবে না। আগামী মাসের এক তারিখে আমি ওখানে উঠবো ঐ দিন রবিবার আছে।
মায়ের কথা শেষ হলেও দীপ কিছু বলে উঠতে পারে না, শুধু নির্বাক হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে কারণ সে ভালো ভাবে জানে তার মা কতখানি আত্মসম্মানী। আর আজ এই মুহূর্তে তার মা শুধুমাত্র মায়ের আসনে নেই, তিনি এই মুহূর্তে তার শিক্ষা গুরুর আসনেও বসে তাকে বাস্তব জীবনের পাঠ পড়ালেন ভবিষ্যতের দিকে ইশারা করে।
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন