ভৌ তি ক গ ল্প
নরকের দরজা খোলা
নিনিয়া সুকথা
'এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন বর্মণবাবু?' সুমনের এরকম বেমক্কা প্রশ্নে একটুও বিব্রত বোধ করল না; কলকাতার অন্যতম কুখ্যাত, জমি-বাড়ীর দালাল, শ্রীযুত শুভম বর্মণ।
পিচ করে একটা নোনাধরা দেওয়ালের গায়ে, দোক্তাপোরা, ঝাঁঝিপানের পানের পিক ফেলে; টকটকে লাল চোখজোড়া গোল গোল করে, বর্মণ দালাল, সুমনকে খানিক চড়া সুরেই বলল,
'দেখুন ছার্, আপনার কলকাতায় সস্তা দামে, মাথা গোঁজবার ঠাঁইয়ের দরকার ছিল, তাই কত কষ্ট করে খুঁজে পেতে, এই হরেকেষ্ট মিত্তির লেনের এই ভাড়া বাড়িটা খুঁজে বার করলাম, আর আপনি বলছেন...'
সুমন বুঝে গেল, যে এ লোকের সঙ্গে কথায়, কথা বাড়বে, আর তার সত্যিই, নতুন নভেলটা লেখবার জন্য শান্তিতে বসে, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার, তাই কথা, আর না বাড়িয়ে, শুভমকে অগ্রিম টাকা কয়টা দিয়ে মানে মানে বিদেয় করল সে।
বাক্স বেডিং তার বরাবরই বেশি নেই। বরাবরই একটু ভবঘুরে স্বভাবের মানুষ সে, হাতের ময়লা ডাফেলটাতেই পোরা থাকে তার গোটা সংসার।
বাড়ীটার মালিক রাধাকান্ত মিত্র; বর্মণের দূরসম্পর্কের লতায়পাতায়, কেমন যেন একটা আত্মীয় হন। ওপরের তলার চাবিটা তাই ওর কাছেই গচ্ছিত রেখে গেছিলেন ভদ্রলোক; আর,যাবার সময় শুভম, সেই লোহার চাবিখানা তার হাতে সোপার্দ করে গেছিল। তাই সরু, আধ ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে, লোহার চাবিটা দিয়ে উপরের ঘরের পিতিঞ্জিরে তালাটা খুলতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তাকে।
ঘরটায় ঢুকে, আদ্যিকালের কালো স্যুইচ টিপে আলো জ্বালালো সে। করর করর শব্দ করে জ্বলে উঠলো হলদেটে বাল্ব খানা, আর জ্বলে উঠেই রুগ্ন আলোয় যথাসাধ্য ভরিয়ে দিতে চেষ্টা করল, গোটা ঘরটা।
এ ঘরের রঙটা কোনো এককালে, হলুদ ছিল সম্ভবত। তবে, বর্তমানে, আদ্যিকালের ধুলো আর নোংরা মিলেমিশে, তার আসল রঙ বোঝা বেশ দুষ্কর।
ঘরটার একপাশে একটা নড়বড়ে তক্তপোশ আছে। তাতেই, ডাফেল থেকে বার করা একটা পাতলা চাদর পেতে জুৎ করে শুয়ে পড়ল সুমন। লাঞ্চ সে, পথেই সেরে এসেছে। এবার শুধু আরামের পালা। কারণ সন্ধে না নামলে, তার আবার লেখা টেখা নামে না। ক্রমে ক্রমে সন্ধে নেমে এল, কল্লোলিনী কলকাতার বুকে। আর তারপর, হাতঘড়ির অ্যালার্মে ধড়মড়িয়ে উঠে, গোটাকতক আড়মোড়া ভেঙে, ডাফেল থেকে, তার লেখার ডায়েরি বার করে, এইবার লেখালিখি করতে বসল, সুমন।
লিখতে লিখতে কখন যে মধ্যরাত হয়ে এসেছে, খেয়ালই পড়েনি তার। টনক নড়ল, যখন তার ছোট্ট টেবিল ক্লক পিঁপিঁ করে, মিহিন আওয়াজ করে উঠল। ব্যাজারমুখে লেখা বন্ধ করে; সবে কলতলায় ঢুকে, হাতমুখ ধুতে যাবে। হঠাৎই ঝপ করে কারেন্টটা গেল চলে।
আর তারপর, তার সঙ্গে যা ঘটল, তার জন্যে শুধু সুমন কেন, কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষেই প্রস্তুত থাকার কথা নয়।
সুমন সবে, কলতলায় ঢুকেছে, আর ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই বাত্তি গুল। এদিকে হাতে করে টর্চ বা দেশলাই কিছুই আনেনি, তাই সে পড়ল, চরম বেকায়দায়।
সবে ভাবছে, এই কুপকুপে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কি করে বেরোবে; আচমকাই তার কানে, ভেসে এল চিঁ চিঁ করে অসম্ভব তীক্ষ্ণ একটা শব্দ, কানটা যেন জ্বালা করে উঠল তার। সে জ্বালা যে কী বীভৎস!! তা ভাষায় প্রকাশ করা এককথায় অসম্ভব। দু কান, সজোরে চাপা দিয়েও সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ছিল সেই শব্দতান্ডব।
শেষমেষ সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া গামছাটা কানে বেঁধে কোনোমতে নিজেকে সামলালো সে। এদিকে শব্দের তীব্রতর পারদ ক্রমশ চড়ছে। সুমন বুঝতে পারল, বেশিক্ষণ, তার গামছাটা তার কান দুখানাকে রক্ষা করতে পারবে না।
এ বারে, মরিয়া হয়ে সেই নিকষ অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বেরোনোর পর খুঁজতে লাগল সে। হঠাৎ করে, বাথরুমের দেওয়ালে একটা কাঠের দেরাজের পাল্লার মতন কিছুতে একটা হাত পড়ল তার।
বাঁচবার প্রাণপণ চেষ্টায়, দেহের সর্বশক্তি সঞ্চয় করে সজোরে সে আঘাত করল পাল্লাদুটোতে, একেবারে হাট হয়ে খুলে গেল সে দুটো। আর সেই দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো চোখে জ্বালা ধরালো তীব্র নীল আলো আর শয়ে শয়ে কালো কালো হাত। আর তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে টেনে নিল এক গভীর কালো গহ্বরে।
অতলান্ত সেই গহ্বরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুমন একটানা গড়িয়ে পড়তে পড়তে, যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল, সেইসব মানুষগুলোর বুকফাটা আর্তনাদ, যারা একে একে বলি হয়েছে তার সীমাহীন ঈর্ষার। সে তার ক্লাস সিক্সের বন্ধু উদয়ন মল্লিকই হোক কিংবা লেখালেখির জগতে, তার একমাত্র প্রতিস্পর্ধী সানন্দ রায়। এছাড়া এরকম আরো কত অচেনা আধচেনা চেহারা, যাদের প্রত্যেককেই সে সুপরিকল্পিতভাবে গুম-খুন করে, এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে আর তারপর, নিপুণ হাতে বেমালুম লোপাট করেছে প্রতিটি সাক্ষ্যপ্রমাণ।
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন