।। পুরাণে ইতিহাসে নারী।।
সেই বৈদিক যুগ থেকে মধ্য যুগের সূচনার পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল নারী মহিমায় উজ্জ্বল। তাই তো বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারী জাতির আদর্শ -সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী।ভুলিও না তোমার সমাজ বিরাট মহামায়ার ছায়া মাত্র।"।
ভারতের অতীত ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়-প্রাচীন সমাজে নারী ও পুরুষের মর্যাদা ছিল সমান সমান।শিক্ষার ভিত্তিতেই সমাজে নারীদের স্হান ও মর্যাদা নির্ধারিত হ'ত। মৈত্রেয়ী, গার্গী, খনা, লীলাবতী, লোপামুদ্রা,সীতা, সাবিত্রী প্রভৃতি নারীগণ কে সমকালীন সমাজ তেমন শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তেমনি এইসব মহীয়সী ললনাদের সংস্পর্শে ভারত বিশ্বরঙ্গমঞ্চের স্বর্ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ নারী মহিমায় ভাস্বর হলেও এমন একটি সময় এসেছিল তখন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাদপীঠে নারী শিক্ষার উপর ঘনকৃষ্ণ মেঘের কালো ছায়া নেমে আসে। ইতিহাসে সেটা হলো মধ্যযুগ।মধ্যযুগের সূচনাতে নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার আলোক বর্তিকাকে কৃষ্ণপক্ষের ক্রমপ্রসরিত অন্ধকার ধীরে ধীরে গ্রাস করতে আরম্ভ করলো। সমগ্র নারী জাতির উপর চরম অভিশাপের মতো নেমে আসে।মধ্যযুগ হ'ল ভারতীয় নারী সমাজের নিকট একটি সর্বব্যাপী অন্ধকারময় যুগ।শাসন ও শোষণের নিষ্ঠুর বর্বরতায় বৃহত্তর নারী সমাজ স্হান লাভ করলো আলোর অন্তরালে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তখন নারী প্রগতির জোয়ার, ঠিক তখনই ভারতবর্ষে চলছে নারী সমাজের অন্ধকারময় যুগ।
তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিচার করে একটি কথাই বলা যায়, নারী হয়ে গেল 'অসূর্যম্পশ্যা'। আজ নারী-প্রগতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কোনো মানুষ ই উপলব্ধি করতে পারবেনা মধ্যযুগের নারী সমাজকে কী নিষ্ফল বেদনায় হা-হুতাশ করে মরতে হয়েছিল। অনিবার্য ভাবেই নারী সমাজ কৌলিন্য প্রথা,বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ ও সতীদাহ প্রথার শিকার হল। কৌলিন্য প্রথার দৌলতে দশ বছরের নারী-শিশুকে তুলে দেওয়া হ'ত মৃত্যু পথযাত্রী অশিতিপর বৃদ্ধের হাতে।বাসর ঘরেই অনেক নারীকে বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হ'ত।আর সতীদাহ প্রথার অনিবার্য ফলস্বরূপ সেই সব কোমল নিষ্পাপ ফুলেদের তুলে দেওয়া হ'ত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায়। এই ভাবে কৌলিন্য প্রথা ও সতীদাহ প্রথার হিংস্র থাবার ছোবলে প্রাণ দিতে হয়েছে হাজার হাজার মধ্যযুগীয় ভারতীয় নারীকে। আবার বহুবিবাহ প্রথার ফলে নারী হয়ে গেল পুরুষের ভোগ্য পণ্য এবং পৈশাচিক লালসার শিকার। অনিবার্য ভাবে নারী সমাজে আর এক অভিশাপ নেমে এলো-যোগিনী ও দেবদাসী প্রথা। সমাজে বর্ণশ্রেষ্ঠ পুরুষের দল হরিজন, অনুন্নত সম্প্রদায় এবং গরীব পরিবারের যৌবনবতী মহিলাদের বহুভোগ্যা ও বহু বল্লভা করার এক অভিনব চক্রান্ত সৃষ্টি করলো। ধর্ম ও সাধনার নামে হাজার হাজার মহিলা এভাবে সমাজচ্যুত হতে থাকলো।মধ্যযুগে কুসংস্কার সমাজের বুকে এমন ভাবে চেপে বসেছিল যে সেদিন কোনো শাসক বা সমাজসেবী এই নির্যাতীত নারী সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে নি।
তারপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসারের ফলে ভারতের অসূর্যম্পশ্যা নারী সমাজ পুনরায় আলোর স্পর্শে আসার সুযোগ পেল। নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার ইতিহাসে ইউরোপীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নারী -সমাজের মধ্যযুগীয় অভিশাপের মুক্তি ঘটল। অভিশাপ মুক্তির জাগরণে এগিয়ে এলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মহান ব্যক্তি বর্গ। সতীদাহ প্রথা রদ হল।১৮৫৬সালে বিধবা বিবাহ প্রচলন হ'ল। এতসব সত্ত্বেও সমাজে পণপ্রথা আজ ও রদ করা সম্ভব হয়নি।কালে কালে সেই প্রথা নানা রঙে নানা রূপে প্রতি ফলিত হয় সমাজের বুকে আজ ও। আজ ও নারীদের উপরে দৈহিক ও মানসিক পীড়ন হয় নির্মম ভাবে। এক্ষেত্রে নারীরাই নারীদের প্রধান শত্রু। আজো এ সবের জন্য আন্দোলন করতে হয় এবং হবে ও। দৈহিক গুণে পুরুষেরা নারীদের দিক থেকে অনেক বেশি শক্ত সমর্থ , তাই উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত অনেক নারীকে চরম লাঞ্ছিত হতে হয়। নারী আন্দোলনে সার্থকতা আসতে পারে যদি পুরুষেরা নারীদের দিকে তাদের সহানুভূতির হাতটি বাড়িয়ে দেয়।
-----------------:-------------------
শেফালি সর, জনাদাড়ি, গোপীনাথপুর, পূর্ব মেদিনীপুর।৭২১৬৩৩