পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)
রাহুল আর নিশার প্রেম গত তিন বছরে জমে ক্ষীর হলেও বেকারত্ব মূল বাধা ছিল মিলনের পথে। নিশা ছোট থেকেই মা ভবতারিণীর ভক্ত । নিশা কোনদিন হাল ছাড়েনি, পূজা অর্চনার সাথে অনেক সংঘর্ষের লড়াই অবশেষে একদিন জয়ী হলো।
রাহুল হঠাৎ একদিন এসে বললো আমাদের বিয়েটা খুব শিগগিরই করতে হবে, একদম হাতে সময় নেই।
নিশা অবাক হতেই, রাহুল বললো, "চাকরি টা আমি পেয়ে গেছি নিশা সত্যিই" । নিশা আনন্দে আত্মহারা হতেই রাহুল বললো বন দফতরের কাজ,তাই বিয়ে করেই আমরা সোজা দার্জিলিং যাবো নিশা। একদম পাহাড়ি সবুজ পরিবেশে নতুন সংসারের সূচনা।
" দার্জিলিং পোস্টিং বাহ্ দারুণ ব্যাপার রাহুল। মা ভবতারিণী আমার কথা শুনেছে"- আনন্দে আত্মহারা নিশা।
" হ্যাঁ নিশা চাকরি, বিয়ে তার সাথে হানিমুনের ব্যবস্থাও তোমার ভবতারিণী একসাথেই করে দিয়েছে"- রাহুল জোরে জোরে এবার একটু অদ্ভুত হাসি হাসলো ।
সময় মতো বিয়ে হয়ে দুজনে দার্জিলিং পৌঁছালো। থাকার ব্যবস্থা ওখান কার কোয়ার্টার । নিশা কিছু দিনের মধ্যেই খুব সুন্দর ভাবে ঘর গুছিয়ে সংসার করতে শুরু করলো।
রোজ সকালে দুজনে প্রকৃতির শোভা দেখতে প্রাতঃভ্রমনে বেরায়। তাতে বেশ কিছুটা পথ হাঁটাও হয় আর আশেপাশের মানুষদের সাথে পরিচয় পর্ব সারা হয় । এই রকম এক সকালে মাঝ বয়সী এক দম্পতির সাথে আলাপ হয় । ওনারা বেশ মিশুকে, পরিচয় হওয়ার পর ওনারা একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলেন নিজেদের বাড়িতে চায়ের আমন্ত্রণে ।
জমিয়ে আড্ডার শেষে ফেরার সময় নিশা ওনাদের নিজের কোয়ার্টারে আমন্ত্রণ জানিয়ে এলো।
একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ ওই দম্পতি বেশ কিছু খাবার নিয়ে উপস্থিত হলো নিশাদের কোয়ার্টারে। নিশাও আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করলো। এরপর ওই দম্পতির ভদ্রলোক বললেন, রাতের খাবারের আগে আমাদের আনা খাবার তোমরা খেও কারণ এই খাবার আমাদের কূলদেবতার প্রসাদ।
রাতে ওই প্রসাদ খাওয়ার পর থেকেই দুজনের শরীর ভীষণ খারাপ হয় কিন্তু শারীরিক কষ্টের কারণ নির্ধারণ করা ওদের পক্ষে সম্ভব হলোনা । দুই দিন প্রায় ওরা ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারলো না,আচমকা কেমন যেন অঘটন। এরই মধ্যে ঘটল আর একটা ঘটনা, অদ্ভূত ভাবে এক অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হারিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল । বেশ কিছুদিন পরপরই এই রকম ঘটনা চলতে থাকে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে এইটা একটা রহস্য যেন। অনেক ইনভেস্টিগেশন করেও পুলিশ কোন ক্লু খুঁজে পায়না। সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যাপার যেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সেটা হলো, যে সমস্ত বাড়ির থেকে অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা হারিয়ে যাচ্ছিল সেই পরিবারের লোকেদের মুখে প্রসস্থ শান্তির ছায়া, এক অপার আনন্দ। কোথাও কোন শোকের ছায়া নেই। সবাই অবাক, ফিসফিসিয়ে আলোচনাও চলছিল এই ঘটনার ।
ইতিমধ্যে নিশা অন্তঃসত্ত্বা। নিশার অন্তঃসত্ত্বার খবরে ওই দম্পতি নিশার খুব খেয়াল রাখতে শুরু করে। ওনারা নিশা কে আশ্বাস দিয়ে বলে ,"তুমি এখন থেকে আমাদেরকেই নিজের মা বাবা মনে করবে, কোন সময় কোন দ্বিধা বোধ করবে না।"
রাহুল বরাবর একটু উচ্চাকাঙ্খী,হঠাৎ করেই রাহুলের ইচ্ছা আরো উঁচু পোস্ট । এই নিয়ে ওর মেজাজও বেশ বিগড়ে থাকে । ইদানিং নিশার সাথে কারণে আকারণে ঝগড়া,রাত ভোর বাড়ির বাইরে কাটানো শুরু হয় রাহুলের।নিশা জিজ্ঞাসা করলে এড়িয়ে যায় অনায়াসে।
এই অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে নিশা মা ভবতারিণীর শরণাপন্ন হয়। নিশার গর্ভমাস এগাতে থাকে আর নিশা অসুস্থ হতে থাকে। অদ্ভুত রকম এক শারীরিক অস্বস্তি । কারণ ডাক্তারদের ও অজানা।
আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নিশাকে এক রাতে রাহুল ওই দম্পতির বাড়ি থেকে প্রসাদ এনে খেতে বললো আর জানালো আজ রাতে ওই দম্পতির বাড়িতে যজ্ঞ হবে ওনারা ওদের যেতে বলেছেন । নিশা তৈরি হয়ে প্রসাদ মুখে দিয়ে রাহুলের সাথে দম্পতির বাড়ি পৌঁছালো। ঘরে ঢুকে দেখে যজ্ঞের আগুন জ্বলছে। ঢোকার পরে রাহুলই বাইরের দরজা বন্ধ করলো।
নিশা লক্ষ্য করলো ওই দম্পতি যেন ওকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। ওনারা আজ অন্য রকম বেশ ধরেছে । ওনাদের পুজো করাটাও কেমন যেন অদ্ভুত । নিশার বেশ ভয় করতে শুরু করলো। হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। মাথাটা যেন ঘুরাচ্ছে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে আর ওর এই অবস্থা দেখে রাহুল আর ওই দম্পতি অদ্ভুত ভাবে হাসছে। কিছু বোঝার আগেই নিশা জ্ঞান হারালো।
জ্ঞান ফিরতে নিশা একটা খাটের সাথে নিজেকে দড়িতে বাঁধা পেল। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না নিশা। নিশা মনে মনে মা ভবতারিণী কে স্মরণ করতে থাকলো।
এরপর একে একে তিনজনই নিশার কাছে এলো। রাহুল কে দেখতে সেই মুহূর্তে একটা শয়তান লাগছিল। চোখ, মুখে হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছিল। রাহুলের এই রূপ এর আগে নিশা কখনো দেখেনি । রাহুল জঘন্য একটা হাসি হেসে বললো, তোমাকে আমার জন্য আজ মরতে হবে নিশা। এনারা তোমার আরাধ্য মায়ের সামনেই তোমাকে বলি দেবেন, আর আমার মনোবাসনা পূরণ করবেন । তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছো এবার ও আমার ইচ্ছা পূরণ করবে আমি নিশ্চিত। নিশা বেশ ভয়ে ভয়ে বললো," একি বলছো তুমি,আমি না তোমার স্ত্রী আর তোমার সন্তানেরই মা হতে চলেছি। আমার প্রতি এই তোমার ভালবাসা, ছিঃ"
রাহুল আবার বিকট একটা হাঁসি হেসে বলল," আমি কেবল আমাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসি না। তোমার বলি আমাকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে । এনারা তান্ত্রিক,এতো দিন যতো অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হারিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছো সবাই এনাদের বলির শিকার। তুমি ও আজ এই বলির হাত থেকে কোনভাবেই রক্ষা পাবেনা ।" তোমাকে মারতেই হবে তাহলেই আমার বড়ো প্রমোশন হবে আর আমি অনেক উঁচু তে পৌঁছাতে পারবো ।
আমতা আমতা করে নিশা বলল, তুমি পাগল হলে নাকি?! এইভাবে কেউ নিজের স্ত্রী সন্তান কে হত্যা করে উপরে উঠতে পারে না। তুমি শোন আমার কথা মাথা ঠান্ডা করে বাড়িতে চলো এই সব পাগলামি ছাড়ো। আমরা দুজনে কতো স্বপ্ন দেখেছি বলো আমাদের সন্তান কে নিয়ে তুমি তাকে পৃথিবীতে আসার আগেই সরিয়ে দিতে চাইছো!
অন্তঃসত্ত্বা মায়েরই বলি দিতে হবে, মা ইচ্ছাপূরণের জন্য তাদেরই রক্ত চায়। অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের বলির পরে গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা হয় যাতে অভুক্ত হিংস্র পশুরা তাদের পেটের খিদে মেটাতে পারে। পশুরা ভক্ষণ করলে সেই মৃত নারীর আখেরে পুণ্য লাভ হয়। তুমি চিন্তা করোনা তোমাকে আমরা এই পূর্ণ করার থেকে বঞ্চিত করবো না কথাগুলো বলে তান্ত্রিক দম্পতি হেসে উঠলো।
এরপরে তিনজনে নিশা কে হ্যাচরাতে হ্যাচরাতে মায়ের সামনে নিয়ে যায়। নিশা আচ্ছন্ন হয়ে মায়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। নিশার মাথা বলিকাঠে রাখা হয়,ঠিক তখনই পাহাড়ি দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। হাওয়ায় যজ্ঞের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে,আগুন ছিঁটিয়ে পড়ে পুরো বাড়িতে। পাহাড়ের অঞ্চলবর্তী বাড়িগুলো অতিরিক্ত ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা পেতে বেশীভাগ অংশই কাঠের তৈরি হয়, সে কারণে আগুন ছড়াতে বেশি সময় লাগল না।
আচমকা দমকা হাওয়ায় কাঠগোড়া ভেঙে পরে আর মায়ের হাতের খড়্গ আশ্চর্য্য ভাবে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে একসময় খড়্গ এসে নিশার আঁচলে পড়ে। কাঁপা হাতে খড়্গ তুলে নিয়ে শত্রুপক্ষে থেকে নিজের আত্মরক্ষা করে সবার সব কিছু বোঝার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাণ বাঁচায় নিজের আর গর্ভজাতর।
পরের দিন পুলিশ এই বাড়ি থেকে তিনটে পোড়া মৃতদেহ সহ অন্তঃসত্ত্বা নারীদের হারিয়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ধার করে নিশার সহযোগিতায়। মৃতদেহের একটা দেহ ছিল বিশ্বাসঘাতক রাহুলের।
------------
Paromita Raha Halder
C/O Bimal Kumar Halder
Noapara, Ogg Rd. Bye lane,
Land Mark : Near Taltala Math,
PO: Garulia,
Dist: 24 Pagns(N),
743133
7605828560
9163117228
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন