Featured Post
ঔপনিবেশিকত্তোর ভারতের অর্থনীতি ও ভারতের স্বাধীনতার স্বরূপ ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ঔপনিবেশিকত্তোর ভারতের অর্থনীতি ও ভারতের স্বাধীনতার স্বরূপ
রণেশ রায়
ভূমিকা:
কোন স্বাধীন দেশের সংবিধান অনুসারে কিছু নীতি মেনে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু তা ধরে দেশের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ধরনটা বোঝা যেতে পারে। ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করল তার বয়স ৭৫ বছর হল। ১৯৫o সালে ভারতকে একটি প্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়। চালু হয় স্বাধীন ভারতের সংবিধান আর তার সঙ্গে নির্দেশ মূলক নীতি। কিন্তু আজও ভারতের বেশ বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংশয় আছে ভারত সত্যি কতটা স্বাধীন। কারণ মনে করা হয় একটা স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক দেশের একটা স্বাধীন শক্ত পোক্ত অর্থনীতি থাকা দরকার যার ওপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষের রুটি রুজির অধিকার তার চলাফেরা বাকস্বাধীনতা স্বীকৃতি পেতে পারে। সে দেশ তার নীতি নির্ধারণে বিদেশী চাপের কাছে নতি স্বীকার করে না, বিদেশী ঋণে জর্জরিত হয়ে নিজেকে বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয় না। আমলাপুঁজি নয় দেশের নিজস্ব স্বাধীন পুঁজির ওপর নিজের দেশের অর্থনীতি গড়ে তোলে যার ওপর মাথা তুলে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবে তার রাজনীতি তার সংস্কৃতি।কোন উপগ্রহ অর্থনীতি হয়ে সে টিকে থাকবে না। এসব দিক বিচার করে আমরা আজকের স্বাধীন ভারতের স্বরূপটা তুলে ধরার চেষ্টা করব। গত পঁচাত্তর বছরে তার বিবর্তন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে আজের ভারতকে বুঝতে চেষ্টা করব। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আজকের বহু আলোচিত ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিকতার বিষয়টা আমাদের আলোচনায় আসবে। আমাদের ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক কালের ধরণটা সংক্ষেপে বুঝে নিতে হবে। ভারতের অর্থনীতির বিবর্তন প্রক্রিয়া ধরে আমরা আলোচনা করব।
ঔপনিবেশিক উত্তরসূরি ভারত :
উপনিবেশ পরবর্তী গত পঁচাত্তর বছরের ভারত ও ভারতের অর্থনীতিকে তার সমগ্রতায় বুঝতে গেলে এক ঝলকে পেছনটা দেখে নিতে হয় কারণ বর্তমান ভারতের অর্থনীতি নানা দিক দিয়ে ব্রিটিশের অধীনে ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতির উত্তরসূরি বলে মনে করার কারণ আছে। কাগজে কলমে স্বাধীনতা পেলেও সে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে আজও সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছে কি না তা নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে। আর অর্থনীতিগতভাবে মুক্ত হতে না পারলে রাজনীতি ও সংস্কৃতির দিক থেকেও সাম্রাজ্যবাদের বন্ধন নানা ভাবে প্রতিফলিত হয়। অনেকেই এই স্বাধীনতাকে ক্ষমতা হস্তান্তর বলে মনে করেন। বলে রাখা দরকার যে অর্থনীতিকে তার সামগ্রিকতায় বোঝা মানে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক দিয়ে তাকে বোঝা, তার কাঠামোর বিচারে অর্থাৎ অর্থনীতির বিভিন্ন বিভাগের তথা কৃষি শিল্প ও বাণিজ্যের আন্তসম্পর্কে তাকে বোঝা। বিচ্ছিন্নভাবে তাকে জাতীয় আয় বা জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে বোঝা নয় । আমরা আমাদের আলোচনায় এই সামগ্রিকতা দিয়েই উপনিবেশ পরবর্তী ভারতের অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করব।
স্মরণাতীত কাল থেকে বলা চলে আর্য আক্রমণকাল থেকে ভারতের ইতিহাস হল বিদেশি আগ্রাসনের ইতিহাস। বলা চলে ভারতের নিজস্ব আদিম ইতিহাস আজ প্রায় লুপ্ত। এই আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আর্থসামাজিক অবস্থার ক্রমাগত বদল হয়ে স্বাধীনতার আগের দুশো বছর ধরে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে উপনিবেশ হিসেবে স্থিতি পেয়েছে। এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের বিবর্তনে উপনিবেশের বিভিন্ন ধরণগুলো তুলে ধরে সাম্রাজ্যবাদের অধীনে পুঁজিবাদী ঘরানার উপনিবেশিক দেশ হিসেবে ভারতকে অনেকে দেখে থাকেন। মনে করেন ভারতে স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশ হয় নি । ভারত থেকে গেছে ভঙ্গুর সামন্ত কাঠামোয় বন্দি। একধরনের পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী কাঠামোয় আটকে গেছে তার অর্থনীতি যেখানে সাম্রাজ্যবাদের লেজুর হিসেবে দালাল পুঁজির বিকাশ ঘটে যাকে মুৎসুদ্ধি পুঁজি বা ইংরেজিতে comprador capital বলা হয়।
দেখা যায় যে আপাতদৃষ্টিতে বাণিজ্যবাদের যুগে সকলের লাভের খাতিরেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে বানিজ্য শুরু হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা দেশীয় রাজন্যবর্গের হাতে থাকে। কালক্রমে দেখা যায় বেশি ক্ষমতাশালী বাণিজ্য গোষ্ঠী রাজক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। ছলে বলে কৌশলে সম্পত্তি লুঠের কাজ শুরু করে। যেমন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে করতে দেখা যায়। ভারত শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনের রানীর দখলে চলে যায়। বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও তার সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ দখল নেয় রাজশক্তির । ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সম্পদ লুঠ। উপনিবেশের উন্নতির নামে যে সব নীতি গ্রহণ করা হয় তা সম্পদ লুঠের নালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন রেলপথ স্থাপন বানিজ্য নীতি শিল্পনীতি প্রভৃতি। তখনকার ভারতের অর্থনীতিবিদ দাদাভাই নওরজি রমেশচন্দ্র রানাডের মত ব্রিটিশদের আইনি শাসনের ভক্ত উদারনীতিবিদরাও এটা স্বীকার করেন। একজন ব্রিটিশ আমলা ও শিক্ষাবিদ ম্যান্তেগণি এ প্রসঙ্গে বলেন :
`` It is impossible to avoid remarking two facts as peculiarly striking ---- first the richness of the country surveyed, and second, the poverty of its inhabitants----- The annual drain of $3,000,000 on British India has amounted in thirty years, at 12 per cent (usual Indian rate) compound interest to the enormous sum of 723,900,000 sterling---- So constant and accumulating a drain, even in England would soon impoverish her. How severe drain must be its effects on India when the wage of a labourer is from two pence to three pence per day.`` ( Eastern India, 1835)
বিভিন্ন ব্রিটিশ নীতি একদিকে লুঠ অন্যদিকে দেশীয় শিল্পের পতন অনিবার্য করে তোলে। ভারত পরিণত হয় ঔপনিবেশিক এক অর্থনীতিতে যার সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রটাও আংশিকভাবে হলেও বজায় থাকে । স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশ ভারতে ঘটে না।
১৯৪৭ সালে ১৫ই আগস্ট ভারত যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তার স্বরূপ বোঝার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদের যে ধরনের পরিবর্তন হয়েছিল সেটা আমরা বুঝে নেব কারণ তখন থেকেই ভারতের মত বহু দেশকে পদানত করে রাখার যে ব্যবস্থা হয়েছিল সেটা আমাদের বোঝা দরকার। সাম্রাজ্যবাদ নয়াসাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিনত হয়েছিল। যারা আপোষের মাধ্যমে তথাকথিত স্বাধীনতা পেয়েছিল তারা নয়া-উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই ধারাটা আজও ভারতে বয়ে চলেছে বলে মনে করা হয়।
সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান স্বরূপ
সাম্রাজ্যবাদ আজ নতুনভাবে সেজেছে। তার বর্তমান নাম নয়া-সাম্রাজ্যবাদ। কার্যত উদারর্নীতিবাদের যে দর্শন সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি ছিল আজ নয়া-উদারনীতিবাদরূপে সে দেখা দিয়েছে যা নয়া-সাম্রাজ্যবাদের তাত্ত্বিক দর্শন। আজকের একচেটিয়া পুঁজিবাদের সঙ্কটকালের দর্শনই হল নয়া-উদারনীতিবাদ যার মুখোশের আড়ালে লুকোনোর চেষ্টা হয় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী চেহারাটা। সে আজ আর প্রত্যক্ষভাবে দখল রেখে পরদেশ শাসন করে না। পরোক্ষে রাষ্ট্রশক্তির ওপর প্রভাব বজায় রেখে ঋণের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ রেখে কোন অর্থিনীতিকে তাবেতে রেখে সাম্রাজ্যবাদের মূল কাজ শোষণ ও লুন্ঠন চালিয়ে যায়। নযা-উপনিবেশিক দেশের পুঁজিপতিরা হল দালাল পুঁজি যারা সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি। ধর্ম বর্ণের সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য গুলো টিকে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক মনন একধরনের সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মদত করে। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ধ্বংসাবশেষ টিকে থাকে, তাকে টিকিয়ে রাখা হয় সাম্রাজ্যবাদী শোষণের স্বার্থে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভোগবাদ। এসব দেশে স্বাধীনভাবে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে না। প্রযুক্তির দিক থেকে বৃহৎ শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার বিশ্বব্যাংকের মত বাণিজ্যিক আইনি ও আর্থিক সস্থাগুলোর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য প্রযুক্তিগত সাহায্য আইনি সাহায্য এমনকি সামরিক সাহায্যের নামে। তবে কোনোটাই বিনা স্বার্থে বিনে পয়সায় নয়। এগুলোর মাধ্যমে সম্পদ লুঠের পথ খুলে রাখা হয়। ন্যাটো ইউ এন ওর মত সংস্থাকে মধ্যস্থতার নামে নিজেদের হয়ে কর্তৃত্ব করতে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিকস্তরে সেনা বাহিনী তৈরি করা হয়। পশ্চাদপদ দেশের সেনা বাহিনী এদের হয়ে শান্তি রক্ষার নামে যুদ্ধ করে। এদের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানকে দমন করা হয়। আর সবটাই হয় গণতন্ত্রের নামে।
উদারনীতিবাদ আর নয়া-উদারনীতিবাদের আপাত চেহারায় পার্থক্য থাকলেও মর্মবস্তুর দিক থেকে উভয়েই একই কথা বলে। এদের উদ্দেশ্য অভিন্ন। কেবল কর্মপদ্ধতিতে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। উভয়ের মতেই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে মানব সমাজকে টিকে থাকার জন্য লড়াই চালাতে হয়। এরা মনে করে সমাজের আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিটি ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ আদাম স্মিথের একজন বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব। আর সমাজ এই মানুষদের যোগফল। টিকে থাকার জন্য সবাইকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। যোগ্যতমই টিকে থাকে। এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম বলে পরবর্তীকালে ডারউইন দেখান প্রকৃতির সঙ্গে পশুজগতের বিবর্তন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। স্মিথ অর্থনীতির জগতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একটা কাম্য বা optimum অবস্থা অর্জন করার জন্য লড়াই চলে বলে মনে করতেন। অর্থনৈতিক এককগুলোর মধ্যে বাজার ব্যবস্থায় এই প্রতিযোগিতা চলে। সবাই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সেই দিক থেকে প্রতিটি মানুষই আত্মকেন্দ্রিক। বাজারের নিয়ম অনুসরণ করেই মানুষকে টিকে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যেই আছে টিকে থাকার তাগিদে আত্মকেন্দ্রিকতা, লোভ ও আগ্রাসনের মত বৈশিষ্ট্য। আর এর থেকেই জন্ম যে করে হ`ক টিকে থাকার মানসিকতা। আর্থসামাজিক জীবনে দেখা যায় অবাধ বাণিজ্য, দস্যুতা আর যুদ্ধ। সুতরাং মানব সমাজে শোষণ, নিপীড়ন আর প্ৰভুত্ববাদ হ`ল স্বাভাবিক, সহজাত। প্রাকৃতিক নিয়মেই সেটা ঘটে থাকে বলে অনেকে মনে করেন। অলঙ্ঘনীয় এই নিয়ম। অর্থনৈতিক জগতে সাম্রাজ্যবাদও মানব প্রকৃতির মতই স্বাভাবিক। সেও প্রকৃতির নিয়মের অধীন। অবাধ বাণিজ্য থেকে বিশ্বায়ন সব যুগেই এটা প্রযোজ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা মানুষের মধ্যেকার সহজাত প্রতিযোগিতার মানসের প্রতিফলন। অবশ্যই কেউ কেউ সর্বোত্তম হয়ে প্রভুত্ব করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে আর ব্যাপক সাধারণ মানুষ অনুগত থাকবে। শ্রেষ্ঠের কর্তৃত্ব মেনে চলবে। সেটাই শৃঙ্খলা। এই শৃঙ্খল আলগা হ`লে সভ্যতা রসাতলে যাবে। রুষ্ট হবেন পরম করুনাময় সর্বশক্তিমান কর্তা।
অবশ্য দয়াময় কর্তার ইচ্ছায় সবাইকে অনুগ্রহপরায়ন হতে হয়। অনুগ্রহে থাকা আশ্রিত মানব গোষ্ঠী প্রাধান্যবাদী সর্বোত্তমের সমতুল্য না হলেও যেন অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত না হয়। অনুগ্রহের অভাবে কেউ নিজেকে বঞ্চিত মনে করলে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কাছে বিচারের আশায় আবেদন করতে পারে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষ ভোট দিয়ে নিজের প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারে। সুতরাং তার কাছে ন্যায় বিচার আশা করতে পারে। এটাই গণতন্ত্র। এটাই অধিকার। আর বিশ্বস্রষ্টা সর্বমঙ্গলময় কর্তার ইচ্ছায় প্রাধান্যবাদী গোষ্ঠী তার অবতার হিসেবে অনুগ্রহ বর্ষণ করে। এই অনুগ্রহের দৌলতে মানুষ বেঁচে থাকে। এটাই হ`ল উদারনীতিবাদের মানবতার দর্শন। অধিকারের প্রশ্ন নয় অনুগ্রহের জীবনই জীবন। সবাইকে হারিয়ে সর্বোত্তম হতে পারেন কয়েকজন। তাই সংখ্যা লঘিষ্ঠের রাজত্বের প্রশ্ন উঠবে কেন ? অধস্তন গোষ্ঠীর যদি `ন্যায্য` পাওনা থাকে, `অধিকারের` প্রশ্ন থাকে তবে তারা সরকারের কাছে, আইনের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে পারে। তাদের প্রতিনিধিই বিচার করবে কি তার পাওনা কি নয় । এই গন্ডির বাইরে কথা তুললে তা সংবিধান বিরোধী, সমাজবিরোধী। রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেয়। তা নইলে সমাজ রসাতলে যায়। গণতন্ত্রের স্বার্থে বেঁধে দেওয়া গন্ডির বাইরের কাজকে দমন করতে হয়। এটা দেশের ভেতর যেমন সত্যি তেমনি পরদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সত্যি। এই ভাবে দেশ চালানোর উপযোগী একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো তার সঙ্গে সংস্কৃতি চালু হয়।
নয়া-উদারনীতিবাদীদের মতে আজ বিশ্বায়নের যুগে এই টিকে থাকার দাবি নিয়েই পৃথিবী প্রাধান্যকামী আর প্রজা দেশে বিভক্ত। তাদের মতে এটাই স্বাভাবিক। আর প্রযুক্তির কল্যানে দেশে দেশে ভৌগলিক সীমানা মুছে গেছে। পৃথিবী একটা ক্ষুদ্র অভিজাত গ্রামে পরিণত হয়েছে। সবাই সবার তরে। আন্তর্জাতিক ভাতৃত্ববোধ। সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেকে শৃঙ্খলিত রাখা কেন ! পুঁজি, পণ্য, প্রযুক্তি, জল, জমি, জঙ্গল সব কিছুরই অবাধ গতিশীলতা। সব দেশের সবারই কাজে লাগে। এদের নিয়ন্ত্রণ করবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার, বিশ্ব ব্যাংক আইন দিয়ে উপদেশ দিয়ে ঋণ দিয়ে। সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক। সে শুধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকবে। পুঁজির দৌলতে সর্বোত্তমের হয়ে বহুজাতিক সংস্থা কর্তৃত্ব করবে। এতে সমগ্র মানবজাতি উপকৃত হবে। এটাই আজ বিশ্বায়ন। এটাই আজ প্রাকৃতিক নিয়ম। এই ব্যবস্থায় পুঁজি, পণ্য, শ্রম, প্রযুক্তি সব কিছুরই অবাধ গতিশীলতা থাকবে। এর থেকে উৎপাদনের প্রাপ্য সুবিধার দক্ষিণ থেকে উত্তরে অবাধ একমুখী প্রবাহ ঘটলেও কিছু বলার নেই কারন সেটা এদের মতে সর্বোত্তমের টিকে থাকার যুদ্ধের ফল যা সহজাত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসারী। আর সে নিয়মেই উত্তর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে, তার প্রভুত্ব সভ্যতার স্বাভাবিক পরিণতি।আজ এই প্রাকৃতিক নিয়মের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে তিনটে বিষয় মানবজীবনকে প্রদক্ষিণ করে। এরা হ`ল : সমরবাদ, ভোগবাদ আর ধর্ম বর্ণকে কেন্দ্র করে মৌলবাদ। এদের নিয়ে নয়া-উদারনীতির প্রবক্তাদের মাথা ব্যথা নেই।
নয়া-উদারনীতিবিদদের মতে আর্থিক বলে বলীয়ান হয়ে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে বহুজাতিক সংস্থা তার প্ৰভাব বজায় রাখে। প্রতিযোগিতায় জিতে সে সেটা করে। এতে অস্বাভিকতার কিছু নেই। কিন্তু বলা হয় না কিভাবে অন্যের শ্রমের ফসল চুরি করে কোন সংগঠনের হয়ে ব্যক্তি আজ এই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়। লোভ, শক্তির প্রয়োগ আর দখলদারি এই ব্যবস্থাকে গড়ে তোলে। মালিক সম্প্রদায়ের শ্রম নয় মালিক শ্রেণীর লাঠি এই প্রক্রিয়ায় কাজ করে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারাই কথা বলে। উদারনীতিবাদীদের এই দর্শন সম্পর্কে গোয়েথেলের বিখ্যাত মন্তব্য: `` Free Trade, Piracy and War --------- an inseparable three`` উল্লেখযোগ্য।
নয়া-উদারনীতিবাদ উদারনীতিবাদের উত্তরসূরি। উভয়ের দর্শনেই প্রতিফলিত হয় মানব প্রকৃতির অহং বীভৎসতা আর লোভ (``Ego, Ruthlessness and Greed``)। উদারনীতিবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় ক্লদিয়া ভন গোয়েথের বিখ্যাত উক্তিতে। উদারনীতিবাদের সঙ্গে নয়া উদারনীতিবাদের মিল ও অমিলের উল্লেখ করে তিনি বলেন:
At the centre of both old and new economic liberalism lies : Self interest and individualism of ethical principles and economic affairs, in other words : a process of `de-bedding ` economy from society, economic rationality as a mere cost-benefit calculation and profit maximization; competition as the essential driving force for growth and progress; specialization and the replacement of a subsistence economy with profit oriented trade ( `comparative cost advantage`); and the proscription of public (state) interference with market forces.
Where the new economic liberalism outdoes the old is in its global claim. Today's economic liberalism functions as a model for each and everyone: all parts of the economy , all sectors of the society , of life/nature itself. As a consequence, once `de-bedded` economy now claim to ``im-bed`` everything including political power. Furthermore, a new twisted ``economic ethics`` (and with it a certain idea of ``human nature``) emerges that mocks everything from so called do-gooders to altruism to selfless help to care others to a notion of responsibility.
This goes as far as claiming that the common goods depends entirely on the uncontrolled egoism of the individual,and, specially, on the prosperity of transnational corporations. The allegedly necessary ``freedom`` of the economy---- which paradoxically, only means the freedom of corporations-----hence consists of a freedom responsibility and commitment to society.
Ref: Eighteenth-Century Studies
Vol. 39, No. 4 (Summer, 2006), pp. 443-462 (20 pages)
Published By: The Johns Hopkins University Press
আজকে সঙ্কটকালীন একচেটিয়া পুঁজিবাদের তথা নয়াসাম্রাজ্যবাদের যুগে আন্তর্জাকতিক কর্পোরেশনের (Transnational Corporation) রাজত্বকালে ভয়ঙ্কর মাত্রায় আবির্ভূত হয়েছে চারটি বিষয়------ প্রযুক্তিবিপ্লব ও তার অপব্যবহার, সমরবাদ, ভোগবাদ আর দূষণ ও জঙ্গল সাফের দৌলতে প্রকৃতির উষ্মায়ন। এই প্রতিটি বিষয় বহুমাত্রিক হওয়ায় পৃথক আলোচনার দাবি রাখে। আমরা এদের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেব। এই সমস্যাগুলোকে উদারনীতিবিদরা দুষ্টসমস্যা বললেও তারা এদের অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করে। সমস্যাগুলো সমূলে উৎপাটন করা বা এগুলোর যাতে উদ্ভব না হয় তা না ভেবে সমস্যাগুলো এলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারী থেকে এ সমস্যাগুলো কোনভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে এগুলো আরও সঙ্কটাকীর্ণ করে তুলেছে। আরও বেশি মানুষকে পুঁজিবাদের সঙ্কট স্পর্শ করছে। প্রকৃতিবিদ দেশপ্রেমিক শক্তি আর শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাসী মার্কসবাদীদের পরস্পরের কাছাকাছি টানার শর্ত তৈরী করছে। এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সমস্যাগুলোর কোনোটাই যে মেটানো যাবে না তা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। এ নিয়ে কাউকে উদাসীন থাকলে চলে না।
একটা বিষয় মনে রাখা দরকার প্রাধান্যবাদী আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে যেমন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকে ক্ষমতার ভারসাম্যে যেমন পার্থক্য থাকে তেমনি তাদের অধীনে প্রাধান্য বশীভূত দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকে তাদের ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে তা বদলায়। যেমন ভারত শ্রীলঙ্কা পাকিস্থান আফগানিস্থান বাংলাদেশ আফ্রিকার দেশ সমুহ আরবের দেশ গুলো। এদের মধ্যে বিরোধকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী বড় শক্তিগুলো। অধীনস্থ দেশগুলো বড় মেজ ছোট ছেলের মত। এদের ব্যবহার করতে গিয়ে বড় শক্তিগুলো বিভিন্নভাবে বিরোধে জড়ায় একে অপরের বিরুদ্ধে জোট গড়ে তোলে। সম্পর্কগুলো টিকে থাকে একটা যুদ্ধের আবহে তরওয়ালের ফলার মুখে যা দুদিকেই কাটে। আমরা আজ এশিয়া আফ্রিকা আরব পূর্ব ইউরোপের দেশে দেখছি। ভারত পাকিস্থান ইরান ইরাক সিরিয়া লেবানন ঘিরে আমরা এ বিষয়গুলো দেখছি। তার থেকে উদ্ভব হয় কিছুটা দরকষাকষি।এরই মধ্যে দাস প্রভুর মধ্যে গ্রহ উপগ্রহর একটা সম্পর্ক দেখি। আজকের নয়াউপনিবেশের যুগে সব কিছু সোজা সরল পথে চলে তা নয়। একটা টানা পোড়েনের মধ্যে অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে কোন অধীনস্থ দেশকেও দানব বলে মনে হয়। তাদেরকে স্বাধীন পুঁজিবাদী শক্তিধর দেশ বলে ভ্রম হয়।
আজের দখলদারিতে পুঁজি ও প্রযুক্তির ভূমিকা :
মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রযুক্তি খুলে দেয় ভোগ বৈচিত্রের সম্ভাবনার দুয়ার। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পৃথিবীতে মানবজাতির আবির্ভাবের ঊষালগ্নেই। মানব সমাজের প্রগতিতে প্রযুক্তির উন্নতি যে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে তাতে সন্দেহ নেই। পুঁজিবাদ এই বিকাশে এক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে বলে পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় সমালোচক কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসও মনে করেন। কমিউনিস্ট ইস্তাহারে তাঁরা লেখেন:
বুর্জোয়া শ্রেণী বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে প্রতিটি দেশেরই উৎপাদন ও উপভোগকে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষুব্ধ করে তারা শিল্পের পায়ের তলা থেকে কেড়ে নিয়েছে সেই জাতীয় ভূমিকা যার ওপর শিল্প আগে দাঁড়িয়েছিল। সমস্ত সাবেকি জাতীয় শিল্প হয় ধ্বংস পেয়েছে নয় প্রত্যহ ধ্বংস পাচ্ছে। তাদের স্থানচ্যুত করছে এমন নতুন নতুন শিল্প যার প্রচলন সকল সভ্য জাতির পক্ষেই মরাবাঁচা প্রশ্নের সামিল ; এমন শিল্প যা শুধু দেশজ কাঁচামাল নিয়ে নয় দূরতম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালে কাজ করছে; এমন শিল্প যার উৎপাদন স্বদেশেই শুধু নয় ভূলোকের সর্বাঞ্চলেই ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের উৎপন্নে যা মিটত তেমন সব পুরনো চাহিদার বদলে দেখছি নতুন চাহিদা , যা মেটাতে দরকার সুদূর বিদেশের নানা আবহাওয়ায় উৎপাদন।আগেকার স্থানীয় ও জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও স্বপর্যাপ্তির বদলে পাচ্ছি সর্বক্ষেত্রেই আদান প্রদান, জাতিসমূহের বিশ্বজোরা পরস্পর নির্ভরতা।বৈষয়িক উৎপাদনে যেমন,তেমনি মনীষার ক্ষেত্রেও। এক একটা জাতির মানসিকতা সৃষ্টি হয়ে পড়ে সকলের সম্পত্তি। জাতিগত একপেশেমি ও সংকীর্ণচিত্ততা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে ; অসংখ্য জাতীয় ও স্থানীয় সাহিত্য থেকে জেগে ওঠে একটা বিশ্বসাহিত্য (কমিউনিস্ট পার্টির ইন্তাহার, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ) ।
যে দূরদৃষ্টি নিয়ে এই দুই সমাজবিদ পুঁজিবাদের ঊষালগ্নেই বিশ্বায়নের আগমন বার্তার ইঙ্গিত দিয়ে যান তা আজকের বিশ্বায়নের সর্বোচ্চস্তরের সমর্থকও কল্পনা করতে পারেন না। তবে তাঁরা পুঁজিবাদের এই প্রাচুর্যের মধ্যেই যে তার সর্বনাশ লুকিয়ে আছে তা বীক্ষণ করেন। তাঁদের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে আমরাও দেখি :
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর রূপ তার,
অনু ভেঙ্গে পরমানু
খুলে যায় সম্ভাবনার দুয়ার;
তারপর পরমানু ভাঙ্গলে !
কে রাখে তাকে আগলে ?
সে এক বিস্ফোরণ !
মহা শক্তির উৎসরণ
নয়া-সভ্যতা, অভিনন্দন।
(সভ্যতার সংকট কবিতা ----- লেখক)
মানুষের কায়িক শ্রম এবং তার অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা মানুষের চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রযুক্তি বিকাশের পথ সুগম করেছে। প্রত্যক্ষ শ্রম ও তার সঙ্গে অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা যাকে আমরা মৃত শ্রম বা নিহিত শ্রম (embedded labour) বলি সমবেতভাবে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায়। এটি একটি বহমান ধারণা। নতুন কিছু নয়। সুতরাং আজকের ইলেক্ট্রনিক্স শিল্প ও তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তথ্য প্রযুক্তি উন্নতির যুগটাকেই প্রযুক্তির যুগ বলে ভাবার কারন নেই। এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের `আগন্তুক` চলচিত্রের নাম মনে পড়ে। গাছ থেকে ফল পাড়া, জলে মাছ ধরা, আশ্রয় তৈরী,আগুনের ব্যবহার, লোহার ব্যবহার সবই প্রযুক্তির উন্নতির বহমানতার নিদর্শন বহন করে। জ্ঞানের সমাবেশ আর সঞ্চয় ঘটে, মানুষের চেতনার উন্মেষ ঘটে । শ্রমের ফলে যে জ্ঞ্যানের বিকাশ ঘটে তার সঞ্চয় ভান্ডার হল আমাদের চেতনা। সেটাই সভ্যতার আধার। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেটাই শিক্ষার উপাদান। আজ নয়া-উদারনীতিবিদরা শ্রম থেকে চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাবার চেষ্টা করে। চেতনা যেন শ্রমনিরপেক্ষ অতিপ্রাকৃতিক প্রতিভা যা জন্মসূত্রেই পাওয়া যায়। শ্রমের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। এটাই হল জন্মলব্ধ বুদ্ধিবৃত্তি যা প্রযুক্তির জন্ম দেয়। উচ্চবিত্তরাই এর ধারক ও বাহক। শ্রমজীবী মানুষের এর ওপর দাবি থাকতে পারে না। জন্মসূত্রে পাওয়া বিশেষ প্রতিভার প্রচেষ্টায় গবেষণাগারে প্রযুক্তির জন্ম হয়। পুঁজি খরচ করে যে পুঁজিপতিরা এই গবেষণাগার তৈরী করে তাদেরই প্রাপ্য প্রযুক্তি এবং তার ফল। পুঁজির মালিকানার জোরে প্রযুক্তির ওপর প্রাধান্যকামী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় সেটাকে আড়াল করার চেষ্টা চলে। বলা হয় না যে তারা নিজেদের স্বার্থে প্রযুক্তির ব্যবহার করে। আর এর থেকেই উদ্ভব ঘটে ভোগবাদ আর সমরবাদ। এছাড়া এমন প্রযুক্তির আজ অবাধ ব্যবহার যা প্রকৃতির ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, এমন পণ্য সামগ্রী উৎপাদনে সাহায্য করে যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্বক। আজ এটা প্রমাণিত সত্য। এই কারনে উন্নত `সভ্য` দেশগুলো বহু এমন পণ্যে উৎপাদন ও ভোগ নিজেদের দেশে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু তাদের বহুজাতিক সংস্থাগুলোর স্বার্থে তা ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে অবাধে উৎপাদন করে তা নিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। গরিব দেশের মানুষেরা এর ভোক্তা। সবই চলে খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানো আর তার সঙ্গে বাজার দখলের তাগিদে। এভাবে মানুষের ক্ষতি করে প্রযুক্তির অপব্যবহারের প্রবণতাকে আমরা প্রযুক্তি সর্বস্বতা বা প্রযুক্তিবাদ বলি। সুতরাং প্রগতির স্বার্থে প্রযুক্তির আবিষ্কার প্রযুক্তির ব্যবহার আর প্রযুক্তিসর্বস্বতা তথা প্রযুক্তিবাদ এক বিষয় নয়। প্রযুক্তি সর্বস্বতা বা প্রযুক্তিবাদ প্রযুক্তির বিকাশ ও আবিষ্কারের আসল কারিগর শ্রমজীবী মানুষের অবদানকে অস্বীকার করে। যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে তার জায়গায় স্থান দেয় ভাববাদকে যা অতিপ্রাকৃত সর্বশক্তিমান তথা ভগবানের অনুগ্রহের কারাগারে মানবসমাজকে বন্দি করে রাখতে সচেষ্ট হয় । আর এর জন্য দরকার হয় সমরবাদ এবং একইসঙ্গে অন্ধ ভক্তিবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মৌলবাদ ( সে ধর্মীয় মৌলবাদী-ই হোক বা অন্য কোন ধরনের মৌলবাদ-ই হোক ) ----- তাদের মধ্যে এক সমঝোতা। মৌলবাদ হ`ল বিজ্ঞান বিরোধী। অথচ যুক্তিভিত্তিক প্রযুক্তির উন্নতি ছাড়া, প্রযুক্তির ওপর মুষ্টিমেয়ের দখল প্রতিষ্ঠা না করে পুঁজিবাদ টিঁকে থাকতে পারে না। এখানেই পুঁজিবাদ আর মৌলবাদের বিরোধ ঘটে। ব্যাপক সাধারণ মানুষকে ধ্বংস করার জন্য সমাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদকে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সন্ধি করতে হয়, মৌলবাদকে মদত করতে হয় আবার প্রযুক্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের স্বার্থে মৌলবাদের বিরোধিতা করতে হয়। এক স্ববিরোধতার উদ্ভব ঘটে। আজকের দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে মৌলবাদের বিরোধ তাদের মধ্যে যুদ্ধ সেই বার্তাই বহন করে। এর ফলে তাদের দুনিয়ায় সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। এরাই একদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সাধারণ শত্রু সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লাগাতার চক্রান্ত করে গেছে। তাকে উচ্ছেদ করেছে রাশিয়া থেকে, চীন থেকে। যে দেশেই সমাজতন্ত্রের লড়াই হয় সেখানেই এরা যুদ্ধ বাধায়। তারা ঐক্যবব্ধ হয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে খুন করে যদিও মুখে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের যপ আওড়ায়। সমাজতন্ত্রের শিবির নিধনে সার্থকতা পেয়ে এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এটাই নিয়ম। কারন সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদ কাউকেই রেয়াত করে না। অন্যের ঘর পোড়ায় আবার সেই আগুনে নিজেরা দগ্ধ হয়। মুখে মানবতার কথা বলে কিন্তু এরাই মানবতার সবথেকে বড় শত্রু।
ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই ভোগবাদ আর সমরবাদকে মদত করা হয়। দেখলাম যে প্রযুক্তি, প্রযুক্তির উন্নতি আর প্রযুক্তিবাদ এক বিষয় নয়। আমাদের কোন কোন বন্ধু উভয়কে এক করে দিয়ে মার্কসবাদীদের ওপর মিথ্যা আক্রমন হানে। বলে যে মার্কসবাদীরা প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির উন্নতি চায় না। আদিম বর্বরতার জাদুঘরে গরিব অসহায় মানুষকে বন্দি করে রাখতে চাই। কিন্তু এটাই সত্য যে মার্কসবাদীরা প্রযুক্তি চায়, প্রযুক্তির উন্নতিও চায়। কিন্তু তা ব্যবহৃত হবে জনকল্যাণে। মুষ্টিমেয় মানুষের লোভ চরিতার্থ করার জন্য নয়। সমরবাদ ভোগবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য নয়। প্রকৃত নিধন করে নয়। উদারনীতিবাদদের সঙ্গে মার্কসবাদীদের বিরোধ এখানেই। মার্কসবাদীরা প্রযুক্তি নয় প্রযুক্তিবাদের প্রযুক্তি সর্বস্বতার বিরোধী। বিকল্প আধারে বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সঠিক প্রযুক্তি সঠিকভাবে কিভাবে ব্যবহৃত হতে পারে তার ওপর আলোকপাত করে তারা। সেটা সবস্তরের মানুষকে ভোগবৈচিত্রের সুযোগ করে দিয়ে তাদের জীবন ধারনের মান বাড়াতে পারে। যারা প্রকৃত অর্থে প্রযুক্তি উন্নতিতে অবদান রাখে তারা তার ফল ভোগ করতে পারে। নিজেদের সৃষ্টি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবে না। মুনাফাবাজ ভোগবাদ আর সমরবাদকে মদত দিতে হয় না। প্রযুক্তি হতে পারে পরিবেশবান্ধব, শত্রু নয়।
প্রাধান্যবাদী এই ব্যবস্থায় পুঁজির ওপর মালিকানা বজায় রেখে শ্রম ও তার সৃষ্ট প্রযুক্তির মালিকানার ওপর দখল পায় পুঁজিপতিগোষ্ঠী। মানুষ তার নিজের সৃষ্টির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। স্রষ্টা হারায় সৃষ্টি তার, মালিক হয় দখলদার। ফলে উন্নত প্রযুক্তির দরুন যে শ্রম সময় বাঁচে, খরচ কমে , উৎপাদনে বৈচিত্র আসে তার সুফল শ্রমজীবী মানুষ পায় না। তাদের শ্রম সময় কমে না বা প্রকৃত মজুরি বাড়ে না। বরং উন্নত প্রযুক্তিতে শ্রম নিবিড়তা বাড়ে। শ্রমিক ছাঁটাই হয়। দীর্ঘদিন লড়াই করে শ্রম সময় কমাতে সক্ষম হয়েছিল শ্রমজীবী মানুষ। আজ কর্মসংকোচনের যুগে আবার শ্রমজীবী মানুষকে আট ঘন্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কোথায় প্রযুক্তির উন্নতির সুযোগ কিছুটা হলেও শ্রমজীবী মানুষ পাবে তা নয় বরং তাদের ওপর শোষণ বেড়ে চলেছে। অপরদিকে মালিকের লাভের সুযোগ বাড়ে কারন প্রযুক্তির সাহায্যে উন্নত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত শ্রম সময় ও তার সাথে উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ে। মুষ্টিমেয়ের হাতে সম্পদের সমাবেশ ঘটে। পুঁজির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের কেন্দ্রীভবন বাড়ে। একই সঙ্গে দখলদারি ব্যবস্থায় দখল বজায় রাখার জন্য সমরবাদের বিস্তার ঘটে। বাজারে উৎপাদিত পণ্যের বন্যা বয়ে যায় বলে তা বিক্রি করতে হয়। চাহিদা বাড়াবার নানা ব্যবস্থা করতে হয়। ভোগবাদের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়। ঋণের মাধ্যমে ভোগ্য দ্রব্য ক্রয়ের সুযোগ করে দিতে হয়। ব্যাংকে সাধারণ মানুষের জমা টাকা থেকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়, ক্রেডিট কার্ড ডেবিট কার্ডে কেনার সুযোগ বাড়াতে হয়। একটা অনুগ্রহ অনুদানের অর্থনীতি চালু করতে হয়।আজ ভারতে মোদী সরকারকে সেটাই করতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া অবাধে পরিবেশ শত্রু প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে চলে। বিশ্বায়নের ছাতার তলে সব দেশকে নিয়ে এসে দক্ষিণের অনুন্নত দেশগুলোতে সেসব দেশের কাঁচামাল শ্রম জমি ব্যবহার করে সেখানকার পরিবেশ ধ্বংস করে উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হয়। প্রাপ্য লাভ পুঞ্জীভূত হয় বহুজাতিক সংস্থার হাতে। উত্তরের উন্নত দেশের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণের দেশগুলি।
আমরা বলেছি যে দখল বজায় রাখার স্বার্থে পুঁজির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় রেখে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবাধে অস্ত্র উৎপাদিত হয়। অস্ত্র একটা লাভজনক উৎপাদন ক্ষেত্র। অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রির তাগিদে আঞ্চলিক যুদ্ধ লাগিয়ে রাখা হয়। পশ্চাদপদ দেশগুলো উন্নতদেশের অস্ত্রের বাজারে পরিণত হয়। অসম বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরে পশ্চাদপদ দেশ বাধ্য হয় কারন তারা আমেরিকার মত বৃহৎ শক্তি নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক প্রভৃতি সংস্থার কাছে ঋণে ডুবে থাকে। তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উপদেশ মেনে চলতে বাধ্য হয়। দেখা যাচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি মানব কল্যানে লাগে না। মুনাফাবাজদের স্বার্থে কাজে লাগে। পশ্চাতপদ দেশের সম্পদ লুঠের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। সেসব দেশের পরিবেশ ধ্বংস হয়। শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণের চাপ বাড়ে।
প্রযুক্তি যদি মানবতার ধর্ম পালন করত তবে তা কর্ম সঙ্কোচন ঘটাতো না। উৎপাদনে শ্রম সময় কমত। শ্রমজীবী মানুষ অবসর পেত। শিল্প সংস্কৃতি উন্নতিতে তাদের সৃষ্টিশীল মননের স্ফূরণ ঘটত যা সভ্যতাকে নতুন মাত্রা দিত। ভোগবাদের বা সমরবাদের বিস্তার ঘটাবার প্রয়োজন হোত না। অথচ ভোগ বৈচিত্র এনে শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান বাড়ানো যেত। উল্লেখযোগ্য যে ভোগ আর ভোগবাদ এক নয়। জীবন-এর মান বাড়াতে ভোগ বৈচিত্র এবং প্রয়োজনে ভোগের মাত্রা বাড়ানো অবশ্য-ই দরকার। কিন্তু সব জলাঞ্জলি দিয়ে ভোগ সর্বস্বতা এবং তার জন্য ব্যাপক মানুষকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয়র ভোগ লালসা যাকে আমরা ভোগবাদ বলি তা সমর্থন করা যায় না। আজ নয়া সাম্রাজ্যবাদের যুগে সেটাই ঘটে চলেছে। একটা দেশে ব্যাপক আয় বৈষম্য সৃষ্টি করে সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষকে নিরক্ষর আধপেটা রেখে তাদের চিকিৎসা আশ্রয়ের ন্যূনতম ব্যবস্থা না করে মুষ্টিমেয়ের বিলাস জীবন যাপনের পথ করে দেওয়া হয় এই ব্যবস্থায়। সেটাতে-ই আমাদের আপত্তি।
আজকের অনুগ্রহের অর্থনীতি ও ভারতের স্বাধীনতার স্বরূপ:
খুবই দুঃখজনক যে রাষ্ট্রের গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সমাজে তাঁদের মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করা, তাঁদের মধ্যে যে সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে তার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো, বিপুল জনশক্তিকে সংস্কৃতিবান করে তোলার সঠিক বিষয়টার অপব্যবহার ঘটায় এটা আজ ভারতের মত তথাকথিত সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনে শাসকগোষ্ঠীর হাতে হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।স্বাধীন আত্মনির্ভর ভারত তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।গরীব সাধারণ মানুষের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে তাকে অনুৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত করে দেওয়া হচ্ছে।এটা শুধু ব্যক্তি মানুষকে জাহান্নামে পাঠাচ্ছে তাই নয় সমাজও জাহান্নামে যাচ্ছে। মানুষের অধিকার বোধ আত্মসম্মানবোধ ধ্বংস হচ্ছে। মানুষ নিজের ওপর ভরসা না করে পরজীবী অনুৎপাদনশীল জীবে পরিণত হচ্ছে। একে কেন্দ্র করে লুঠ চুরি দাঙ্গা বেড়ে চলেছে। দেশের অর্থনীতি একধরনের খয়রাতির অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।মেহনত করে নিজের অধিকার বজায় রেখে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ লোপ পাচ্ছে। একেই আমরা একধরনের উপগ্রহ অর্থনীতির একটা ধরন তথা অনুগ্রহের অর্থনীতি বলতে পারি। মানুষের ইজ্জত বলে কিছু থাকছে না।সঠিক পথে উন্নয়নের দিশা থাকছে না, তা বিপথে চালিত হচ্ছে। শাসকের ধমকানিতে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এ সবই হচ্ছে তথাকথিত সাংবিধানিক গণতন্ত্রের নীতি মেনে।
আজ পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে এক সর্বগ্রাসী অনুদান তথা খয়রাতির অর্থনীতি চালু হয়েছে যা ভারতকে একটা উপগ্রহ অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলার সর্বশেষ পরিণতি। আজের ভারতে এই খয়রাতি অর্থনীতির ওপর আমরা কিছুটা আলোচনা করব ভারতের স্বাধীনতার স্বরূপ আজকের প্রেক্ষাপটে বুঝতে। এই খয়রাতি অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি সংস্কৃতিতে এক বিকৃতি এসেছে। এই বিকৃত অর্থনীতির সূত্রপাত অনেক আগেই, কার্যত কংগ্রেস আমল থেকেই।আজ পশ্চিমবঙ্গসহ সাড়া ভারতে একে আরও উলংগ নির্মম করে তোলা হয়েছে যার ওপর দাঁড়িয়ে এক স্বৈরাচারী শাসন চলছে।কার্যত এই খয়রাতির অর্থনীতিই শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতা ধরে রাখার মদত যোগাচ্ছে।হ্যাঁ বলছি কংগ্রেস আমলেই এর সূত্রপাত। তবে সূত্রপাতটা হয়েছিল রেখে ঢেকে একটা নীতিকে সামনে রেখে নীতিগত ভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখে ঠিক স্বাধীনতার পর যখন ব্যাপক মানুষ এই নীতিগুলোকে প্রগতিশীল বলে মনে করতেন। কিন্তু এর অপব্যবহার, একে কেন্দ্র করে সুবিধাবাদকে সরকার প্রশ্রয় দিয়ে কার্যত এক ধরনের অনুগ্রহের খয়রাতির নীতিকে কার্যকরী করে তুলেছে যা আজ শাসকের হাতে বিষবৃক্ষ হয়ে উঠেছে কিছু উন্নয়নের কর্মসূচির মুখোশে। কংগ্রেস আমলে গৃহীত কিছু নীতি আমরা তুলে ধরছি উদাহরণ হিসেবে। শুরু করা যাক অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দিয়ে আর তার সঙ্গে সরকারি বিভাগে সরকারী চাকুরীর সুযোগ বৃদ্ধি নিয়ে। যখন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে পরিকল্পনার অর্থনীতি ভারতে চালু হয় ১৯৫১ সালে তখন তা ব্যাপক জনসমর্থন পায়। প্রয়াত জহরলাল নেহেরু তখন ভারতের প্রধান মন্ত্রী। যদিও নিজেদের বেসরকারি বিভাগে কাঠামো তৈরির স্বার্থে ভারতে টাটা বিড়লারাও পরিকল্পনার অর্থনীতি চেয়েছিলেন তার রূপ রেখ নির্ণয়ে (বোম্বে পরিকল্পনা যেটা গৃহীত হয়) সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাও জনসমর্থনের ঘাটতি ছিল না। এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিভাগ গড়ে ওঠে অর্থনীতির কাঠামো তৈরিতে। সাধারণ মানুষের টাকা রাষ্ট্রীয় পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরে ব্যাংক ইন্সুরেন্স সবই এই পুঁজি যোগানের উৎসক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। নীতিগত ভাবে একে বিরোধিতা করা যায় না। এর সঙ্গে সরকারি বিভাগে প্রচুর নিয়োগ বাড়ে। কিন্তু দেখা যায় কালক্রমে এর অপব্যবহার ঘটে। নিপুণভাবে একে চালাবার কোন প্রয়াস দেখা যায় না, একে রাষ্ট্রের তত্বাবধানে রেখে নৈপুণ্য দেওয়ার চেষ্টা হয় না। একধরনের সুবিধেভোগী দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মচারী একে নিজেদের মোশাহেবির জায়গা, ফাঁকি মেরে ঘুষ খেয়ে আখের গোছানোর জায়গা করে তোলে। এর ফলে এখানে বিনিয়োজিত সাধারণ মানুষের পুঁজির নিষ্কাশন (drain) হতে থাকে।সরকারি বিভাগ ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। সরকারি উদ্যোগের ওপর অনীহা বাড়ে। কার্যত সরকারি বিভাগ আজকের অনুদানের অর্থনীতির পূর্বসূরি হয়ে দাঁড়ায়। আজ বেসরকারিকরণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সরকারি ক্ষেত্রগুলো একের পর এক বেসরকারি কর্পোরেট বিভাগ জলের দামে কিনে নিচ্ছে। এই বিভাগগুলো সুবিধেবাদি একধরনের কর্মচারীর কাছে যেমন অনুদানের অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় আজ বেসরকারি কর্পোরেট বিভাগেরও এই কম দামে কিনে নেওয়াটা একধরনের অনুদানের বা খয়রাতির অর্থনীতি। বি এস এন এল কয়লা ব্যাংক উড়ান বীমা কোম্পানির বেসরকারিকরন এই বার্তাই বহন করে। এমন কি শিক্ষা স্বাস্থ্য বিভাগে বেসরকারি বিভাগ থাবা বাড়ায়। দেখা যাবে হয়তো সরকারি স্কুল ও হাসপাতাল বড় পরিকাঠামো সহ বিক্রি হয়ে যাবে জলের দামে। রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত কাউন্সিলর থেকে আরম্ভ করে এম এল এ এম পি সবাই এর অঢেল সুযোগ পাচ্ছে। তাদের আকাশ ছোঁয়া মাইনে নানা ধরনের অঢেল সুবিধা তার সঙ্গে কাট মানি। এরাই জনদরদী বন্ধু। পশ্চিম বঙ্গে ত্রিশ বছরের বাম রাজত্বও একে নিয়ন্ত্রন করতে পারে নি বা পাড়ার চেষ্টা করেনি। দেখা যাচ্ছে এককালের অনুসৃত জনপ্রিয় কল্যাণমূলক নীতিগুলো অপব্যবহারের ফলে তা সময়কালে অনাকাঙ্খিত অনুৎপাদনশীল খয়রাতি নীতিতে পরিণত হয়েছে ।
এবার আসা যাক সংরক্ষণের নীতিতে। সরকারের নেতৃত্বে কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে গরীব মানুষের নিজের অধিকারে নিজেকে দাঁড়াবার জন্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে বর্ণ ভিত্তিক ভারতীয় সমাজে কেবল গরীব নিম্ন বর্গের মানুষের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা বংশ পরম্পরায় চালু করে তাকে একটা সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর আখড়া বানিয়ে তোলা হয়েছে। দেখা হয়নি যে নিম্ন বর্ণের মানুষের মধ্যেও ধনী সুবিধেভোগী একটা সম্প্রদায় আছে। কার্যত সংরক্ষণের সুবিধা এরাই মূলত ভোগ করেছে ও করছে। নিম্নবিত্ত বনে যাওয়ার হাতিয়ার বানানো হয়েছে তপশিলিভুক্ত মানুষদের জন্য তৈরি হওয়া সরকারি অফিসকে যেখানে কার্যত নিম্নবর্ণের শংসা পত্র বিক্রি হয়। আমার পরিচিত কয়েকটি ব্যবসায়ী পরিবার নিম্ন বর্গ না হয়েও এই শংসা পত্র জোগাড় করে বলা ভালো কিনে নিয়ে বংশপরম্পরায় এর সুযোগ নিয়ে চলেছে।এটা ব্যতিক্রম নয়। এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ দলিতদের অধিকারের নামেও সারা ভারতে এটা চলছে। ফলে প্রকৃত গরিবদের সুবিধা হচ্ছে না। কার্যত একে সামনে রেখে এক ধরনের খয়রাতির অর্থনীতির বীজ বপন হয়েছে যার শিকড় বহু তলে বিস্তৃত। আর তাতে গরীব সমাজে বিভেদের বীজ বপন করা হচ্ছে ধর্ম বর্ণকে কেন্দ্র করে।এর ফলে মানুষের আত্মমর্যাদা থাকে না গরিবদের মধ্যে বিভাজন দেখা যায় মানুষ মেহনতের মর্যাদার কথা ভুলে যায়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণের মধ্যেও কাজের সুযোগের অভাবে দারিদ্র বাড়ছে। এরাও সুযোগ পাওয়ার দাবিদার হয়ে উঠছে। সরকার এ ধরনের সাহায্য করার প্রকল্পে মানুষের অর্থনৈতিক বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দেয় না বলে বর্ণ ধর্ম নিয়ে বিভেদের পথ খুলে যাচ্ছে। আজ এই নীতিগুলোর অপব্যবহার হয়ে চলেছে, এগুলো অপরাধের প্রযোজন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে যা পশ্চিমবঙ্গে উলংগ রাজার জন্ম দিয়েছে। গণতন্ত্র সংবিধান সবকিছুকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে এক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছে করপরেট দুনিয়া আর আজকের শাসক গোষ্ঠী আর তার দল।দেশকে কার্যত বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি ঋণে জর্জরিত হয়ে।
আজ কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন রাজ্য সরকার মানুষকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করার নামে খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গোটা চল্লিশ প্রকল্প চালু হয়েছে শুধু পশ্চিমবঙ্গে যা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে কোন না কোন ভাবে বেষ্টন করে আছে। এদের মধ্যে বেশিটাই ন্যুনতম নগদ দিয়ে সাহায্য করা। মেয়েদের সাইকেল দেওয়া ঘরে ঘরে রেশন পৌঁছে দেওয়া রোগীর চিকিৎসায় সাহায্য করা সরকারি নিয়োগ সংস্থায় নাম থাকা যুবকদের চাকুরী না পেলে আর্থিক সাহায্য করা গরীব ঘরের মেয়েদের টাকা দিয়ে ‘লক্ষীর ভান্ডার‘ পূর্ন করা ইত্যাদি। এর সঙ্গে আছে ক্লাবকে বা বারোয়ারি পূজায় অর্থ সাহায্য দেওয়া।
উল্লেখযোগ্য রাজ্য প্রকল্পগুলো কতকগুলো কেন্দ্রের প্রকল্পের অনুরূপ ও তাদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে। কিন্তু কোন প্রকল্পই মানুষকে উপযুক্ত মজুরি দিয়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে না। অর্থাৎ মানুষের খেটে রোজগার করে খাওয়া পরার তাগিদকে সন্মান দেয় না। সরকারি অনুগ্রহে কোনমতে বেঁচে থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়। অথচ এর জন্য অঢেল টাকা খরচ। দেশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য খরচ হয় না। এই বিপুল টাকা পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। সেই অর্থে খরচটা আর্থিক নিষ্কাশন। আর মানুষকে ক্ষমতার তাবেতে রাখার চেষ্টা যাতে নির্বাচনে ভোট পাওয়া যায়। এর পরে প্রশ্ন ওঠে টাকাটা সত্যি কতটা কার কাছে পৌঁছয়। এর থেকে আঞ্চলিক স্তরে রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা বখরা পায় কি না।এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন কর্মী নেতাদের মধ্যে বাদ বিবাদ খুনোখুনি আমরা প্রায়ই দেখি, খবর পাই। তারপরও প্রশ্ন সবকটা প্রকল্প কিভাবে কার্যকরী হয় বা আদৌ হয় কি না। যেমন ধরুন পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প। কার্যত সরকারি হাসপাতালে গরীব মানুষের জন্য বিনা পয়সায় চকিৎসা ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই আছে। এটা নতুন নয় অর্থাৎ এটাকে নতুন স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প বলা চলে না। তবে প্রয়োজনের তুলনায় হাসপাতাল খুব কম থাকায় বিনা খরচায় চিকিৎসার সুযোগ খুব কম মানুষ পেয়ে থাকে। গ্রামে গঞ্জে যতটুকু স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে সেখানে কঠিন রোগের চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই। যেতে হয় শহরে। শহরে রোগীকে নিয়ে চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা প্রান্তিক মানুষের নেই। চকিৎসা অধরাই থাকে। তাছাড়া হাসপতালে ভালো চিকিৎসা হয় না বলে প্রচার আছে। আর সরকারি অফিসের গাফিলতির কথা আমরা আগেই বলেছি। তাই যারা ঘটি বাটি বিক্রি করে হলেও ভালো চিকিৎসা চায় তারা নার্সিং হোমে যায়। আর আর্থিক সঙ্গতি যাদের যথেষ্ট তারা হাসপাতাল বর্জন করেছে। এখানেই স্বাস্থ্য সাথীর কার্যকারিতা।স্বাস্থ্য সাথী কার্ড থাকলে সরকার স্বীকৃত নার্সিং হোমে চিকিৎসা বিনামূল্যে করানো যায়। সরকার নার্সিং হোমকে টাকা দিয়ে দেয়। এখানে প্রশ্নটা থেকে যায়। নার্সিং হোম যেগুলো এই প্রকল্পের আওতায় আসে তারা খুব কম আসন স্বাস্থ্য সাথীর জন্য রাখে।আর দেখা গেছে যাদের যোগাযোগ আছে একটু উচ্চবিত্ত তারাই এর সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের বক্তব্য হলো যাদের অর্থ আছে আর সামাজিক মর্যাদার জন্য হাসপাতালে যায় না তাদের এই সুযোগ দেওয়া মানে গরীব মানুষদের বঞ্চিত করা। আর সরকার থেকে টাকা পাবার সুবিধা পায় নার্সিং হোমগুলো।একে হাসপাতাল বেসরকারিকরণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। এতে হাসপাতালের ওপর আস্থা আরও কমবে। আর সরকারি পুঁজি তথা জনগণের টাকায় লাভবান হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।গরীব মানুষের উপকার হবে না। বিভিন্ন প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করলে এই ধরনের নানা ছিদ্র ধরা পড়বে যার ভেতর দিয়ে বয়ে চলবে মুনাফার ফল্গুধারা, সমাজের দুর্নীতি আর রাষ্ট্রের ফাঁকা আওয়াজ। নিষ্কাশিত হয়ে চলবে সামাজিক পুঁজি যা উন্নয়ণের কাজে লাগতে পারত।আর এই প্রকল্পগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগদে অনুদান দেওয়ার দিকটা গুরুত্ব পায়। তাই দেখা যায় মানুষের পরিশ্রম করে রোজগারের গুরুত্বকে অমান্য করা হয়। মানুষের সংস্কৃতিতে বিনা পরিশ্রমে খাওয়াযর প্রবণতা বাড়ে। তার মর্যাদা বোধ হারায় ।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বাজার ব্যবস্থার দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করব যা আমাদের মূল আলোচনাকে বুঝতে সাহায্য করবে। আজের অর্থনীতির স্বরূপ যাতে ফুটে উঠবে। দুটি দিকের মধ্যে একটি হল যোগানের দিক আর একটি হল চাহিদার দিক। বাজার ব্যবস্থা মনে করে দেশে যদি উৎপাদন বাড়ে তবে কলে কারখানায় ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োগ বাড়বে। কর্মে নিযুক্ত মানুষের হাতে টাকা আসবে। কেনাকাটা বাড়ে। কেনাকাটা বাড়ে মানে চাহিদা বাড়ে। সরকারের বিশেষ সাহায্য ছাড়াই অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে। উৎপাদন হওয়া মানে যোগান বাড়া। আবার চাহিদার দিক দিয়ে বলা হয় চাহিদা বজায় রেখে তাকে বাড়িয়ে চলতে পারলে উৎপাদকের ক্ষিদে বজায় থাকে সে পুঁজি নিয়োগে উৎপাদনে উৎসাহ পায়। শ্রম নিয়োগ বাড়ে। উৎপাদন বাড়ে।ফলে যোগান বাড়ে। আবার নিয়োগ বাড়ে বলে আয় বাড়ে চাহিদা বাড়ে সরকারের তেমন অংশগ্রহণ দরকার হয় না। অর্থনীতি নিজ গতিতে চলে। এইভাবে বাজার ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে যোগানের দিক থেকে আবার চাহিদার দিক থেকে দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা এত মসৃণ ভাবে চলে না। শ্রম বাঁচানোর প্রযুক্তির উদ্ভব দেশের আর্থিক বৈষম্য যাদের বেশি টাকা আছে তার সবটা খরচ না করার তথা টাকা হাতে রাখার তাগিদ দেখা দেয় বলে যোগান যতটা চায় ততটা চাহিদা থাকে না । ফলে মাল বিকৃতিতে টান পরে। বাজার সংকট দেখা যায়। এই সংকট কাটাবার জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ চাহিদা যে ভাবেই হোক বাড়িয়ে বাজার তাজা রেখে সংকট কাটাবার কথা বলেন। এই চাহিদা উৎপাদন ও নিয়োগ বাড়াবার দিক থেকে না এলে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের হাতে টাকা দিয়ে দরকারে চাহিদা বাড়াতে হয়। তাতে উৎপাদন বাড়ুক বা না বাড়ুক। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেইনস চাহিদা সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে বাঁচাবার কথা বলেন। দরকারে রাস্তা খুঁড়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হোক তাতে যে টাকা শ্রমিকের পকেটে আসে তা চাহিদার সৃষ্টি করে।আর টাকার যোগান দেবে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে।সরকারি বাজেটে ঘাটতি রেখে চাহিদা বাড়িয়ে তোলার তাগিদে এই নিদান যাকে ঘাটতি ব্যয় নীতি বলা হয়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে চাহিদা সংকট কাটাবার তাগিদে এই নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল।উন্নত পুঁজিবাদী দেশে বাজার সংকটের সময় যোগান দেওয়া পণ্য অবিক্রিত থেকে যায় বলে অর্থনীতির মন্দার সময় এই নীতি গৃহীত হয় কেইনসের নিদান অনুযায়ী। একে কেইনসের অর্থনীতি বলে যা উৎপাদনশীল কাজে শ্রমের ব্যবহারের কথা বলে না। সরকারের সহযোগিতায় টাকার যোগান বাড়িয়ে মাটি খুঁড়ে বন্ধ করার মত অনুৎপাদনশীল কাজে শ্রমের ব্যবহারের কথা বলে। এও একধরনের অনুদান অর্থনীতিকে সমর্থন করে যা আজ পশ্চিম বঙ্গ সহ সব রাজ্য চালু করেছে কেন্দ্রের আনুকূল্যে।তামিল নাদুতে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয় ললিতা এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন। এই অনুৎপাদনশীল কর্মবিমুখ অর্থনীতিই আজ পশ্চিম বঙ্গের মমতা অর্থনীতি যাকে আমরা অনুৎপাদনশীল অনুদানের অর্থনীতি বলেছি।কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন প্রকল্পে এই নীতি গ্রহণ করে চলেছে।এতে সত্যিকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না। স্বল্পকালীন জোড়াতালির ব্যবস্থা হয় কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে। বাজার অর্থনীতিতে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষের কর্মংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে। টাকার যোগান বাড়িয়ে চাহিদা বাড়িয়ে এইভাবে অর্থনীতিকে চালানোকে আমরা অনুৎপাদনশীল খরচ বলে মনে করি যা সত্যিকারের অর্থনীতির কাজ নয়। সেখানে যোগানের দিক থেকে শ্রম নিয়োগের দিক থেকে বাজার ব্যবস্থার গুরুত্ব কমে যায়। আজ পুঁজিবাদের এই চাহিদা সংকট একটা স্থায়ী সংকট। কিন্তু ভারতের মত দেশে এই নীতি ভয়াভয় এক মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় অর্থনীতির নিশ্চলতা বজায় রেখে যাকে ইংরেজিতে stagflation বলা হয়।
দেখা গেল যে আজ আমাদের দেশে খোরাকি দিয়ে জনগণের মঙ্গলের নামে এই চাহিদা বজায় রাখার নীতি কেন্দ্র রাজ্য উভয় পক্ষই চাইছে দুটো কারণে। সরকার চায় এইভাবে অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ করে মানুষকে খোরাকি দিয়ে নিজের ভোট ব্যাংক বজায় রাখতে। এতে মানুষকে আনুগত্যে বেঁধে রাখতে পারে বলে ক্ষমতাসীন দল মনে করে। সরকার জানে তাদের পক্ষে আজ বিশ্বায়নের নিদান বেসরকারিকরণ ঘটিয়ে কর্মসংস্থান বাড়িয়ে চাহিদা বজায় রাখা সম্ভব নয়। কারণ বেসরকারি সংস্থা কমখরচে শ্রমের নিয়োগ না বাড়িয়ে উৎপাদনে বিশ্বাসী।আর কর্পোরেট দুনিয়া আজ উন্নত শ্রম বাঁচানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাভ বাড়াতে চাইছে। কিন্তু তাতে চাহিদার সংকট তৈরি হয়। সেটা মেটাতে সরকার যদি খয়রাতির অর্থনীতি চালায় তবে তাদের চাহিদা সংকট কিছুটা হলেও মেটে। আর সেটা ঘটে সরকার তথা সাধারণ মানুষের টাকায়। এর ফলে মানুষের কোমর ভেংগে যায় সে শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলতে পারে না। মানুষের অধিকারের দাবিতে জীবন জীবিকার তাগিদে লড়াই দানা বাঁধতে পারে না। এটা কর্পোরেট হাউস ও সরকার উভয়েরই বড় প্রাপ্তি। আজ যেটা আমরা দেখছি। আর এখন রোবট কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার সাংগঠনিক চেহারাটা বদলে গেছে। উৎপাদন সংগঠন অল্প শ্রমে ছোট পরিসরে উন্নত প্রযুক্তিতে চলে। সেখানে নিয়োগ সুযোগ খুবই সীমিত। বাজারের সীমাবদ্ধতার জন্য সেইভাবে উৎপাদন আর যোগানকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা চলে। উন্নত প্রযুক্তিকে প্রয়োজনে ব্যবহার করেও আরো শ্রম নিয়োগের ব্যবস্থা কি করে করা যায় তা নিয়ে ভাবা হয় না । এই বিষয়ে আমি দুচারটে কথা বলছি কিন্তু বিষয়টা বড় পরিসরে বিস্তৃত আলোচনা দাবি করে। উন্নত প্রযুক্তিতে শ্রম কমিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শ্রমিককে দিয়ে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন করানো যায়। এতে মার্কসের ভাষায় উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ে। যেমন উন্নত প্রযুক্তিতে আগে ১০ ঘণ্টায় যা উৎপাদন করা যেত আজ সাতঘনটায় তাই করানো যায়। কিন্তু শ্রমিককে আগে সে চার ঘণ্টায় যে উৎপাদন করত তার বাজারমূল্য ধরে মজুরি দিত। ফলে ছ ঘণ্টার উৎপাদন উদ্বৃত্ত মূল্য বলে বিবেচিত হত। এখন উন্নত প্রযুক্তিতে অনেক কম সময়ে সমান উৎপাদন করে বলে আর তার মজুরি তেমন বাড়ে না বলে উদ্বৃত্ত উৎপাদন মূল্য বাড়ে যার মালিক কোম্পানি। অর্থনীতিতে বণ্টন বৈষম্য বাড়ে। ফলে গরীব মানুষের বাজারে ক্রয় ক্ষমতা বাড়তে পরে না। একদিকে কর্মসংস্থানের অভাব অন্যদিকে সমাজের বৃহদাংশ গরীব মানুষের স্বল্প ক্রয় ক্ষমতা বাজার সংকটকে ঘনীভূত করে। এই অবস্থায় স্বল্প সংখ্যক বিত্তশালীদের চাহিদা মিটিয়ে টিকে থাকতে হয় কোম্পানি মালিক সম্রদায়কে। আমরা দেখি তাঁদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন বাড়ে। সে সব দ্রব্য আধুনিক প্রযুক্তিতে উৎপাদিত অভিজাত পণ্য সামগ্রী।গাড়ি আধুনিক ফ্ল্যাট নানা ধরনের সাজগোজের পণ্যসামগ্রী দামী রেস্তোরায় বাজার ভরে যায়। এছাড়া আছে আজের স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ভিত্তিক উৎপাদন।কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনিক প্রয়োজনের পণ্য উৎপাদনে তেমন নজর থাকে না। সে সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।এর চাপ সহ্য করতে হয় প্রধানত গরীব মানুষকে। অনুদানের অর্থনীতিতে টাকার যোগান বেড়ে যায় বলে চাহিদা যা বাড়ে তাতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায় কারণ নিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটে না অনুদানের অর্থনীতিতে। এর সঙ্গে বৈদেশিক বানিজ্যে ঘাটতি বাড়ে দেশের ঋণ বাড়ে।কার্যত দেশের অর্থনীতির এক নির্ভরশীল উপগ্রহ অর্থনীতিতে পরিণত করা হয়।
উপসংহার:
আমরা ওপরের আলোচনায় আজকের ভারত বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে অনুসৃত অনুগ্রহের অর্থনীতির ধরনটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখলাম যে এটা ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে পরোক্ষে গৃহীত কিছু জনপ্রিয় কল্যাণমূলক নীতির অপপ্রয়োগের পরম্পরা। তবে সেটা ধীরে সুস্থে পরিকল্পনা আর নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতির আড়ালে অনুসৃত হয়েছিল প্রথম যুগে। আজ সেটা খোলা বাজারে কর্পোরেট অর্থনীতির মদতে চলছে রাষ্ট্র যেখানে কর্পোরেট অর্থনীতির খোলাখুলি লেজুড় বৃত্তি করে চলেছে। আর মমতার মত নেত্রীরা সস্তা জনসমর্থন নিয়ে এই অনুগ্রহের নীতি অনুসরণ করে চলেছে যা মানুষকে শ্রম বিমুখ করে তুলছে, অর্থনীতির রাজনীতির দুর্নীতিকরণ ঘটিয়ে চলেছে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা অর্থনীতির কিছু তত্ত্বকথা এনেছি যা বিষয়টাকে সমগ্রকতায় বুঝতে সাহায্য করবে। এটা যেমন তৃণমূল স্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্বৃত্তায়নের বীজ বপন করে মানুষকে শ্রমবিমুখ করে ব্যবস্থাটাকে অনুৎপাদনশীল করে তোলে তেমন বৃহত্তর পরিবেশে কর্পোরেট দুনিয়ার অর্থনীতিকে স্বল্পকালীন অক্সিজেন দিতে চায়। কিন্তু দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় অনুৎপাদনশীল। মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধকে দমিয়ে রাখতে চায়। তাদের সহযোগী হয়ে ওঠে কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের শাসক গোষ্ঠী। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অলিখিত বোঝাপড়া তৈরি হয়। চেষ্টা করেছি দেখাতে কিভাবে এই ধরণের পরজীবী অনুগ্রহের অর্থনীতি একটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দেয় অর্থনীতিকে অনুৎপাদনশীল করে তোলে আর ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। একে আমরা অনুগ্রহের অর্থনীতির বিষফল বলে মনে করি। দেশের অর্থনীতি একটা উপগ্রহ অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় যা স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে বুড়ো আংগুল দেখা দেয়।
কোন দেশকে ঋণের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ রেখে দেউলিয়া নির্ভরশীল একটা উপগ্রহ অর্থনীতিতে পরিণত করতে পারলে অবাধে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর লুঠের কাজটা সরাসরি দেশদখল করে তাকে শাসন না করেও চালিয়ে যাওয়া যায় আজের বিশ্বায়িত দুনিয়ায়। আর আজ এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোতে আমেরিকা ইউরোপের দেশগুলো এমন কি রাশিয়া চীনের মত তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশও সেটাই করে চলেছে দেশটার প্রযুক্তির ওপর দখল রেখে ব্যাংক ইন্সুরেন্স কোম্পানী সবাইকে অবাধে ব্যবহার করে। বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে টাকার দাম বিশ্বের বাজারে কমিয়ে আর ডলারের শাসন বজায় রেখে। আমরা দেখি প্রযুক্তি আর বিভিন্ন শিল্প পণ্য পেট্রোল ভারতের মত দেশগুলো বেশী দামে কেনে আর নিজেদের দেশের পণ্য বিদেশের কাছে কমদামে বেঁচে। বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়। ঘাটতি মেটাতে ডলারে ঋণ নিতে হয় বিভিন্ন শর্তে। কম দামে। বিশ্ব ব্যাংক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এসব কারবারে সাহায্য করে।দেশের সম্পত্তি বিক্রির শর্ত ঋণদানকারী দেশ থেকে বেশি দামে আমদানি তাদের দেশের বহুজাতিক সংস্থাকে অবাধে ঢুকতে দেওয়া তাদের স্বার্থে কৃষি ব্যাংক ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে কর্পোরেট বিভাগে ঋণ দিতে বাধ্য করা। এসব কিছুই একদিকে দেশকে ঋণগ্রস্ত করে তোলে অপরদিকে দেশের সম্পদের নির্গমের পথ প্রশস্ত করে। দেশ মেরুদন্ডহীন এক উপগ্রহ অর্থনীতিতে পরিণত হয়। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উন্নয়ন করার জায়গায় কাজ করে অর্থনীতিকে অনুগ্রহের অর্থনীতিতে পরিণত করে তাকে বশীভূত রাখা।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন