Featured Post
গল্প ।। শিকড়-সন্ধানের গল্প অথবা সন্তান-বিরহের আখ্যান ।। চন্দন মিত্র
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শিকড়-সন্ধানের গল্প অথবা সন্তান-বিরহের আখ্যান
চন্দন মিত্র
অলিভিয়া ফেরেনি, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। কলেজ থেকে ফিরে খবরটা শুনে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়লেন তপন মণ্ডল। তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়ল স্ত্রী দীপালির উপর। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।
— আমাকে তো ফোন করতে পারতে একবার।
— আমি জানব কী করে যে ও এমন কাণ্ড ঘটাবে। ছ-টার মধ্যে তো বাড়িতে ঢোকে। আমি স্কুল থেকে ফিরে একবার ফোন করেছিলাম। দেখলাম নট রিচেবল। তখনও ছটা বাজেনি। ভাবলাম টাওয়ারের সমস্যা। তারপর মিনতিদিকে রান্নার দিকটা বুঝিয়ে দিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভাবলাম রাস্তায় আছো সাতপাঁচ ভাববে, তাই আর তোমাকে ফোন করিনি। সকালবেলা ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি বলে বেরোল। তবে অন্যদিনের তুলনায় অনেকটা তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। খেয়ে যেতে বললাম। বলল, ক্যান্টিনে খেয়ে নেবে।
কয়েকদিন আগে অলিভিয়ার কিনে আনা আদ্যিযুগের পুরোনো মডেলের পেন্ডুলাম ঘড়িটা ঢং ঢং করে আটবার বেজে উঠল। তপন মণ্ডল বারবার রিং করে যাচ্ছেন এই আশায়, যদি হঠাৎ করে রিং হয় আর অলি মধুর কণ্ঠে বলে ওঠে, হ্যাঁ বাপি বলো ! এখন বলছে সুইচড অব।
দীপালি শোনান আরও ভয়ানক কথা।
— ওর সঙ্গে যারা এমফিল করছে তাদের একজনকে ফোন করেছিলাম, সে জানিয়েছে আজ ওদের ক্লাসই ছিল না।
— শোনো যা দিনকাল চলছে, আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি বেরোচ্ছি। প্রথমে থানায় যাব, তারপর দেখি...
— মিনতিদিকে আজ না-ছাড়লেই ভালো হতো বুঝলে। কিন্তু কীকরে বুঝব ! তুমি এক কাজ করো, জামাকাপড় ছেড়ে হাতেমুখে একটু জল দাও। হালকা কিছু খেয়ে নাও, আমি একটু চা করে দিচ্ছি। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো কী করা যায়। তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না।
তপন মণ্ডল চায়ে চুমুক দিতে দিতে করণীয় ভাবতে থাকেন। দীপালি সোফায় বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কী মনে করে চার্জার থেকে ফোনটা খুলে অন করেন। চা শেষ করে বেরিয়ে প্রোফেসর মণ্ডল লিফটে পা রাখবেন, ঠিক সেই সময়ে দীপালির আচমকা চিৎকারে তিনি তড়িদাহতের মতো কেঁপে ওঠেন। ফিরে এসে দেখেন দীপালি ফোনটি হাতে ধরে অট্টহাস্য করছেন। মুহূর্তে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় তপন মণ্ডলের। তবে কী যা আশঙ্কা করেছিলেন ...
দীপালি এবার অনেকটাই প্রকৃতিস্থ, হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন — দ্যাখো আমাদের পাগলিটার অবস্থা দ্যাখো। তোমার চা খাওয়ার সময় হঠাৎ আমার মাথায় খেলে যায়, দেখি তো ওর ফেসবুক প্রোফাইলটা, কোনো ক্লু যদি পাই। এই দ্যাখো তোমার মেয়ের কাণ্ড, বিকাল চারটের সময় পুন্যিপুকুর চড়কমেলা থেকে লাইভ করেছে।
— কই দেখি।
এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নেন তপনবাবু। তাঁর মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছায়া সরে যায়। তাঁদের কলিজার টুকরো তখন গ্রামের সোনারোদ মেখে চৈত্রের ঝোড়ো বাতাসে চুল উড়িয়ে একমুখ হাসি নিয়ে ভাষণ দিয়ে চলেছে —
'বন্ধুরা আজ আমি তিনঘণ্টা জার্নি করে এসে পড়েছি আমার দেশের বাড়ি পুন্যিপুকুর গ্রামে। প্রায় পনেরো বছর পরে এলাম আমার জন্মগ্রামে। এই যে আমার পিছনে রাশিরাশি হলুদ ফুল দেখছেন এগুলি সূর্যমুখী ফুল, সান ফ্লাওয়ার। আমার কাকা-জ্যাঠা ও পুন্যিপুকুরের অন্যান্য চাষিরা চাষ করেছেন। এর বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়, সান ফ্লাওয়ার অয়েল নামে যা বহুল পরিচিত। এই যে স্কুলটা দেখছেন পুন্যিপুকুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, এখানে আমার ঠাকুরদা গোপীনাথ মণ্ডল, বাবা অধ্যাপক তপন মণ্ডল, কাকা স্বপন মণ্ড্ল, জ্যাঠা বপন মণ্ডল সবাই পড়েছেন। আমিও এই স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। তারপর বাবা হাইস্কুলের চাকরি ছেড়ে কোলকাতার কলেজে যোগ দিলেন, মাও কোলকাতার একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেলেন। ব্যাস গ্রামের পাঠ উঠে গেল। গিয়ে ঢুকে পড়লাম মহানগরীর ফ্ল্যাট নামক খাঁচাবাড়িতে। আমার মামার বাড়ি পাশের গ্রাম তিরপুন্যিতে। দাদু-দিদা মারা গেছেন, মামা তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে উঠেছেন দমদমের এক খাঁচাবাড়িতে। এতদিন বিভিন্ন টুরিস্ট স্পট আর দমদমের মামার বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার পৃথিবী। বাড়ির কাছের এই আরশি নগরে পৌঁছাতে কেটে গেল আমার এতগুলো বছর। মা-বাবাকে কতবার বলেছি, তাঁরা আমাকে গ্রামের বিভিন্ন অসুবিধার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা আর গ্রামের মাটিতে পা রাখবেন না। অথচ বন্ধুরা দ্যাখো, গ্রামেই তো আমার শিকড় তার টান কীকরে অস্বীকার করি ! এই যে চরকতলার মাঠ এখানে কত আনন্দ করেছি একসময়। আর ওই দেখুন মাঠের কিনারা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে আমাদের চাঁদভাসি খাল। ওর জলে কত সাঁতার কেটেছি একদিন। এখানে আমার কাকা-জ্যাঠা আছেন তাঁদের পরিবার আছে। ঠাকুরদা নেই, ঠাকুরমা আছেন। সকলের সঙ্গেই একে একে তোমাদের পরিচয় করাব। একটু পরেই মূল সন্ন্যাসী চড়ক গাছে উঠবেন, শুরু হবে চড়ক গাছের চক্কর। কালকে পয়লা বৈশাখ, এই মাঠে বসবে গোষ্ঠমেলা। বন্ধুদের সবাইকে জানাচ্ছি চৈত্র সংক্রান্তির প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আর হ্যাঁ নববর্ষের প্রীতি শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন আগাম জানিয়ে রাখলাম। বন্ধুরা কদিন আমি পুন্যিপুকুরেই থাকছি। সঙ্গে থেকো বেশ মজা হবে। আর হ্যাঁ চুপি চুপি তোমাদের একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমি বাবা-মাকে না-জানিয়েই এখানে এসেছি। কদিন অন্তত তাঁরা আমার ঠাকুরমার মতো বুঝে নিক সন্তান-বিরহ কাকে বলে ...
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন