Featured Post
প্রবন্ধ ।। আবেগের নববর্ষ -- ঐতিহ্যের পয়লা বৈশাখ || মৃণাল কান্তি দেব
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
প্রসঙ্গ: আবেগের নববর্ষ -- ঐতিহ্যের পয়লা বৈশাখ
মৃণাল কান্তি দেব
নববর্ষ - জীর্ণ বিদীর্ণ প্রাচীরবক্ষে কিংবা ক্ষয়ীভূত কোনো শিরায় নব আনন্দের রোশনাই এ, নব সৃজনের ওড়নায়,নব চিন্তনের আবেশে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে মহাসমারোহে উদযাপন করার এক নাম। বাংলা ও বাঙালির জীবনে এমনকি বাংলা ঘেঁষা সমস্ত আঞ্চলিক গোষ্ঠীর কাছে খুশির দিন,আবেগের দিন,
সুপ্রাচীন ও চিরনবীন এক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার দিন। ইতিহাস থেকে জানা যায়,যে সময় ফসল উঠতো সেই সময় কর না নিয়ে অন্য সময় কর নিতেন রাজা ও রাজার রাজস্য দফতর ।ফলস্বরূপ হিসেব সংক্রান্ত সমস্যায় পড়তেন কৃষকরা। সেইখান থেকেই হালখাতার বিষয়টি এসেছে, যদিও বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ। আবার, "বঙ্গাব্দ " র প্রচলন কে করেছিলেন ,তা নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও একথা বলাই যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার কয়েকযুগ আগে থেকেই জাঁকজমকভাবে পালিত হতো নববর্ষ,ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই নববর্ষের নানা চিত্র। চৈত্রের শেষদিন পর্যন্ত কৃষকরা জমিদার, ভূ-স্বামী ও তালুকদার দের খাজনা মিটিয়ে দিতেন এবং পরের দিন থেকে প্রজাদের মিষ্টি মুখ করিয়ে নতুন খাতায় সমস্ত সমস্ত ধরণের হিসেব লেখা শুরু করতেন।আর্থসামাজিক দিক থেকেই হোক, কিংবা রাজা-প্রজাদের মধ্যে থাকা পারস্পরিক সৌজন্যের নিরিখে, সকল স্তরের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ হয়ে উঠেছিল ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।
তৎকালীন সব সম্রাটদের অধীনস্থ অনেক জমিদাররা প্রজাদের আমন্ত্রণ জানাতেন তাঁদের রাজকীয় গৃহে।ভোজনাদির ব্যবস্থা তো থাকতোই, পাশাপাশি থাকতো লোকশিল্পের প্রদর্শন তথা লোকগান, জাদুবিদ্যা, ব্যায়ামের সাথে সম্পর্কিত নানা কসরত এর মতো বিষয়। প্রতিবেশী প্রদেশ থেকে রাজাদের দূতরা আসতেন। আবার ইতিহাসের কালপঞ্জী থেকে হারিয়ে যাওয়া অনেক শাসক এদিন থেকে শুরু করতেন প্রতিরক্ষা বিষয়ক নানা পরিকল্পনা। ইতিহাস ঘাটলে দেখতে পাবো যেখানে অত্যাচারী রাজা আর অত্যাচারিত প্রজা নেই, সেইখানেই নববর্ষ পেয়েছে তার গৌরবময় স্থান, অন্তত তৎকালীন। আবার পাশাপাশি, এটাও মনে রাখতে হবে, কূটনৈতিক জমিদাররা, ভূ -স্বামী দের একাংশ এই দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন প্রজাদের হাতের মুঠোয় রাখার জন্য।
অন্যান্য বিষয়ের মতো নববর্ষ উদযাপন ও বিবর্তনের গিরিখাত দ্বারা প্রবাহিত হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের আগমন পরোক্ষভাবে বঙ্গদেশের পয়লা বৈশাখকে নতুন মাত্রা দান করেছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালিয়ানার মধ্যে প্রবেশ করেছিল রাজকীয় সত্ত্বা।
পুস্তক,বস্ত্র,আসবাবপত্র - সমস্ত ধরণের বঙ্গীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে নববর্ষ শব্দের অন্য অর্থ হল বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিতকে পুনর্নবীকরণ করার প্রয়াস। ব্রিটিশ সরকার এর একাংশ মূলত এই বিষয়টা মাথায় রেখেই পয়লা বৈশাখ পালনের বিষয়টাকে একপ্রকার মেনেই নিয়েছিলেন। এতো কিছুর মাঝখানে সবথেকে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ , তা হল -এই উৎসবকে ঘিরে থাকা আবেগ আনন্দের রোশনাই , আঞ্চলিক নানা সংস্কৃতির মেলবন্ধন হওয়া, কৃষ্টি ও সৃষ্টি পাখনার বর্ণময় সম্প্রসারণ। মোটামুটি ছবিটা এরকম দাঁড়ায় : গ্রাম,মফঃস্বল ও শহরের রাজপথ জুড়ে প্রবল ব্যস্ততা, হালখাতা করতে বেরিয়েছেন মানুষরা, দোকানে প্রবল ব্যস্ততা, সাহেবঘেঁষা প্রবীণ ও নবীনের দল তাঁদের নিজস্ব ঠেক বা আখড়ায় বসে নানা বিষয়ে আলোচনা করছে, মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে চলছে যেন মহা যজ্ঞ, পশ্চিমী হাওয়াতে জারিত হওয়া প্রাচ্যভূমের বঙ্গীয় সংগীতগুলো যেন একসাথে কোরাস গাইছে আর নতুন প্রতিধ্বনি তৈরী হয়েছে মননে, চেতনে আর চিন্তনে। সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং মা লক্ষ্মী এর পুজো আর নববর্ষ পরস্পর সমর্থক। শাস্ত্র অনুযায়ী,গণেশ হলেন বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা, শিল্প-কলার পৃষ্ঠেপোষক, অশুভ শক্তি বিনাশকারী, আর দেবী লক্ষ্মী ধনসম্পদের দেবী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে,নতুন বছরে লক্ষ্মী গণেশ এর আরাধনা ভীষণ তৎপর্যপূর্ণ।
সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া রাজপথ জুড়ে কখনো সারিগান,বাউল, মুর্শিদি, ভাটিয়ালী সংগীতের আবেগময় পরশ। শহরের অনতিদূরে থাকা গ্রামে গঞ্জের মেলায় অনুষ্ঠিত হত রাধা কৃষ্ণ, লাইলী মজনু সহ নানা আখ্যান। প্রভাবশালী জমিদারদের তালুকে প্রচলন হয়েছিল
ঘুড়ি ওড়ানো, পায়রা ওড়ানো, লোকনৃত্য পরিবেশন, নৌকো বাইচ, লাঠিখেলা ইত্যাদি। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে পয়লা বৈশাখ এর আড়ম্বর, তাকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো। টপ্পা, ঠুংরি, খেয়াল এর সাথে প্রগতিশীল বাংলার জমিদারি পাকশালায় তৈরী হওয়া দেশি বিদেশী খাবার - অসাধারণ যুগলবন্দী। সৃজনশীল বাঙালি, রুচিশীল বাঙালির সংজ্ঞা তৈরী হয়েছিল তৎকালীন সময়ে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া তরুণ প্রজন্ম পয়লা বৈশাখের দিন আবদ্ধ হতো সম্প্রীতি ও মৈত্রীর বাহুডোরে। শাস্ত্র,শিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করার অন্যতম এক মধ্যম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো
এই পয়লা বৈশাখ। বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে নববর্ষ মানে ছিল শপথ গ্রহণের দিন, লড়াই করার অদম্য সাহসকে হৃদয়ে ঠাঁই করবার লগন। উত্তপ্ত দিবসরজনীর অনুক্ষনেও পয়লা বৈশাখ কিন্তু ছিল এক মুঠো দমকা বাতাস। জাতীয়তাবাদ এর ডানায় ভর করে চলা নববর্ষর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যুক্ত হয়েছিল আবেগের নানা রং। বহু স্বদেশী কর্মকান্ডের উদ্বোধনে সাক্ষী হিসেবে থেকেছে পয়লা বৈশাখ। চোখে চোখ রেখে লড়াই করার ভাষাকে নবরূপে সজ্জিত করেছিল নতুন বছরের প্রথম দিনটা। প্রগতিশীল পরিকল্পনার যুগকে সেদিন নব সাহানায় লেখার সাহস পেয়েছিলো এই পয়লা বৈশাখ। আবার,বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখী অগ্নিস্নান এর কথা উল্লেখ করে জরা জীর্ণ প্রাচীরকে উৎপাটিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
লোকশিল্পকে ঘিরে বেঁচে থাকা মানুষগুলো থেকে আরম্ভ করে ছাদে ফানুস ওড়াতে থাকা দুটো হৃদয় আজও নতুন ভাবে স্বপ্ন দেখে, নতুন গতিতে বাঁচতে শেখে, নতুন সৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়, নতুন ছন্দে মাতোয়ারা হয়। যুগ বদলেছে, বদলেছে সময়। স্বাভাবিকভাবেই নববর্ষের গতিপথে বদল এসেছে, নববর্ষে মিশেছে নব্য আধুনিকতার চিরন্তনী রং। পরিশেষে এটুকু বলতে পারি,নববর্ষতেই নতুন গতিতে লেখা হোক নতুন জাগরণী সুর, তাল, লয়।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন