প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

ছো ট গ ল্প
জলঙ্গির পরান মণ্ডলের বড় মেয়ে নন্দা মাত্র টেন ক্লাস পাশ। পরানকে ওর স্ত্রী এক রাতে জানায় মেয়ে নাকি পাশের পাড়ার একটা অল্প বয়সী ছেলের সাথে প্রেম করছে। পান থেকে চুন খসলে যেমন বয়স্ক মানুষরা রেগে যান, সতের বছরের মেয়ে এখনই প্রেমে পড়েছে শুনে পরানও সেরকম রেগে আগুন হয়ে গেল। কিন্তু ওর বৌ কল্পনা খুব চালাক চতুর মহিলা। জানে এরপর আরেকটা মেয়ে আছে ওদের, কয়েক বছর পরে তাকেও বিয়ে দিতে হবে। পরান একটা ছোট মুদির দোকান চালায়। ওদিকে মেয়ে যেই ছেলেটাকে ভালোবাসে সে নাকি একটা টোটোর মালিক। যদিও নিমাই ঘোষ নামের ছেলেটি নাকি ওর বাপ মায়ের পালিত সন্তান। কল্পনা তার স্বামীকে বোঝায়, ‘ছেলের বাপ যদি রাজি থাকে তাহলে এখানেই বিয়ে দিয়ে দাও। শুধু একটাই শর্ত যে আমরা ওকে দু গাছা চুড়ি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারব না।‘
পরান চিন্তা করে মনে মনে বৌয়ের বুদ্ধির খুব প্রশংসা করে মেনে নিলো মেয়ের পছন্দ। নিমাইয়ের বাবা মধুসূদন ঘোষের বাড়িতে গিয়ে তার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলো। মধুসূদন ঘোষ নিরিহ মানুষ, গ্রামের পোস্ট অফিসে সাধারন চাকরি করে। একবার বৌকে নিয়ে নবদ্বীপে বেড়াতে গিয়ে শান্তিপুর রেল স্টেশনে পেয়েছিল এই ছেলেটাকে। নিমাইয়ের বয়স তখন মাত্র আট। ষ্টেশনের একটা বেঞ্চে বসে একা একা কান্না কাটি করছিল নিমাই। ওর সুন্দর নাদুস নুদুস চেহারা দেখে নিঃসন্তান মধুসূদন ঘোষ ও তার স্ত্রীর খুব দয়া হয়। ও ওর বাবা মাকে মেলায় হারিয়ে ফেলেছে শুনে ছেলেটাকে ওরা জলঙ্গিতে নিয়ে এসে ওকে লালন পালন করে বড় করে তোলে, ওর নাম দেয় নিমাই।
নিমাইয়ের কথায় একটা জড়তা আছে। উনিশ বছর বয়সে ও হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করবার পর মধুসূদন নিমাইকে একটা টোটো কিনে দেয় যাতে কথার জড়তা নিয়ে ও চাকরির পিছনে না দৌড়ে নিজেই দু পয়সা রোজগার করতে পারে। এখন নিমাইয়ের বয়স কুড়ি । পরান মণ্ডলের মেয়ে এবং নিমাই দুজন দুজনকে ভালবাসে শুনে মধুসূদন ঘোষ তার ছেলের সাথে পরানের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল সামনের শীতে ভাল তারিখ দেখে উনি ছেলের বন্ধু বান্ধবদের বরযাত্রী নিয়ে পরানের বাড়িতে যাবেন ওর মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দিতে।
এর কয়েকদিন পরেই পরান মণ্ডল রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে জানতে পারল যে ছেলে ও মেয়ে দুজনের আধার কার্ড দরকার রেজিস্ট্রি করবার জন্য। বাড়ি ফেরার সময় পরান মধুসূদন ঘোষকে পোস্ট অফিসে গিয়ে জানাল কথাটা। পরদিন যেহেতু লোকটার অফিস আছে পরান হবু বেয়াইকে বলল ও নিজেই নিমাইকে আধার কার্ড করাতে সদরে নিয়ে যাবে বেলা সাড়ে দশটার সময়। সেইমত পরদিন হবু জামাইকে সাথে নিয়ে পরান মণ্ডল হাজির হয় আধার কার্ড করবার অফিসে।
আধার কার্ডের ফর্মে নিমাই ঘোষ, বাবা মধুসূদন ঘোষ এবং ঠিকানা লিখে জমা করবার পর যখন একজন স্টাফ নিমাইকে ওর বায়োমেট্রিক ডাটা আপ লোড করবার জন্য ওর হাতের আঙ্গুল আর চোখের ছবি তুলতে যায় তখন দেখা যায় এই ছালেটির ইতিমধ্যে একটা আধার কার্ড আছে। আধারের সাইটে ওর বায়োমেট্রিক ডাটা দেখাচ্ছে যে নিমাইয়ে নাম আসলে নঈম আহমেদ, বাড়ি বহরমপুর জেলার গজধরপুর এলাকায়। ওর বাবার নাম রহীম আহমেদ। একই লোকের দুবার আধার কার্ড করা যাবে না।
মাথায় বাজ ভেঙে পড়লেও বোধহয় এতোটা চমকে যেতনা পরান মণ্ডল। নিমাইকে আপাদ মস্তক দেখে নিয়ে ওকে নিয়ে ফিরে আসে মধুসূদন ঘোষের কাছে পোস্ট অফিসে। নিমাইয়ের চোখ মুখ দেখে আর সাথে পরান মণ্ডল আবার এসেছে দেখেই মধুসূদন ঘোষ বুঝতে পারে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই। হাতের কাজ ফেলে পোস্ট অফিস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে মধুসূদন ঘোষ। জিজ্ঞাসা করে, ‘কী হয়েছে ? আধার কার্ড হয়নি তোর ? কী হয়েছে পরান বাবু ? আপনাকে এতো উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন ? ওরা কি আধার কার্ড করবার জন্য টাকা পয়সা চাইছে নাকি ? আপনি বলুন তাহলে আমি এম এল এ সাহেবের কাছে নিয়ে যাব নিমাইকে। দেখি কে আটকায় ?’
পরান মণ্ডল গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে,’ আরে মশাই টাকা পয়সা চায়নি কেউ। আপনার ছেলে এই নিমাই তো একজন মুসলমান, আধার পোর্টাল তো তাই দেখাচ্ছে। ওর আসল নাম নঈম আহমেদ, বাড়ি বহরমপুরে গজধরপুর এলাকায়। এই তো আমি ওর বাবার নাম ঠিকানা সব লিখে এনেছি। এই যে নিন, এবার বলুন কী করবেন ? আমি এখুনি বাড়িতে গিয়ে সব জানাচ্ছি নন্দার মাকে। দেখি ও কী বলে।‘ বলেই জামার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে নিমাইয়ের বর্তমান বাবা মধুসূদন ঘোষের হাতে সেটা গুঁজে দিয়ে হনহন করে চলে গেল পরান মণ্ডল। মধুসূদন মণ্ডল আর নিমাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
নিমাই যে একটা মুসলমান ছেলে আর ওর বাবা মায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে, শুনেই ভেঙে পড়ল মধুসূদন ঘোষ ও তার স্ত্রী। নিমাই কিন্তু ওর বাড়ির কথা কিছুই মনে করতে পারছিল না। এমনকি সেদিন স্টেশনে ওকে জিজ্ঞাসা করাতে নিমাই মধুসূদন বাবুকেও ঠিকানা কিছুই বলতে পারে নি। শুধু জড়ানো ভাষায় বলেছিল ওর নাম নঈম। মধুসূদন বাবু সেটাই নিমাই ভেবে ওঁকে এতদিন যাবত নিমাই বলেই ডাকেন । সেই থেকে এই ঘোষ পরিবারই নিমাইয়ের পরিবার। স্ত্রী ভীষণ ভেঙে পড়েছে আর কাণ্ণাকাটি করছে দেখেও পরদিন সকালে নিমাইকে সাথে নিয়ে গজধরপুরের ঠিকানায় ওর নিজের বাবা মায়ের কাছে নিয়ে গেল মধুসূদন ঘোষ।
বেলা বারোটা নাগাদ ওরা পৌছে যায় রহীম মিয়াঁর বাড়ি। রহীম আহমেদ পেশায় একজন টেলর, নাম শুনেই ওর বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল কয়েকজন। পুরানো ভাঙ্গাচোড়া একটা পাকা দালান। সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আওয়াজ দিতেই রহীম আহমেদ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অচেনা একটা লোকের সাথে একটা যুবককে দেখে জিজ্ঞাসা করল,’ কাকে চাই আপনাদের ?’
নিমাই যখন ওর আসল বাড়ির চারিদিকে তাকিয়ে দেখে ওর ছোটবেলার কথা মনে করবার চেষ্টা করছে তখন মধুসূদন ঘোষ রহীমের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ আস্লাম আইলিকুম রহীম ভাই। আমি জলঙ্গি থেকে আসছি। নাম মধুসূদন ঘোষ। আপনি আমাকে চিনবেন না। শুধু বলুন আপনার কোন ছেলে কি হারিয়ে গেছিল শান্তিপুরের কোন মেলায়, মনে পড়ছে কিছু ?’
পঞ্চাশোর্ধ রহীম আহমেদ চমকে উঠে এবার ভালো করে তাকাল নিমাইয়ের দিকে। ওর দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তাই ভাবছিলাম। এই তো আমার নঈম। আমরা একটা নিকাহর দাওয়াতে শান্তিপুরে গিয়ে ওখান থেকে ফেরবার সময় রাস্তায় একটা মেলাতে আমার এই বড় ছেলে নঈমকে হারিয়ে অনেক খোঁজা খুজি করে ওকে না পেয়ে ফিরে আসি। আরে ও নঈকা আম্মি, বাহার আকে দেখো কউন আয়া।’ বলে ভিতর দিকে মুখে করে একটা হাক ছাড়লেন রহীম আহমেদ। এগিয়ে এসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে আবার বললেন, ‘কিত্না বড়া হো গায়া হ্যাঁয়রে তু বেটা?’ আবেগে ওর চোখের কোনে জল দেখা গেল।
মধুসূদন ঘোষের কাছে এরপর সমস্ত ঘটনা শুনে, রহীম আর তার স্ত্রী নঈমকে এরা বড় করেছে, ছেলে এখন রোজগার করছে আর একটা হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চলেছে শুনে খুব খুশী হলেন। নিমাই ওর মায়ের গা ঘেসে বসে শুনছিল সব কথা। ওর নাকি আরেকটা ছোট ভাই আর একটা বোন আছে। ভাই এখন আব্বুর সাথে দোকান সামলাচ্ছে আর বোন হাই স্কুলে পড়ছে। রহীম ছেলের মাথায় আশীর্বাদ করে ওকে আবার জলঙ্গিতে ফিরে গিয়ে ওর পালিত বাবা মায়ের কাছে তাদেরই ছেলে হয়ে বৌ বাচ্চা নিয়ে সংসার করবার পরামর্শ দিলেন। বললেন এটাই হয়ত আল্লাহর মর্জি।
মধুসূদন রহীমের এই উদারতায় ওর হাত চেপে ধরে বলল,‘ আমার স্ত্রী সত্যি আপনার এই বদান্যতায় খুব খুশী হবে। আসবার সময় নিমাইকে ধরে খুব কাঁদছিল বেচারি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’ কথাটা বলে মধুসূদন ঘোষ মনে মনে ভাবছিল এ যেন সত্যিই শ্রী কৃষ্ণের কাহিনী। জন্ম এক মায়ের গর্ভে আর বড় হয়েছে আরেক মায়ের কাছে।
সন্ধ্যায় বাসে চড়ে খুশী মনে নিমাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরল মধুসূদন ঘোষ। ভাবতে থাকে এবার পরান মণ্ডলকে বাগে এনে ওদের বিয়েটা যেভাবেই হোক দিতে হবে। ওর একজন মুসলমান বাবা মার সংসারে জন্মের জন্য নিমাই তো আর দায়ী নয়। এখন ও এই ঘোষ পরিবারের সদস্য। ঐ মেয়ের সাথেই ওকে বিয়ে দেব যাতে ওরা দুজন সুখী হয়।
Uttam Chakraborty.
Bangalore.
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন