Featured Post
প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা
শ্রীজিৎ জানা
"সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়"। স্রোতের ধারা তার দু'প্রান্তে রেখে যায় ভাঙাগড়ার চিহ্ন। কালের দৃশ্যপটেও পরিবর্তনের ছবি অনিবার্যভাবেই চোখে পড়ে। সমাজ সময়ের ছাঁচে নিজেকে গড়ে নেয় প্রতিনিয়ত। সেখানে মনে নেওয়ায় বাধা থাকলেও,মেনে নেওয়ার গাজোয়ারি চলে না। ফলত কাল বদলের গাণিতিক হিসেবে জীবন ও জীবিকার যে রদবদল,তাকেই বোধকরি সংগ্রাম বলা যায়। জীবন সংগ্রাম অথবা টিকে থাকার সংগ্রাম।
মানুষের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আজকে যা অত্যাবশ্যকীয় কাল তার বিকল্প রূপ পেতে পারে অথবা তা অনাবশ্যক হওয়াও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে উক্ত বিষয়টির পরিষেবা দানকারী মানুষদের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এক কালে গাঁয়ে কত ধরনের পেশার মানুষদের চোখে পোড়তো। কোন পেশা ছিল সম্বৎসরের,আবার কোন পেশা এককালীন। সব পেশার লোকেরাই কত নিষ্ঠা ভরে গাঁয়ে তাদের পরিষেবা দিত। বিনিময়ে সামান্য আয় হত তাদের। আর সেই আয়টুকুই ছিল তাদের সংসার নির্বাহের একমাত্র উপায়। কালে কালান্তরে সেই সব পেশা,সেই সব সমাজবন্ধুরা হারিয়ে গ্যাছে। শুধুমাত্র তারা বেঁচে আছে অগ্রজের গল্পকথায়,আর বিভিন্ন সাহিত্যের পাতায়।
পাড়াগাঁয়ে তখন থাকতো একজন ধাইমা বা দাইমা। রবি ঠাকুর তাদের নিয়ে লিখলেন- "বুড়ি দাই জাগে নাই"! যার কোনরকম প্রথাগত চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষা থাকতো না। অথচ দিনেরাতে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবকালে ধাইমা যেন রক্ষাকর্ত্রী। ঘরের পাশে,কখনো গোয়ালঘরে সামান্য গরমজল,ছেঁড়া কাপড়,সুতো,ছুরি বা কঞ্চির ছিলা,বা ধারালো ঝিনুক খোলা দিয়ে শিশু প্রসব করিয়েছে। আজকের দিনে তা ভয়ের এবং আশ্চর্যেরও!
ধাইমার পাশাপাশি আরেকজন থাকতো দুধ-মা। যদি কখনো জন্মদাত্রী মায়ের স্তন্যপানে ব্যঘাত হোতো, অথবা বুকে স্তনদুগ্ধ থাকতো না অথবা গর্ভকালে মা মারা যেত তখন দুধ-মা স্তন্য পান করাতো। দুধ-মা'য়েদের প্রথা অনেক দেশেই প্রচলিত ছিল।
দইয়ালাদের দেখা যাবে না গাঁয়ের পথে। রবি ঠাকুরের পাঁচমুড়ো পাহাড়ের তলায়, শ্যামলী নদীর ধারে যে গ্রাম,সেই গ্রামের দইয়ালারা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। টক দই,চিনিপাতা দইয়ের ভাঁড় বাঁকে সাজিয়ে 'দই নেবে ভালো দই, চিনিপাতা দই' বলে আজ আর হাঁক দিয়ে ফেরে না দইয়ালা। আজকের অমলেরা দইওয়ালাদের চিনবে না। তার সাথে দু'দন্ড কথা বলার ফুরসতও নেই গাঁয়ের অমল ও সুধাদের।
কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করতো বাসনয়ালা। " বাসনওয়ালা থালা বাজায় সুর করে ওই হাঁক দিয়ে যায়"।পিতল- কাঁসার বাসন ঝাঁকায় সাজিয়ে বেচে ফিরতো গাঁয়ে। এখন গঞ্জ এলাকায় স্থায়ী পিতল-কাঁসার দোকান হয়েছে। বাসনয়ালারা গ্যাছে হারিয়ে।
তখনো গাঁয়ে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠেনি। লন্ঠন,লম্ফ,চিমনি,হ্যারিকেনের আলোয় মাটির ঘর আলোকিত হোতো। মুছে যেত অন্ধকার। পাড়ায় পাড়ায় ভাঙা লন্ঠন,চিমনি,হ্যারিকেন সারাই করে বেড়াতেন একজন সারাইকার। কয়লার আগুন জ্বালাত হাতে করে একধরনের চাকা ঘুরানো আঁচের উনুনে।তাকে করে রাংঝাল দিত। গাঁ থেকে লন্ঠন, হ্যারিকেনের পাট চুকেবুকে গ্যাছে। আর তাদেরও দেখা মেলে না।
আজকাল তো গুঁড়ো মসলা ও পেস্টের যুগ। সৌভাগ্যক্রমে গাঁয়ের কোনো রান্নাঘরে চোখে পড়বে শিল- নোড়ার। আগে তো হামেশাই ঘরে শিলে সব ধরনের মশলা পেশাই হোতো। ছড়া কাটতো ছোটোরা- "শিলের উপর নোড়া রেখে/ উবু হোয়ে বসি/ সারাদিন ঘষর ঘষর/ লঙ্কা ধোনে পিষি"। সেই শিল- নোড়া কাটাই বা খোদাই কোরতো একধরনের কাটাইদার। গাঁ থেকে তারাও গ্যাছে হারিয়ে।
গাঁগঞ্জে একধরণের যে পেশার চল তা হল ভারি ও মুটে।সাধারনত নাপিত সম্প্রদায়ের লোকজন এই পেশার সাথে যুক্ত থাকতো। কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে লৌকিকতা রক্ষার্থে আর্থিক স্বচ্ছলতা অনুসারে ভারি বা মুটে করে জিনিসপত্র পাঠানো হোতো।
এক কালে গাঁয়ে অন্যায় করলে শাস্তি স্বরূপ অন্যায়কারীর ধোপা নাপিত বন্ধ করে দেওয়া হোতো। নাপিত সম্প্রদায়ের আজও গাঁয়ে পেশাগত কদর থাকলেও ধোপাদের জাতিগত বৃত্তি পুরোপুরি বন্ধ হোয়ে গ্যাছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা, স্বাস্থ্যগত এবং জাত্যাভিমানের প্রশ্নে অন্যের নোংরা, ময়লা জামাকাপড় কাচা থেকে তারা আজকাল নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।
সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলাদের একসময় পায়ে আলতা পরাতে আসতো নাপিতানি বা নাপতে- বৌ। তার বিনিময়ে চাল- আনাজ,মুড়ি-খই, কখনো সামান্য পয়সাকড়ি পেত। আজকাল এর চলন এক্কেবারে নেই।
রাখাল ও বাগাল নামক একধরণের পেশার একসময় গাঁ-গাঁওলিতে চলন ছিল। পল্লীকবির কবিতায় তার ঝলক চোখে পড়েছে সবার-- "রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও/ বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও"! রাখালের কাজই ছিল দিনমান গরু চরানো। বাগালকে বড় বাড়ির সারাবছর ফাইফরমাশ খাটতে হোতো। বাগালকে কোথাও কোথাও 'আটমেনে' ও বলা হয়ে থাকে। রাখাল- বাগাল প্রথা আর নেই।
ঘরামি হল সে-ই ব্যাক্তি যে মাটির বাড়ি তৈরি করে। গাঁয়ে মাটির বাড়ির সংখ্যা কমতে থাকায় ঘরামি পেশাও গেছে লোপ পেয়ে। একইভাবে ছইয়াল বা বাড়ই,যে মাটির ঘরে খড়ের ছাউনি চাপাতো, সেই পেশাও ইদানীংকালে লুপ্ত।
সরু লগির মাথায় আঁকশি লাগানো আর তার সাথে ঝোলানো থাকে একটা কঞ্চির বোতলাকৃতি ঝুড়ি।সেইটাকে কাঁধে নিয়ে গাঁগাঁওলিতে ঘুরে বেড়াতো পুকুরে,ডোবায় গয়না,তৈজসপত্র খুঁজে দেওয়ার একজন লোক। অনিয়মিত চোখে পোড়তো তাদের। ধীরে ধীরে তারাও হারিয়ে গ্যাছে।
ঘটক ও ঘটকালি পেশা গাঁয়ে- শহরে সর্বত্র সমান জনপ্রিয়। সাহিত্যে,সিনেমায় ঘটক চরিত্র মাত করে দিয়েছে তাদের হাস্যময় গুণপনায়। অধুনা বিভিন্ন ম্যাট্রিমনি সাইট ও লভ ম্যারেজের দৌলাতে ক্রমেই জৌলুস এবং কদর কমছে ঘটকের ঘটকালি পেশায়।
গাঁয়ে পাড়া ভিত্তিক একজন আচার্য্য বা আচায্যি ঠাকুর থাকতো। নববর্ষে বাড়িতে পঞ্জিকার ফলাফল পাঠ করে শোনানো, গৃহস্থের বিভিন্ন মাঙ্গলিক কর্মের প্রয়োজনীয় দ্রব্য যোগান দেওয়া ইত্যাদি কাজ ছিল তার। যার বিনিময়ে যজমানের কাছ থেকে বাৎসরিক অর্থ ও সামগ্রী নিত। এই বৃত্তিটিও ক্রম বিলুপ্ত বলা যায়।
কোন কোন গাঁয়ে বহুরূপী ও হরবোলাদের দেখা মিলত। আজ তাদের দেখা পাওয়া ভার। দু'এক স্থানে গাজন মেলায় কয়েকজনকে সঙ সাজতে দেখা যায়।
ওঝা,গণৎকার বা গুণিন আজকের বিজ্ঞান চেতনার যুগে ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হোয়ে পড়েছে। মাধুকরীবৃত্তি আজকাল কেউ না করলেও ভিক্ষাবৃত্তির মানুষজন যথেষ্টসংখ্যক সর্বত্রই দেখা যায়।
মালী নেই তবে মালাকার একটি পেশা। এখনো গাঁয়ে অঘ্রানের ক্ষেত্রলক্ষ্মী পুজোতে বাড়ি বাড়ি ফুলমালা প্রতি বৃহস্পতিবার পৌঁছে দ্যায়। বিনিময়ে যজমান বাড়ি থেকে অর্থ ও সামগ্রী গ্রহণ করে। তবে এই পেশাটি এককালীন এবং ক্রম অবলুপ্তির পথে।
তাঁতি সম্প্রদায়ের বাস গাঁয়ে থাকলেও, তাঁতঘর, তাঁতখানা সব হারিয়ে গ্যাছে। গাঁয়ে তাঁত বোনা আর হয় না। ভাঙা মাকু ইতিউতি সৌভাগ্যক্রমে চোখে পড়তে পারে হয়তো।
পালকি আর তেমন ভাবে চলে না 'গগনতলে'। ছয় বেহারার দল ধুঁকছে আর্থিক সমস্যায়। পেটের দায়ে খুঁজে নিয়েছে রোজগারের ভিন্ন পথ। গাঁয়ের বিয়েতে আর বেহারারা পালকি ভাড়ার বরাত পায় না। সময়ের সাথে সুদৃশ্য যানে চড়ে নব বরবধূরা গমনাগমন করে। বেহারা পেশাটি লুপ্তপ্রায় বল্লে অত্যুক্তি হবে না।
গাঁয়ে গোয়ালাদের আজ সংখ্যা কমে গ্যাছে। সেক্ষেত্রে এই পেশা পুরোপুরি লুপ্ত বলা যাবে না। বিভিন্ন দুগ্ধ সমিতি এবং মিল্ক কোম্পানি দুধ সংগ্রহ করার সেন্টার খোলায় বাঁকে হাঁড়ি ঝুলিয়ে গোয়ালাদের বাড়ি বাড়ি দুধ দোহন করতে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও দ্বিচক্র যানে চড়ে বের হয় দুধ সংগ্রহে।তবে 'সহজ পাঠ' এর "বিধু গয়লানী মায়ে পোয়"দের এখন এক্কেবারেই দেখা মেলে না।
পট খেলানো দেখিয়ে অল্প রোজগারপাতি কোরতো পটুয়ারা। গাঁয়ে আজ পট ও পটের গানের কোন কদর নেই।
কোনরকম কদর নেই বলেই পাড়ায় দেখা যায় না সাপুড়েদের,হাপু খেলা দেখানো ছেলেদের,ভানুমতির খেল্ দেখানো যাযাবর মহিলাদের। গরুরগাড়ি নেই তো গাড়োয়ান নেই,ঘোড়ার গাড়ি নেই তো কোচোয়ান নেই।গাঁয়ের চৌকিদার,জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল বা লেঠেল নেই,নামকরা কবিরাজ নেই যাকে একসময় গাঁয়ে ধন্বন্তরি বলা হোতো। সময়ের সাথে,আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে অনেক পেশা-ই লুপ্ত হোয়ে গ্যাছে। অনেক পেশা ক্রমবিলুপ্তির পথে। আবার বেশকিছু পেশা পরিবর্তিত রূপে টিকে আছে সামাজ- সভ্যতায়। সমাজের অগ্রগমনে,মানুষের জীবনযাত্রায় ওইসব পেশার সমাজবন্ধুের অবদান কম নয়। সমাজিক পরিকাঠামোকে দৃঢ়তা প্রদানে তাদের কর্মী মানসিকতা,তাদের নিষ্ঠাভরা পরিষেবা সম্মানের দাবী রাখে। বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে সমাজের যেরকম আত্মিক যোগ রচিত হয় তা আসলে সমাজিক বন্ধনকেই শক্তিশালী করে। শুধুমাত্র পেশাগত সম্পর্ক নয়,আর্থিক বিনিময় নয়,তার বাইরেও মুড়ি ভাজুনে মাসি,আলতা পরানো নাপতে বৌ,ঘটকমশাই প্রভৃতি সম্বোধনে গাঁয়ের মেঠো সম্পর্ককে আলোকিত করেছে। পেশা ও পেশাধারী লোকজন অনেকক্ষেত্রই গাঁগঞ্জে বাড়ির আপজন রূপেই সমাদর পেত। এমন আপনতা শুধু গ্রাম্যজীবনের মাধুর্যকেই প্রকাশিত করে।
-----------------
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন