উৎসবের সৌন্দর্য:
সেকালে ও একালে
সৌরভ পুরকাইত
বাংলার উৎসব বাংলার প্রাণ। প্রতিদিনের জীবনযাপনের মধ্যে যখন মন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তাকে বেঁচে থাকার রসদ যোগায় এই উৎসব। কথায় বলে 'বারো মাসে তেরো পার্বণ'।মন আনন্দই চায়।তাই তাকে সজীবতা দিতে,পরিবারের,সমাজের ভালো-মন্দের কথা মাথায় রেখে মানুষ নিজেই সৃষ্টি করে নিয়েছে নানাবিধ উৎসবগুলিকে। একেবারে প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ কখনোই উৎসব বিমুখ ছিল না।উৎসবই তাকে ঘর থেকে বাইরে টেনে এনেছে,চিনতে শিখিয়েছে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার আনন্দকে।
উৎসব আসলে প্রাণের সাথে প্রাণের যোগ, হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের যোগ।রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'সত্য যেখানেই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব'।হৃদয়ের সেই সুকোমল বৃত্তির জাগরণ যেন ফুটে ওঠা ফুলেরই মতো সত্য ও সুন্দর।এই জাগরণই উৎসব। তাই নানা কিছুর মধ্য দিয়ে,নানা উপলক্ষ্যে এই উৎসব প্রকাশ পায়।
প্রাচীনকালে মানুষের হাতে না ছিল পসার, না ছিল পসরা।ছিল মনের আন্তরিকতা,মানুষকে কাছে টেনে নেবার ক্ষমতা।সেটাই ছিল উৎসবের সৌন্দর্য। তাই সেদিনের উৎসবে ক্ষুদ্র,তুচ্ছ উপকরণও প্রাণের উচ্ছ্বাসে মহৎ হয়ে উঠত।সেকালের উৎসবে লোক দেখানো ব্যাপার কিছু ছিল না; ছিল না কোন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আলপনা,মঙ্গলঘট,আর শঙ্খের আবাহনে স্বর্গ সেখানে নেমে আসতো।না থাক জৌলুস, না থাক আতিশয্য, ঘরের মেয়ে উমা, লক্ষ্মী সেখানে নিজের আসন ঠিকই চিনে নিতে পারত।
আন্তরিকতা এযুগে নেই একথা বলতে পারি না। কিন্তু এই আন্তরিকতার শিকড়ে শিকড়ে বাসা বাঁধছে আতিশয্যের ভাইরাস। শিকড়ের কাজ গাছকে ধরে রাখা। শিকড়টা তাই দেখানোর জিনিস নয়। আনন্দ ব্যাপারটাও অনেকটা এই রকম।মুশকিল এই, যখন এই আনন্দ রূপ শিকড়গুলি মাটির ভিতরে না থেকে নিজেকে প্রচারের জন্য বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায়। তখন সেই গাছের দাঁড়িয়ে থাকাই হয় মুশকিল।উৎসবে আনন্দের একটা প্রকাশ থাকবে কিন্তু তা যদি আতিশয্য রূপ লোক দেখানো বিষয়ে পর্যবসিত হয়, পরচিত্ত হরণে আগ্রাসী হয় তবে সেখান থেকে সত্য মুছে যেতে থাকে।ফুল সুন্দর হয়ে ফোটে নিজের খেয়ালে, কিন্তু নিজের সৌন্দর্য প্রমাণের জন্য কারো কাছে সাধতে যায় না।
উৎসবের এক অংশে থাকে ধর্ম, আরেক অংশে লৌকিক আচার। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন লোকাচার থাকে।সেই লোকাচারই তাদের প্রাণ,তাদের নিজস্বতা। এখানেই উৎসবের সৌন্দর্যকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই নিজস্বতার মধ্যে 'বিদেশি কালচার' ক্রমশ মিশে যেতে থাকলে উৎসবের অবয়বে কৃত্রিমতা বাড়তে থাকে। যে ঈশ্বরের সামনে মাথা নত করে প্রার্থনা করছি,উৎসব শেষে, সেই মূর্তির সামনেই নাচানাচি করাটা বড় হাস্যকর লাগে। এই 'কালচার' আমাদের 'মর্ডান' বানাবার নামে আমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে।
আধুনিক 'ডিজে' নামের শব্দদৈত্যটি ছোঁয়াচে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের অলিতে গলিতে।এর একমাত্র ভ্যাকসিন যে চেতনা তা না আসলে উৎসব তার গরিমাকে নিশ্চিতরূপে হারাবে। যেমন করে দূষণের কবলে পড়ে বহু প্রাণি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তেমন করেই বাংলার উৎসবের লোকাচারগুলিও ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটছে। সরস্বতী পুজোর জন্য জোড়া কুল খুঁজতে আজ কজন ছেলে উৎসাহী হয়,দোয়াত কলম কথাটা তো হারিয়ে যেতেই বসেছে। বিজয়া দশমীতে কলাপাতায় খাগের কলমে লিখতে হোত 'শ্রীশ্রী দুর্গামাতা সহায়'। এসব ক্রমশ অতীত হতে বসেছে।
উচ্চ মাত্রায় বাজি, পটকা ফাটানো আজকাল উৎসবের ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। এ আকস্মিক চমক সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নয়।অনেক অবোলা জীব, মানুষের মধ্যে শিশু,বৃদ্ধদের কাছে এই শব্দ ত্রাসের সঞ্চার করে। উৎসব যদি আনন্দদায়ী হয়, এ তবে কেমনতর আনন্দ উদযাপনের মাধ্যম?
উৎসব তো মিলনের কথা বলে। সেই হিসাবে সমাজে যারা পিছিয়ে পড়া এমন ব্রাত্যজনকেও আমরা যদি উৎসবে সামিল করতে পারি, দিতে পারি ন্যূনতম আনন্দ, তবে সেই উৎসব বাজির আলোর চেয়েও বেশি রোশনাই হয়ে ওঠে। অসমর্থ, পীড়িতের কাছে উৎসবের কোন মূল্য নেই কিন্তু ভালোবাসার হাতটুকু বাড়িয়ে দিলে 'রথের রশি' টানবার জন্য আর দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না আমাদেরকে।
বর্তমানে ভিডিওগেমের যুগে উৎসব একান্ত অপরিহার্য।একাকীত্বের যণ্ত্রণা কাটাতে, নিঃসঙ্গ অবসর জীবনে তেরো পার্বণের তাই প্রাসঙ্গিকতা আছে।কর্মমুখর এই সংসারযাত্রায় উৎসবই দিতে পারে উদ্যম, উৎসাহ ও সুস্থ রুচিবোধ।
পরিশেষে বলি, উৎসব ছিল, আছে,এবং থাকবে। কালে কালে উৎসবের বিবর্তন ও পরিবর্ধন হবে।তবে উৎসবের সৌন্দর্যকে, তার পবিত্রতাকে ধরে রাখার চাবিকাঠি আমাদেরই হাতে, একথাটা ভুলে গেলে চলবে না।
______
আঙ্গারু,ধনিয়াখালি,হুগলি
৯৫৬৪৮৭৩৪১৮
Sent from my Samsung Galaxy smartphone.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন