Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

ব্যক্তিগত গদ্য ।। সেদিনের মাস্টারমশাইরা ।। দিশারী মুখোপাধ্যায়

 


ব্য ক্তি গ ত  গ দ্য 

সেদিনের মাস্টারমশাইরা

দিশারী মুখোপাধ্যায়

 

লেখার বিষয় মাষ্টারমশাই। বিষয়টি কেবল মাস্টার হলে লেখার দিক বেড়ে যেত বহুগুণে, যা এই ছোটো পরিসরে সম্পূর্ণ ধরা যেত না। ইংরেজিতে master শব্দটির অর্থ, ব্যবহার ও ব্যাপকতা অনেক বেশি। সেই master-এর সঙ্গে মশাই জুরে দিয়ে যে বাংলা শব্দটি তৈরি হয়েছে তাতে সেই ব্যাপকতা খানিকটা কমেছে। তাই লেখার বিষয় মাস্টারমশাই হওয়ায় সে দায় থেকে বাঁচা গেল। লেখাটি আবার স্মৃতিচারণা মূলক। এতে লেখাটিকে নিয়ে বিস্তৃত বলার দায় থেকে আরও খানিকটা বেঁচে গেলাম। অর্থাৎ বর্তমান সময়ের মাস্টারমশাইদের নিয়ে কিছু বলতে হবে না। মাস্টারমশাই বলতে সকলেই স্কুলের শিক্ষকদের কথাই ভাববেন। কিন্তু আমার জীবনের মাস্টারমশাই বহুপ্রকারের। এখানে কেবল তিন ধরণের মাস্টারমশাইকে নিয়ে বলব।

 

আমাদের সময়ে গ্রামজীবনে মাস্টারমশাই বলতে তিনজনকে বুঝতাম। স্কুলের মাস্টারমশাই, পোস্ট মাস্টারমশাই আর স্টেশন মাস্টারমশাই। সংখ্যার বিচারে স্কুলের মাস্টারমশাইরা বেশি । তারপর পোস্টমাস্টার এবং তারপর স্টেশনমাস্টার। কারণ প্রায় প্রতি গ্রামেই অন্তত একটি করে বেসিক বা প্রাইমারি স্কুল থাকতই। তুলনায় হাইস্কুলের সংখ্যা অবশ্যই কম ছিল। গ্রামের ছোটো পোস্টঅফিস, যাকে বলে ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিস, তার সংখ্যা আট দশটি গ্রাম মিলিয়ে একটি হতো। আর রেলস্টেশনের সংখ্যা আজও পাশাপাশি বিশ তিরিশটা বা স্থানভেদে আরও অনেক বেশি গ্রাম নিয়ে একটি। সাধারণ মানুষের কাছে নৈকট্যের বিচারে পোস্টমাস্টার কিন্তু ছিলেন প্রথম (অন্তত গ্রামজীবনে বা নিরক্ষর সমাজে), এরপর স্কুলমাস্টার এবং এরও পর স্টেশনমাস্টার। ছাত্রছাত্রীদের কাছে, সম্পর্কটা খুব স্বাভাবিক এবং মধুর না হলেও, পরিচয়ের দিক থেকে স্কুলের মাস্টারমশাইরাই ছিলেন অধিক পরিচিত। কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী পোস্টমাস্টারকে দূর থেকে বা প্রতিবেশী হিসাবে দেখে থাকলেও, পোস্টমাস্টার হিসাবে লোকটা কে? কী তার কাজ? জানত না। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এই লোকটার ভালো মন্দ কোনো সম্পর্কই ছিল না। আর স্টেশনমাস্টারকে শুধু ছাত্রছাত্রীরা কেন, প্রাপ্তবয়স্করাও চিনত না, জানত না। কাউন্টারের বাইরে থেকে ন'মাসে ছ'মাসে যাত্রী হিসাবে টিকিট সংগ্রহ করাটুকু ছাড়া তার সঙ্গে পরিচিত হবার তেমন কোনো অবকাশ থাকত না। 

সৌভাগ্য বশতঃ আমাদের গ্রামে বেসিক স্কুল /প্রাইমারি স্কুল ছিল দুটি। প্রি-বেসিক স্কুলও ছিল একটি (এ যুগের নার্সারি বা কিন্ডারগার্টেন?)। হাইস্কুলও ছিল একটি। পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামের মধ্যে আমাদের গ্রামেই পোস্টঅফিসও ছিল। রেলস্টেশন অবশ্য গ্রামে ছিল না, কয়েকটি গ্রাম অতিক্রম করে, চার ক্রোশের উপর রাস্তা পার হয়ে তবে। কাজেই গ্রামে সবমিলিয়ে চারটি স্কুলের ছোটো বড় অন্তত বিশ বাইশ জন শিক্ষক শিক্ষিকা ছিলেন। আর পোস্টমাস্টার ছিলেন একজন। প্রি-বেসিকে আমরা পড়িনি। বেসিক স্কুলের শিক্ষকদের আমরা মাস্টারমশাই বলতাম আর শিক্ষিকাদের বলতাম দিদিমণি। হাইস্কুলের মাস্টারমশাইদের কিন্তু মাস্টারমশাই বলতাম না, স্যার বলতাম। অর্থাৎ সমাজে সম্বোধনের ক্ষেত্রে কী ছাত্রছাত্রীদের কাছে, কী অভিভাবকদের কাছে, তাঁদের একটা আলাদা পরিচয় ছিল। বেসিক বা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে কাউকে কখনও স্যার বলতে শুনিনি। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা তো পুরো মাস্টারমশাই কথাটাও বলতেন না, মাস্টার বা মাস্টর বলেই চালিয়ে দিতেন। তা সে মাস্টারমশাই পরিচিত হোন বা অপরিচিত, গ্রামের ছেলে হোন বা ভিনগাঁয়ের। এমন কী এই দুই ধরনের স্কুলের দুই প্রধান শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এই সম্বোধনের ফারাক ছিল। বেসিক বা প্রাইমারির প্রধান শিক্ষক হলে হেডমাস্টার আর হাইস্কুলের হলে হেডস্যার। 

গ্রামে কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে বিশেষ পদ অলংকরণের জন্য দুজন মাস্টারমশাইকে ডাকা হত, হেডস্যার এবং পোস্টমাস্টারকে। কার কতটা শিক্ষাগত যোগ্যতা, কে কতটা বেতন পান সেটা কখনোই বিবেচ্য ছিল না। বা বলা যায় সে সময়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ধারণাগত যোগ্যতা ততটা না থাকায় তারা সেটা বুঝতেন না। বরং গ্রামের সাধারণ, অতিসাধারণ মানুষরা হেডস্যারকে ততটা চিনত না, যতটা চিনত পোস্টমাস্টারকে। পোস্টমাস্টার ছিলেন তাদেরই একজন কাছের মানুষ।

বেসিক বা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারমশাইদের মধ্যে অধিকাংশকেই দেখা যেত সেই গ্রামেরই বা পার্শ্ববর্তী গ্রামের অধিবাসী। আবার আক্ষরিক অর্থেই দুএকজন সমাজের তথাকথিত নিচ থেকেও উঠে আসা। বহু শিক্ষক ছিলেন একই সঙ্গে চাষী এবং শিক্ষক। তাঁদের যে পৈতৃকসূত্রে বহু জমিজমা ছিল বলে চাষী, তা নয়, রীতিমতো মাঠে নেমে কৃষিকাজ করা চাষী তাঁরা। সকালে মাঠে লাঙ্গল দিয়ে ঘরে ফিরে স্কুলে যাবার জন্য বার হতেন। সমাজের অন্যান্য অংশেও এমন দেখা গেছে। যেমন কুমোর বা কামার। তবে অবশ্যই অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ পরিবারের মানুষ।

হাইস্কুলের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু পৃথক ছিল। সেখানে স্থানীয় মানুষ শিক্ষক শিক্ষিকা হিসাবে ছিলেন তুলনায় কম। শিক্ষিকা প্রায় ছিলেনই না। গ্রামের বাইরে থেকে, দূরবর্তী শহর এলাকা থেকে তাঁরা আসতেন শিক্ষকতা করতে। অর্থাৎ তখনও গ্রামের মানুষের শিক্ষার হার যথেষ্ট কম ছিল। 

মাস্টারমশাইদের জীবন যাপন ছিল খুবই সাধারণ, একেবারেই গ্রামের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। সেটা খানিকটা ছিল তৎকালীন দিনের মানুষের রুচি, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং আদর্শবোধ থেকে,  আর খানিকটা ছিল অর্থনৈতিক কারণে। মাস্টারমশাইদের বেতন তেমন উল্লেখ্যযোগ্য ছিল না, সংসার নির্বাহের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এমনকি তাঁরা মাসে মাসে নির্দিষ্ট সময়ে বেতন পেতেন না। দীর্ঘ ছ'আট মাস একটানা বেতন পেতেন না। তখন প্রাইভেট পড়ানোরও রেওয়াজ ছিল না। মানুষের আর্থিক এবং মানসিক গঠন তেমন ছিল না যে স্কুলের পরেও ছেলেমেয়েকে বাড়িতে পড়ানোর জন্য খরচ করে কোনো শিক্ষককে রাখবেন। বাড়ির ছেলেদের সংসারের কাজ, চাষ আবাদের কাজ, পশুপালনের কাজ থেকে সরিয়ে স্কুলে পাঠানোর মানসিকতা বা সঙ্গতিই ছিল না অনেকের, অতিরিক্ত সময়ে পড়ানো তো দূরের কথা। আর মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে সামাজিক উদারতা তখনও ততটা প্রকট হয়নি। তবে হচ্ছিল ক্রমে ক্রমে। উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় অবশ্যই অংশ নিত। কিন্তু প্রান্তিক অংশের ঘরের ছেলেমেয়েরা, কোরা- বাগদী - সাঁওতাল- এরা তখনও উচ্চবর্ণের বাড়িতে কাজেরলোক হবার জন্যই জন্ম নিত। বিদ্যাসাগরের জন্মের প্রায় দেড়শো বছর অতিক্রান্ত যদিও ততদিনে।

বেতন পান আর না পান মাস্টারমশাইরা তাঁদের কাজে ছিলেন শতকরা একশোভাগ খাঁটি ও দায়বদ্ধ। কাজটাকে তাঁরা তখনও ব্রত হিসাবেই নিতেন, মামুলি চাকরি হিসাবে নয়। সমাজও তাই তাঁদের তেমন সম্ভ্রমের চোখেই দেখত। শিক্ষাক্ষেত্রে তখনও রাজনৈতিক ব্যক্তির কোনো রকম ছায়া পড়ত না, রাজনৈতিক দল বা নীতির প্রভাব তো নয়ই। তবে অবশ্যই সমাজের প্রভাবশালী দু’একজন মানুষের প্রভাব থাকতই। তাঁদের অবদানও থাকত ততটাই। 

আমি আমার শৈশবে বা বাল্যকালে প্রাথমিক স্কুলে প্রথম ভর্তি হই যখন, তখন ছাত্ররাছাত্রীরা ঘরের মেঝেতে বসত। শিক্ষকের জন্য একটা ডেস্ক থাকত। স্কুলের ঘর ছিল মাটির বাড়ি, টিনের ছাউনি। আমাদের প্রাথমিক স্কুল অবশ্য ছিল পাঁচইঞ্চি দেয়ালের একটা লম্বা ঘর, টিনের ছাউনি। তার মাঝে মাঝে কাঠের পার্টিশন দিয়ে পাঁচটি ক্লাসের ভাগ ছিল। 

মাস্টারমশাইরা বাচ্চাদের যথেষ্ট শাসন করতেন। প্রয়োজনে মারধর করতেন। কখনও কখনও তার মাত্রা হয়তো একটু বেশি হয়ে যেত। আমরা স্কুলে পড়া না করার জন্য বা দুষ্টুমি করার জন্য মার খেলে যতটা না মারের জন্য কষ্ট পেতাম তার চেয়েও বেশি ভয় পেতাম বাড়িতে পাছে সে কথা জেনে যায়। বাড়িতে জেনে গেলে, স্কুলে মার খেয়েছি বলে,  আর একচোট মার খেতাম বাবা বা মা বা পরিবারের অন্য অভিভাবকের কাছে । 

হাইস্কুলে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, তাঁর দৈহিক উচ্চতা সাড়ে চারফুট মতো ছিল, তাঁকেই আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম। আবার একই সঙ্গে ভালোবাসতাম ততটাই। যেদিন যে ছাত্রকে তিনি প্রহার করতেন, সে প্রহার ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের। বিকালে সেই ছাত্রকেই আবার নিজের ঘরে ডেকে গ্রামের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে আদর করে খাওয়াতেন। একদিন এক ছাত্রের সঙ্গে এমনই একটি ঘটনা ঘটার সময় তাঁকে চোখের জল ফেলতেও দেখা গিয়েছিল। ছাত্ররাও মাস্টারমশাইদের সম্মান দিতে জানত বা তাদের শেখানো হত। পার্শ্ববর্তী দূরের গ্রাম থেকে অনেক ছেলেমেয়ে যেমন হেঁটে আসত, সাইকেলেও আসত অনেকে। স্কুলে আসার পথে বা স্কুল থেকে যাওয়ার পথে বা অন্য কোনো কারণে কোথাও মাস্টারমশাই বা স্যারকে যদি পায়ে হেঁটে যেতে দেখা যেত তবে সেই সাইকেল আরোহী ছাত্ররা সাইকেল থেকে নেমে পায়ে হেঁটে তাঁদের অতিক্রম করে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার সাইকেলে চাপত। অর্থাৎ পথচারী শিক্ষকের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে না যাওয়ার সহবত ছিল। অথচ আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে যখন দুর্গাপুরে আসি দেখি উচ্চপদস্থ বাবার ছেলেমেয়েরা বাবার গাড়িতে করে মাস্টারমশাইকে দিব্যি অতিক্রম করে এগিয়ে যেত। সিনেমা হলে দেখেছি ছাত্র ও স্যার একসঙ্গে একই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছে। দেখেছি লাইনে দাঁড়ানো ছাত্রের সাহায্য নিয়ে স্যারকে টিকিট সংগ্রহ করতে ।ফলে হয়তো রগরগে কোনো বাণিজ্যিক সিনেমা ছাত্র ও শিক্ষক পাশাপাশি বসে দেখেছেন। ততদিনে স্কুলে কলেজে রাজনীতির প্রবেশ ঢুকে গেছে একেবারে ছোটো ছোটো গ্রাম শহরেও। বহিরাগতরা স্কুলে ঢুকে মাস্টারমশাইদের শাসন করছে। ক্রমে স্কুলের ছাত্ররাই মাস্টারমশাইদের হুমকি দিতে শুরু করে। শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের ভয় পেতে শুরু করেন। তবে এটা সেই পুরনো সময়ের হলেও আমাদের সময়ের শেষের দিকে। তখনও স্বাভাবিক অবস্থায় পচন অনুভব করা যেত না। তখনও একটা অনুশাসন যেন বজায় ছিল ,উপরে উপরে হলেও। 

এবার আসি আমাদের গ্রামের পোস্টমাস্টারের কথায়। আমাদের তখন বাল্যকাল। গ্রামের পোস্টমাস্টার  ছিলেন একাধারে পোস্টমাস্টার, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, নাট্যকর্মী (গ্রামের যাত্রাদলে), নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও হৃদয়বান মানুষ। গ্রামের নিরক্ষর মানুষের চিঠিপত্র লিখে দেওয়া, পড়ে দেওয়া, মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠানোয় সাহায্য করে দেওয়া, অফিসের যাবতীয় লেখালেখির কাজে সাহায্য করা - এসব করতেন শুধুমাত্র সহযোগিতা করার জন্যই। অন্য কোনো অসৎ কারণের কথা ভাববেন না। সেসব চল তখনও গ্রাম জীবনে চালু হয়নি। অন্তত আমরা দেখিনি। গরীব, মধ্যবিত্ত (তখন গরীব এবং মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল উনিশবিশ)  সকলেরই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। চিকিৎসা করতেন অধিকাংশটাই বিনামূল্যে। কেউ কেউ সাড়া বছরের শেষে চাষের ফসল বিক্রি করে কিছু কিছু দিতেন। সে অঞ্চলে এক ও একমাত্র এলোপ্যাথি চিকিৎসক (এল এম এফ ডাক্তার) যিনি ছিলেন, তিনিও এভাবেই চিকিৎসা করতে বাধ্য ও অভ্যস্থ ছিলেন। তখন গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাই ছিল এমন। 

সে বছর আমার ছিল মাধ্যমিকের ফাইনাল পরীক্ষা। দেখতে দেখতে এই মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ব্যবস্থা অনেকদিনের পুরনো হয়ে গেল। আমার দাদা দিদিদের সময় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ছিল না। অর্থাৎ টেন প্লাস টু ছিল না। একেবারে এগারো ক্লাসে হায়ার সেকেন্ডারি ছিল।কিন্তু আমি মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিয়েছি ।আবার আমার ছেলেও দিয়েছে। যাইহোক, সে অন্য কথা। আমার মাধ্যমিকের পরীক্ষার বছর আমাদের গ্রামের একমাত্র খড়ের চালের মাটির ঘরটি, বাবার আর্থিক অসঙ্গতির জন্য উপযুক্ত মেরামতি না করতে পারায় ও অতিবর্ষায় ভেঙে পড়ে। তখন আমাকে গ্রামে এক আত্মীয়ের কাছে রেখে আমাদের বাবা  মা ও অন্যান্যভাইদের নিয়ে দুর্গাপুরে চলে আসে। আমার যেহেতু কয়েকমাস পরেই মাধ্যমিক ফাইনাল তাই ওই কয়েকমাসের জন্য আত্মীয়দের কাছে সাহায্য চাওয়া, যাতে সেখানে থেকে ওই সময়টুকু স্কুল যাওয়া ও পরীক্ষা দেওয়াটুকু করতে পারি। কিন্তু দিনকয়েক পরেই সেই আত্মীয়রা আমার ভার বহন করতে বেশ কষ্ট পেতে লাগলেন এবং বিভিন্নরকম অসহযোগিতা করতে লাগলেন। সে সময় হাইস্কুলের বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই নৃসিংহ বিশ্বাস আমাকে রাতের দিকে তাঁর ঘরে রেখে পড়ানো ও রাতে খাওয়া শোয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে মোটা মাইনে পাওয়া এবং দিনভর প্রাইভেট পড়িয়ে প্রচুর আয় করা মাস্টারমশাই ছিলেন না তাঁরা তখন , যে একটি দুটি এমন নজির রেখে নিজের মহত্ব প্রচারের সুযোগ নেবেন। আগেই বলেছি তখনও মাস মাইনে নিয়মিত সময়ে হত না এবং গ্রামজীবনে প্রাইভেট পড়ানোর চল ছিল না। এই সাহায্যটুকু তাঁকে করতে হয়েছিল তাঁর অর্থনৈতিক অসামর্থ্য নিয়েই।

আর সেই পোস্টমাস্টারমশাই বিষয়ক আলোচনা আর কী বলব। কিন্তু সেই মাস্টারমশাইদের অবদান একসময়ে, আমার চাকরি জীবনের শুরুতেও দেখেছি, আমাদের অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত সমাজে ছিল অপরিসীম। বিশেষত সেই জীবন সম্পর্কে যেহেতু আমার ব্যক্তিগত কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার কিন্তু প্রকৃত পোস্টমাস্টার নয়। অশিক্ষিত, দুর্বল মানুষের কাছে পোস্টমাস্টার এক মসীহ স্বরূপ ছিলেন। কোলিয়ারি ফিল্ডে কাজ করার সময় দেখেছি সেখানকার শ্রমিক মজুরদের কাছে এরিয়া ম্যানেজার বা ফিল্ড অফিসারের চেয়েও পোস্টমাস্টারের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল বহুগুণে বেশি। অনেক ক্ষেত্রে ডাকহরকরা আর পোস্টমাস্টার একই ব্যক্তি ছিলেন। পুরনো দিনের গল্প উপন্যাসে, হিন্দি সিনেমাতেও তাদের সগৌরব উপস্থিতি ছিল। আর অমলের কাছে রাজার যে চিঠি আসার কথা তার বাহক তো ডাকঘর তথা ডাকহরকরা।

স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ হয়নি প্রথম জীবনে। অবশেষে যেদিন হল, বুকের ভেতরের কৌতুহল আর বিস্ময় ততদিনে মারা গেছে।

 

দিশারী মুখোপাধ্যায় 
কবিসভা 
৩সি /৫ শরৎপল্লি 
দুর্গাপুর 713206

 

মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ


মুদ্রিত সংখ্যা সংগ্রহ বিষয়ক জরুরি কথা

নবপ্রভাত ব্লগজিনের ৬৮তম সংখ্যা (কার্তিক ১৪৩০ অক্টোবর ২০২৩) প্রকাশিত হল। কথামতো এই সংখ্যাটি বই (মুদ্রিত পত্রিকা) আকারে একটি প্রকাশনী থেকেও প্রকাশিত হল। ফন্ট একটু ছোট রেখে সাড়ে আট ফর্মার পত্রিকা হয়েছে। মুল্য ১৭৫ টাকা। তবে আমরা একটা কোড দিচ্ছি ( কোড: NABAPRAVAT30 )। এটা অর্ডার ফাইনাল করার সময় ব্যবহার করলে ১৪৯ টাকায় বইটি পাওয়া যাবে। অর্ডার করলে বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন।  (একটি সংখ্যার জন্য ডেলিভারি চার্জ নেবে ৫০ টাকা। একাধিক নিলে ডেলিভারি চার্জ অনেকটাই কমবে। এটা প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব নিয়ম।)  কোড ব্যবহার করলে ১৯৯ টাকায় (ডেলিভারি চার্জসহ) বইটি পেয়ে যাবেন।  আগ্রহীরা সংগ্রহ করতে পারেন। 

যাঁরা অনলাইন অর্ডারে স্বচ্ছন্দ নন, অথবা, অনলাইনকে বিশ্বাস না করে আমাদের থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করতে চান তাঁরা শুধু মুদ্রিত মূল্য ১৭৫ টাকা আমাদের পাঠাতে পারেন। আমরা দায়িত্ব নিয়ে আপনার ঠিকানায় বইটি পাঠিয়ে দেব। হাতে হাতে নেওয়া সম্ভব হলে ১৫০ টাকা পাঠালেই হবে। আমরা আনিয়ে দেব।

 আমাদের গুগুল পে / ফোন পে নম্বর ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬।  প্রয়োজনবোধে এই নম্বরে স্বচ্ছন্দে call বা whatsapp করতে পারেন।

মুদ্রিত সংখ্যা অর্ডার করার লিঙ্ক:  

https://notionpress.com/read/nabapravat-utsab-2023

 

==================

 

এই মুদ্রিত সংখ্যাটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে eBOOK আকারে সামান্য মুল্যে সংগ্রহ করতে চাইলে, নিম্নলিখিত লিঙ্কে ক্লিক করে অর্ডার করতে পারেন




মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক