প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

ছো ট গ ল্প
আজ স্বপ্নময়বাবুর মন ভালো নেই। চারদিকে একটা পুজো পুজো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, তবু তাঁর মনটা ঠিক ভালো নেই। দুপুরের দিকে মাদারপুর স্টেশন একরকম ফাঁকাই থাকে। সারাদিনে দুটো মাত্র থ্রু-ট্রেন ছাড়া খুব বেশি একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন এখন থাকে না। স্বপ্নময়বাবু চুপটি করে জনশূন্য প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে তাঁর নিয়তির কথা ভাবছিলেন।
এমনিতেই কয়েকদিন ধরে স্বপ্নময়বাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। গ্যাস অম্বলের সমস্যা। তার সাথে গান জুড়েছে তাঁর ঘ্যানঘেনে স্ত্রী। আজ অফিসে বেরোনোর আগেই তাঁকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ফেরার সময় যদি আজ তিনি অন্তত একটা নতুন পুজোর শাড়ি কিনে না আনেন, তাহলে তাঁর আজ আর বাড়ি ফেরার দরকার নেই! এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে স্বপ্ল মাইনেতে ডিম্যান্ডিং বউ আর বাচ্চা-কাচ্চদের আবদার মেটাতে স্বপ্নময়বাবুর নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। অফিসে এসেও তাই যেন কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিলেন না। দিস্তা দিস্তা ফাইলের জটিল সব হিসেব অন্যমনস্কতায় ক্যালকুলেটরে করতে গিয়েই একটা মারাত্মক গড়মিল করে ফেললেন!
নতুন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার লোকটি বদরাগী আর কড়া-বিশেষত প্রবীন এমপ্লয়িদের তিনি নাকি খুব একটা অনুকম্পার চোখে দেখেন না। তিনি হিসাবে ভুল পেয়ে যখন স্বপ্নময়বাবুকে নিজের কেবিনে ডেকে খুব বাজে ভাষায় বকাবকি করছিলেন, তখন তাঁর অপমানে আর লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। গোটা অফিসের লোকেরা জড়ো হয়ে স্বপ্নময়বাবুর অপদস্ত হওয়ার দৃশ্যটি উপভোগ করতে করতে মুখ টিপে হাসাহাসি করছিল। স্বপ্নময়বাবুর চোখ ফেটে জল আসছিল। তিনি চুপচাপ কালো হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে মাথা হেঁট করে এককোনায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
নতুন ম্যানেজারবাবু রেজিগনেশানটা টাইপ করে টেবিলে রাখা ছোট্ট প্রিন্টার থেকে প্রিন্ট করে সেটা স্বপ্নময়বাবুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কড়া গলায় বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, "আপনার তো মেইল আইডি নেই, তাই প্রিন্ট করেই দিলাম। এটা নিন আর এখুনি বেরিয়ে যান! কাল থেকে আপনার আর আসার দরকার নেই!" স্বপ্নময়বাবু অবিশ্বাসের বোবা চোখে শূন্য দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ রেজিগনেশন লেটারটা হাতে নিয়ে নতুন ম্যানেজারবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন; তারপর গুটি গুটি পায়ে মাথা নীচু করে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। কারুর সাথে একটা কথাও বললেন না।
অফিস থেকে মাদারপুর স্টেশনে আসার রাস্তাটুকু মনে মনে অনেক লড়াই করলেন স্বপ্নময়বাবু। পুজোর আগে এই বাজারে চাকরি যাওয়া মানে তিনি এই বুড়ো বয়সে আর কোথাও চাকরি পাবেন না। অতএব এর চেয়ে রেললাইনে গলা দেওয়াই শ্রেয়! তিনি মরলে অন্তত এফ.ডি.-তে জমানো অবশেষটুকু তাঁর বউ বাচ্চারা পাবে। তাতে কিছু বছর তাদের চলে যাবে। তারপর তারা কীভাবে খাবে তা আর তিনি জানেন না!
–"বাবু দুটো ভিক্ষা দিন না, দিন না বাবু-অনেকদিন কিছু খেতে পাইনি। দিন না বাবু।"
স্বপ্নময়বাবু বেঞ্চ থেকে উঠে বারবার ঝুঁকে ঝুঁকে আঁকাবাঁকা রেললাইনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন থ্রু-ট্রেনটা আসবে আর তিনি ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন। তার মাঝেই কোত্থেকে এই নোংরা পোশাকের ভিখিরি ছেলেটা এসে ভিক্ষা দিন ভিক্ষা দিন বলে এমন ঝুলোঝুলি করতে লাগল যে এবার স্বপ্নময়বাবু বিরক্ত হলেন! ট্রেনটা হর্ন দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে আসছে! ছোট ছেলেটা যেভাবে তাঁর গায়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করছে, তাতে মনে হচ্ছে না আজ তিনি আত্মহত্যাটাও শান্তিতে করতে পারবেন! ছেলেটা এবার ঘ্যানঘ্যান করতে করতে স্বপ্নময়বাবুর পকেটে হাত ঢোকাতে গেলেই মেজাজ হারালেন তিনি! ট্রেনটা এসেই পড়েছিল প্রায় প্ল্যাটফর্মে-স্বপ্নময়বাবু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এতক্ষণের চেপে রাখা রাগ আর বিতৃষ্ণার বিস্ফোরণ যেন উগরে দিলেন ছেলেটির উপর!
– "কুত্তার বাচ্চা! মরা মানুষেরও পকেট মারবি? শান্তিতে মরতেও দিবিনে? এই নে তোর ভিক্ষা-" বলেই প্রচন্ড এক ধাক্কা মারলেন বাচ্চা ছেলেটার বুকে! ছেলেটা সেই ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে উড়ে গিয়ে পড়ল রেললাইনে-আর তখনই তীব্র ঝমঝম শব্দে দ্রুত বেগে থ্রু ট্রেনটা স্বপ্নময়বাবুর স্তম্ভিত চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে গেল! স্বপ্নময়বাবুর বুক শুকিয়ে গেছে! তাঁর আর আত্মহত্যা করা হল না! উল্টে এইমাত্র তিনি একটা নির্দোষ ভিখিরি ছেলেকে খুন করে ফেললেন! প্রায় শ্বাস বন্ধ করে ট্রেনটার পাস করে যাওয়ার অপেক্ষা করলেন তিনি; তারপর উর্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে দেখলেন, কই? রেললাইন তো ফাঁকা! কয়েকটা নোংরা প্ল্যাস্টিকের খোল খোয়াপাথরের এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে আছে! কিন্তু কোথাও তো কোনো পিষে যাওয়া বা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলের শরীরের টুকরো পড়ে নেই! আশ্চর্য! এত দ্রুতগামী একটা ট্রেনের সামনে পড়ে ছেলেটা কি অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি? ঘোলাটে চোখে স্বপ্নময়বাবু প্ল্যাটফর্মের ওপরেই ধপ করে বসে পড়লেন!
দু'জন প্যাসেঞ্জার নিজেদের মধ্যে কী একটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে বিধ্বস্ত স্বপ্নময়বাবুর পেছন থেকে চলে গেল। আশ্চর্য! তারা কি স্বপ্নময়বাবুর এই স্থূল শরীরটা চোখেই দেখতে পেলেন না? কান খাড়া করলেন স্বপ্নময়বাবু।
–"যাই বলো মাধবদা, মাদারপুর রেললাইনে কিন্ত অনেক বছর পর এরকম অ্যাকসিডেন্টের কেস ঘটল আজ সকালে! উফ্! তাও আবার ডাবল! ভাবা যায়!"
–"হ্যাঁ, ওই ভিখিরির বাচ্চাটাকে তো অনেকবার দেখেছি প্ল্যাটফর্মে! কৃষ্ণর ছেলে। বাপটা দেনার দায়ে সুইসাইড করলো গেল বছর তারপর বউটাও মরল। প্যাসেঞ্জারদের হাত টেনে টেনে ভিক্ষে করত অনাথ ছেলেটা। আহারে কত কষ্ট পেয়েই না মরল…"
–"তবে মাধবদা, যাই বলো-বাচ্চাটার সাহস ছিল! বুকে ধাক্কা খেয়েও কেমন শয়তান বুড়োটার হাত টেনে ধরে একসাথেই জড়াজড়ি করে লাইনের উপর পড়ল! বুড়োটার কথা সকালে বডি নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশগুলো বলাবলি করছিল। লোকটাকে নাকি আজ সকালেই চাকরি থেকে স্যাক করেছিল! আমি তো সকালে স্টেশনেই ছিলাম! গোটা ঘটনাটা নিজের চোখে দেখা! ট্রেনের ধাক্কায় বুড়োটার হাত দুটো ছিঁড়ে গিয়ে রেললাইনের দু'পাশে পড়েছিল। আমার তো দেখেই গা-টা-ঘুলিয়ে…বাপরে! কপালে সেই মরণই লেখা ছিল!"
–"বলিস কী? তুই চিনতিস নাকি বুড়োটাকে?"
–"না-না! পুলিশের লোকেরা বলাবলি করছিল। মৃত বাচ্চাটার নাম কুশ আর বুড়োটার নাম..কী যেন…হ্যাঁ-স্বপ্নময় ব্যানার্জী! বয়স ফিফটির কাছাকাছি…"
লোকগুলোর কথা শুনে আতঙ্কে শিউরে উঠে স্বপ্নময়বাবু এই প্রথম খেয়াল করলেন, কাঁধ থেকে তাঁর হাতের জায়গাদুটো শূন্য! দুটো দগদগে ক্ষতচিহ্ন থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে! অথচ তিনি কোনোরকম যন্ত্রণার অনুভূতি টের পাচ্ছেন না! শরীরটাও যেনবড্ড হালকা হালকা লাগছে! প্রচন্ড আতঙ্কে প্রায় বোবা হয়ে তিনি বাঁ-পাশে চোখ ঘুরিয়ে শিউরে উঠলেন! সারি সারি লোক পরপর বাটি নাচিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর বসে ভিক্ষা করছে! তাদের কারুর কারুর হাত নেই, পা নেই, কারুর আবার দেহের নিম্নাঙ্গ কোমর থেকে যেন কেটে নেওয়া হয়েছে! দু'জনের তো আবার ধড়ের উপর মাথাটাই নেই! সারি দিয়ে বসা অপার্থিব ভিখিরি দলের মধ্যে তিনি ছোট্ট কুশকেও দেখতে পেলেন। তারও দুটো হাত নেই! সে তবুও কাঁদছে না! খিলখিল করে হেসে উঠে সে স্বপ্নময়বাবুর দিকে তাকিয়ে বিকৃত খোনা গলায় বলে উঠলো, "আসুন বাবু! আজ থেকে আমার পাশে বসেই আমাদের সাথে ভিক্ষা করুন। মুক্তি ভিক্ষা। এছাড়া আপনার আর কিছু করারও নেই! আমরা যারা ট্রেনের ধাক্কায় অপঘাতে মরে যাই, তারা দিনের পর দিন এখানে বসেই ভগবানের কাছে মুক্তি প্রার্থনা করি। আপনি তো মুক্তি পেতেই চেয়েছিলেন, কি তাই না বাবু?"
বাচ্চাটার কথা শুনে চারপাশ সার বেঁধে বসে থাকা ছিন্নভিন্ন ভিখিরিগুলোর শরীরেও যেন অশরীরী খোনা হাসির রোল উপচে পড়ল! ভ্যাবাচাকা খাওয়া স্বপ্নময়বাবুর কানের পাশ দিয়ে তীব্রবেগে হর্ণ দিতে দিতে ছুটে বেরিয়ে গেল মাদারপুর জংশনের দুপুরের শেষ থ্রু ট্রেনটা!
নাম- আকাশদীপ গড়গড়ী
ঠিকানা- ৬ নং বিজয়নগর, নৈহাটী, ২৪ পরগণা(উত্তর), পিন- ৭৪৩১৬৫
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন