Featured Post
প্রবন্ধ ।। নিষেধের জালে সাহিত্য ।। অনিন্দ্য পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
প্র ব ন্ধ
নিষেধের জালে সাহিত্য
অনিন্দ্য পাল
সরকার পোষিত সাহিত্য পুরস্কার এবং লালিত্য পাবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু সাহিত্য যে সব সময় সরকারি বা প্রশাসনিক আনুগত্য দেখাবে তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সাহিত্যের গণ্ডী প্রশাসনের হাতের আওতায় চলে আসে। প্রশাসনের রক্তচক্ষু আর একদল 'গেল গেল' পন্থীর আঁচড় কামড়ে বারংবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সাহিত্য। সেন্সরশিপ সাহিত্যের আঙিনায় কাঁটাতারের জড়াপিট্টি, সাহিত্যের যে অঙ্গ যখনি প্রচলিত গত থেকে বেরিয়ে, প্রচলিত নিয়মের বেনিয়মগুলোকে অক্ষরময়তায় প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়েছে, তখনি তাকে একটা ভয়ঙ্কর ধারালো কাঁচি দিয়ে কচুকাটা করেছে। সাহিত্য বারংবার আহত হয়েছে তার ধাঁচায় যৌনতা, অশ্লীলতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্ম, সমাজের বাস্তবতাকে সোজাসাপ্টা বা রহস্যময় আসবাবের উপস্থিতিতে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও।
বিশ্বের নিষিদ্ধ বই গুলোর মধ্যে প্রথমেই যার নাম করতে হয়, সেটা একটা কবিতার বই। 'লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল' নামে এই কাব্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, কয়েকটি কবিতায় সমকামিতা এবং বিকৃত হিংস্রতা ও ধর্ষকামকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে যে মামলা দায়ের করা হয় তার ফলে কাব্যগ্রন্থটির ছয়টি কবিতাকে নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু তাই নয় কবিকে জরিমানা ও দিতে হয়। কবি কে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, হ্যাঁ, ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার। ১৮৫২ সালে একশোটি কবিতা নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় 'লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল'। সেই বছরই আর্নেস্ট গিনার্দ নামে একজন ফরাসি উকিল কাব্যগ্রন্থটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এরপর ১৮৬১ সালে একশ উনত্রিশটি কবিতা নিয়ে ছাপা হয় ওই কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ, নিষিদ্ধ করা ছটি কবিতাকে বাদ দিয়েই প্রকাশিত হয়। ওই ছটি কবিতা নিয়ে ১৮৬৬ সালে বেলজিয়ামে প্রকাশিত হয় 'Les Epaves' নামে যদিও ১৮৬৫ সালে কবি চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। বেলজিয়ামে প্রকাশিত এই সংস্করণটিও নিষিদ্ধ করা হয় ফরাসি দেশে, আর সেই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। ১৮৬৮ সালে ‘লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল’ এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় খোদ ফ্রান্সে কিন্তু ওই ছটি কবিতা বাদ দিয়েই। নিজের দেশেই ৯২ বছর নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল 'শার্ল বোদলেয়ারের' অনবদ্য সৃষ্টি ‘লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল’।
এরপর বলতে হবে আশ্চর্য একটা উপন্যাসের কথা, যেটাকে অনেক সময় অনেক সাহিত্য সমালোচক এইচ. জি. ওয়ালসের 'মেন লাইক গডস' এর প্যারোডি বলেছেন। বইটি লেখা হয়েছিল ১৯৩১ সালে, লেখক অ্যালডাস হাক্সলি। আর বইটির নাম? বিশ্ববিখ্যাত বইটির নাম দিয়েছিলেন 'ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড'। কী এমন ছিল উপন্যাসটিতে? হাক্সলি তাঁর এই উপন্যাসের পটভূমিকা তৈরি করেছেন ২৫৪০ খৃষ্টাব্দের কোনও একটা সময়, স্থানটা লন্ডন। লন্ডন শহর যেন সমস্ত পৃথিবীর ছোট্ট একটা সংস্করণ, যেখানে বিরাজ করছে অনন্ত শান্তি। এই শান্তিময় বিশ্ব শাসন করছে একটাই মাত্র শাসনযন্ত্র। একটাই বিশ্বরাষ্ট্র সমস্ত পৃথিবীর দায় নিয়েছে ঘাড়ে। তখন জনসংখ্যা আজকের পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম। ফলে এই সময়ে পৃথিবীর সিমীত জনসংখ্যা আর অফুরান সম্পদ, যেন স্বপ্নের পৃথিবী। কোনও মানুষের কোনও অভাব নেই। তবে এগুলো কোনো মহান বিশেষত্ব নয়, যেটা মূল উল্লেখযোগ্য বিষয় সেটা হল, মানুষ আর জন্মায় না ২৫৪০ এর পৃথিবীতে। মানুষ তৈরি হয়, কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থায় বিশাল সব হ্যাচারি আর কন্ডিশনিং সেন্টারে উৎপাদন করা হয় মানুষকে। এই ভাবে উৎপাদিত মানুষের আবার পাঁচটা ভাগ- আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা, এপসিলন। এদের মধ্যে আলফা, বিটা উচ্চ শ্রেণীর আর গামা, ডেল্টা, এপসিলন অন্ত্যজ। এই পৃথিবীতে আলফা বিটা উন্নত মানের, এদের সংখ্যা ও একটা দুটো, সেখানে নীচু মানের গামা ডেল্টা এপসিলন নিম্নমানের, মেধাহীন, গড়পড়তা এবং দুর্বল, তবে তাদের সংখ্যা অনেক। মানুষের জন্য যৌনতা শুধু মাত্র আনন্দ আর সুখ অনুভূতির ব্যাপার, প্রেম, বিয়ে, পরিবার -- এসবের বালাই নেই। আর যদি কেউ এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে গন্য হবে। বিশ্বরাষ্ট্রের বাঁধা নিয়মে মানুষ বাঁচবে কতদিন, সেটাও নির্ধারিত। ষাট বছরের বেশি বাঁচবে না কেউ। মৃত্যুর দিনক্ষণ যখন জানাই আছে, তখন মৃত্যু ভয়, মৃতের জন্য শোক -- এসবের বালাই নেই। এ যেন একটা সমাজ, যেখানে সবাই ইস্পাতের মন নিয়ে বেঁচে থাকে। এ যেন বিজ্ঞানর গর্বিত চোয়ালে সজোরে থাপ্পড় মারার চেষ্টা। ফলে বইটি ধর্ম আর পরিবার বিরোধিতার অভিযোগে প্রথম নিষিদ্ধ হল আয়ারল্যান্ডে, ১৯৩২ সালে। ১৯৬৫ সালে মেরিল্যান্ডে, ১৯৬৭ সালে ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ভারতে বইটিকে 'পর্ণ সাহিত্যে'র বই বলে দেগে দেওয়া হয়।
'কাঁদিদ' লেখা হয়েছিল ১৭৫৯ সালে। ভলতেয়ারের এই উপন্যাস দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল কেমনভাবে অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্স ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, কেমন করে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে সমস্ত মূল্যবোধ আর সম্পর্ক গুলো। যুদ্ধ যেন ফ্রান্সের বুকের উপর চেপে বসা একটা ভোঁতা পেরেক। ওয়েস্টফেলিয়ার প্রাসাদে বালজার বাহিনীর তাণ্ডব, ব্যারন পরিবারের সবাইকে নির্মম ভাবে খুনের পাশাপাশি কাঁদিদের স্বপ্নের দেশ এলডোরাডো আর ব্যারনের মেয়ে কুনেগোঁদের সঙ্গে কাঁদিদের প্রেম, বিচ্ছেদ আবার মিলন পাঠকের চিন্তা চেতনা কেমন ঘুলিয়ে দেয়। ভলতেয়ার যেটা বলতে চেয়েছেন, অবাস্তব দর্শন আর উচ্চমাত্রার বৌদ্ধিক চিন্তা ব্যক্তি জীবনকে ছারখার করে দেয়, শান্তি-স্বস্তি-সুখ দেয় না। ১৭৫৯ সালে লেখা হলেও ভলতেয়ার নিজেই বইটির লেখক হিসেবে দায় নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ১৭৬৮ সালের শেষ দিকে তিনি 'ড: রালফ' ছদ্মনামে বইটির লেখক হিসেবে দায় নেন। এ বই যে নিষেধের বেড়াজালে আটকে যাবে তা তো খুব স্বাভাবিক। হলো ও তাই। জেনিভার 'গ্রেট কাউন্সিল' এবং পারি শহরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বইটা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়াও ১৯২৯ সালে বোস্টনে মার্কিন শুল্ক বিভাগের এক অফিসার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাঠানো কাঁদিদের সব কটা কপি বাজেয়াপ্ত করেন। ১৯৪৪ সালে 'কনকর্ড বুকস'- এর তালিকা থেকে এই বইটার নাম বাদ দেওয়ার জোরালো দাবি ওঠে।
এবার বলতে হবে জেমস জয়েসের 'ইউলিসিস'-- এর কথা। প্রায় আড়াই লাখ শব্দের একটা 'এপিক' এই ইউলিসিস, ১৯১৮ সালে মার্কিন পত্রিকা 'দ্য লিটল রিভিউ' তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯০৪ সালে ডাবলিনে লিওপোল্ড ব্লুমের কাটানো একটি দিন এই উপন্যাসের মেরুদণ্ড। অদ্ভুত চরিত্র এই লিওপোল্ড ব্লুম, ওই বছরের ১৬ই জুন তারিখে লিওপোল্ডের দিনযাপনের মত সামান্য একটা ঘটনা যার হাত ধরে হয়ে ওঠে বিশ্ববন্দিত এবং নিন্দিতও বটে। এই এপিকটা ১৯২২ সালে পারি শহরে প্রকাশক সিলভিয়া বিচের হাত ধরে প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। তবে ঝামেলাটা বেঁধেছিল ১৯২০ সালে যখন লিটল রিভিউতে এই এপিকের 'Nausicaa' অধ্যায়টা প্রকাশিত হয়। মামলা রুজু হয়েছিল লিটল রিভিউয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল অশ্লীলতার। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ইউলিসিস ব্রিটেনে সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯২১ সালে একটি ট্রায়াল কোর্টের বিচারে 'ইউলিসিস' এবং 'দ্য লিটল রিভিউ' পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তবে লেখক জেমস জয়েসের নিজের দেশ, আয়ারল্যান্ডে ইউলিসিস কখনো নিষিদ্ধ হয়নি।
২০২২ সালের ১২ই আগস্ট নিউইয়র্কের ছাউতাউকুয়াতে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল। বিশ্ববিখ্যাত লেখক সলমন রুশদি ছাউতাউকুয়া ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দিতে উঠে আক্রান্ত হলেন। চব্বিশ বছরের এক যুবকের ছোরার মুহুর্মুহু আঘাতে প্রায় মৃত্যুর মুখে পৌঁছে গেলেন। একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল তাঁর। অপরাধ? অপরাধ অন্য কিছু নয়, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'দ্য স্যাটানিক ভার্সেস' -- লেখাটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। জিব্রাইল ফরিস্তা আর সালাদিন শামশা -- 'স্যাটানিক ভার্সেস'-এর দুই অন্যতম চরিত্র। উপন্যাসটি মুসলিম মৌলবাদী শক্তির কোপে পড়ে। ১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ডে বইটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। বইটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, উপন্যাসটি পশ্চিমি দুনিয়ায় মুসলিম বিরোধী সাহিত্যের অনুসরণে লেখা আর এতে মহম্মদকে যেন গণিকালয়ের দালাল হিসেবে দেখানো হয়েছে। আরো অভিযোগ, বইটি ইতিহাসের কোনও তথ্য-তত্ত্ব মেনে লেখা হয় নি।
'স্যাটানিক ভার্সেস' প্রকাশিত হবার শুরু থেকেই বিতর্ক এর পিছু ছাড়েনি। যে বছর বইটি প্রকাশিত হয়, সেই বছরই খুশবন্ত সিং, 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি' পত্রিকায় বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। ভারত সরকার বইটির আমদানির উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই বছরেই নভেম্বর মাসে বইটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, বাংলাদেশ, মিশর, সোমালিয়া, মালেশিয়া, কাতার প্রভৃতি দেশেও নিষিদ্ধ হয়ে যায় বইটি। এই বছরেই ব্রিটেনে সাত হাজার মুসলিম এই বইয়ের অনেক কপি পুড়িয়ে দেয়। এই বিতর্ক ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে পরের বছর, ১২ই ফেব্রুয়ারি হাজার দশেক বিক্ষুব্ধ পাকিস্তানের জনগণ ইসলামাবাদের আমেরিকান কালচারাল সেন্টার আক্রমণ করে। জম্মু কাশ্মীরেও বিক্ষোভ দাঙ্গা শুরু হয়। শ্রীনগরে রুশদি বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এই বছরেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেইনি স্যাটানিক ভার্সেসকে নিষিদ্ধ এবং এর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষের মৃত্যুদণ্ড দাবী করেন। সলমন রুশদি কে হত্যা করার জন্য ঘোষনা করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এমনকি এই উপন্যাসের জাপানি অনুবাদক হিতোশি ইগারেশিকে ১৯৯১ সালে খুন করা হয় এই অনুবাদ কাজের জন্য।
আরও কিছু উল্লেখযোগ্য নিষিদ্ধ সাহিত্য:
লোলিটা
রুশ-মার্কিন বংশোদ্ভূত লেখক ভ্লাদিমির নাবোকভের লেখা ‘লোলিতা’ বা 'লোলিটা' উপন্যাসটি 'লোলিটা-- আমার আলো আমার অন্ধকার আমার কামনা আমার বাসনা আমার পাপ আমার আত্মা।' এরকম গভীর কামনায় দগ্ধ উচ্চারণে শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই উপন্যাসটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল। মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি, হামবার্ট আর তার ১২ বছরের সৎমেয়ের অসম সম্পর্ক এই উপন্যাসের মূল কথা। হামবার্টের নিজের সঙ্গে নিজের কথা, সলিলকি এই উপন্যাসের চলন বলন, যৌন সম্পর্কের চেনা নিয়ম কানুন ভেঙে একটা বেপরোয়া, দুঃসাহসিক এবং অনৈতিক স্পর্ধা এই উপন্যাসের উপজীব্য।
১৯৫৫ সালে উপন্যাসটি প্রথম প্যারিসে প্রকাশিত হয়। রুশ ভাষী নভোকভের ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাসটি প্রথম নিষিদ্ধ হয় ফ্রান্সেই। এছাড়াও যুক্তরাজ্য,আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বইটি অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫৮ সালে কানাডায়ও এই উপন্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞার কোপ নেমে এসেছিল, পরে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
আঙ্কল টম'স কেবিন
হ্যারিয়েট বিচার স্টোর লেখা এই উপন্যাসটি ক্রীতদাস ক্রীতদাসীদের জীবনের গাঢ় কালো অন্ধকারটাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিল। উপন্যাসে বলা হয়েছে, ' ওরা এক ধরনের জন্তু-- শুধু ওদের লেজ থাকে না এই যা তফাত।' ওরা তাই ক্রীতদাস। মূল চরিত্র আঙ্কল টম একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। এই উপন্যাসের পরতে পরতে দেখানো হয়েছে কালো মানুষের দাসত্বের শৃঙ্খল, বর্ণবৈষম্যের কষাঘাত, টাকার বিনিময়ে মানুষের জীবন কেমন করে জন্তুদের চেয়েও খারাপ হয়ে যেতে পারে আর কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের নির্মম নির্যাতনের বাস্তব ছবি। ১৮৫২ সালের ২০ মার্চ প্রকাশিত হয় বইটি, প্রচুর বিক্রি হলেও বিতর্ক পিছু ছাড়ে নি। দক্ষিণ আমেরিকার অনেক অঞ্চলে নিষিদ্ধ হয়ে যায় বইটি। এমনকি রাশিয়াতে ও নিষেধের খড়্গ নেমে এসেছিল এই উপন্যাসের উপর। অনেক পরে, ১৯৮৪ সালে 'ইলিয়নয় স্কুল ডিস্ট্রিক্ট' এই বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আনন্দমঠ
১৭৭১ সালের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ছায়া অবলম্বনে লেখা এই উপন্যাসটিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে তীব্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্লাবন এঁকে দিয়েছিলেন, তা যেমন ভারতীয়দের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি বিতর্ক ও হয়েছিল যথেষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্র সরকারি চাকরি করতেন তাই তিনি সরকারের কোপেও পড়েন। সেইভাবে একেবারে নিষিদ্ধ না হলেও বইটিকে বারবার ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল।
প্রলয় শিখা
কাজী নজরুল ইসলামের এই গ্রন্থটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ এবং ১৫৩ ধারা অনুযায়ী ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ হয়। কবির ছ'মাস কারাদণ্ড হয়। তবে গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়, তাই নজরুলকে সে যাত্রা কারাভোগ করতে হয় নি। তবে এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল, নজরুল ইসলামের মোট পাঁচটি বই ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, প্রলয় শিখা ছাড়াও অগ্নিবীণা, যুগবাণী(১৯২২), বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙার গান(১৯২৪) অন্যতম।
অ্যানিমেল ফার্ম
ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল লিখে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে এমন ‘বিগ ব্রাদার’রা পৃথিবী শাসন করবেন, যারা ‘থট পুলিশ’ বা চিন্তার পুলিশ দিয়ে মানুষের ইচ্ছা আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কেড়ে নেবেন। এই লেখকের রাশিয়ার স্টালিন যুগের ভয়াবহতাকে তুলে ধরা বই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল। ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ ১৯৪৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তবে বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্কের জন্য যুক্তরাজ্যে বইটির প্রকাশে সাময়িক বিলম্ব ঘটে। জর্জ অরওয়েল নিজে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে জোসেফ স্তালিনের শাসনের সমালোচক ছিলেন তিনি। প্রকারান্তরে স্তালিনের মতবাদের বিরোধিতা করা হয়েছিল ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ উপন্যাসটিতে। ওই সময় জার্মানিতে বইটি বাজেয়াপ্ত করেছিল মিত্র বাহিনী। ১৯৪৬ সালে যুগোস্লাভিয়ায় বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯১ সালে বইটি নিষিদ্ধ হয় কেনিয়ায়। একবিংশ শতাব্দীতেও নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারেনি ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। ২০০২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ট্রপিক অফ ক্যানসার
হেনরি মিলারের বইটি ১৯৩৪ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে সেই সময় বইটির বিরুদ্ধে মিসোজিনি অর্থাৎ নারীর প্রতি বিদ্বেষ, এবং যৌনতা বিষয়ক উপাদান বেশি থাকার অভিযোগ উঠেছিল। এরপর ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বইটি প্রকাশের সময়ও অশ্লীলতার অভিযোগে কয়েকটি মামলা হয়। পরে অবশ্য সেই অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন একটি আদালত।
লজ্জা
তসলিমা নাসরিন সারা বিশ্বে এক চরম বিতর্কিত লেখিকা। ভারতবর্ষে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে একটি হিন্দু পরিবারের ওপর মুসলমানদের অত্যাচার ও সে সময়কার পরিস্থিতির ওপরে ভিত্তি করে লেখা উপন্যাস 'লজ্জা' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে সেরা সাতটি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকার প্রথমেই রয়েছে তসলিমা নাসরিনের এই বই 'লজ্জা'। তসলিমা নাসরিন এই বইটির জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টে মুক্তচিন্তা বিভাগে শাখরভ পুরষ্কার পেয়েছেন। লেখিকা আজো নিজের দেশ বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত।
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। এরিখ মারিয়া রেমার্কের এই বই ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা যে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন, সেই বিষয়কে উপজীব্য করেই উপন্যাসটি রচিত। তবে উপন্যাসটি পড়ে ভালো লাগেনি রেমার্কের নিজের দেশের নাৎসি নেতাদের। তাঁরা ভেবেছিলেন, বইটি বেশি মানুষের হাতে গেলে দলের প্রচার কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ওই সময় জার্মানিজুড়ে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
আমেরিকান সাইকো
আটের দশকের শেষের দিকের ম্যানহাটান শহর। বছর তিরিশের প্যাট্রিক বেটম্যান সমস্ত দিন কাটায় নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কোটিপতিদের সঙ্গে ওঠাবসায়, উদ্দাম জীবনের আলোয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তার ব্যস্ত কর্মদিবস, সে যে একজন ব্যাঙ্কার। এই মানুষটাই রাতের অন্ধকারে হয়ে ওঠে রহস্যময়, নির্মম খুনি যে কিনা বলে, 'যখন আমি একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন আমার মনে দু'রকম ভাবনা ছায়া ফেলে যায়। এক মন বলে ওর হাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি আর খুব মিষ্টি করে কথা বলি ওর সঙ্গে। আমার ব্যবহারে ওর যেন তাক লেগে যায়। ….. অন্য মন বলে ' একটা সরু কাঠির মাথায় মেয়েটার কাটা মাথাটা টাঙিয়ে একবার দেখতে ইচ্ছা করে যে সেটা দেখতে ঠিক কেমন লাগে।' ধীরে ধীরে এই প্যাট্রিক বেটম্যান হয়ে ওঠে অত্যাচারী, ধর্ষক, এমনকি নরমাংসভোজী। ব্রেট ইস্টন এলিসের এই উপন্যাসটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বইটাকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এই উপন্যাসেটিকে কেবল মাত্র আঠারো বছরের উপরে যাদের বয়স তাদের জন্য ছাড় দেওয়া হয়।
এছাড়াও অনেক বই বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে, নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে কবিতা, ছবি, সিনেমার ওপরেও। ভারতে হাংরি জেনারেশনের কবি মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ এবং সমীর রায়চৌধুরী কবিতা লিখে গ্রেপ্তার হন, বিখ্যাত সাহিত্যিক ডি এইচ লরেন্স 'রেপ অব দি সাবাইন উইমেন' নামে একটি ছবি এঁকে গ্রেপ্তার হন। বুদ্ধদেব বসুর 'রাত ভ'রে বৃষ্টি', সমরেশ বসুর 'প্রজাপতি', শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পথের দাবী', ড্যান ব্রাউনের 'দ্য ভিঞ্চি কোড', কবি সিলভিয়া প্লাথের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'দ্য বেল জার', নাদিন গার্ডিমারের 'বার্গারস ডটার', অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর 'দ্য হাউল', অরুন্ধতী রয়ের 'গড অফ স্মল থিংস', ফ্রাঞ্জ কাফকার 'দ্য মেটামরফসিস' -- এরকম অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে পৃথিবী জুড়ে। তবে নিষিদ্ধ করে সাহিত্যের বা শিল্পের তেমন কিছু ক্ষতি সাধন করা গেছে বলে মনে হয় না।
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মুদ্রিত সংখ্যা সংগ্রহ বিষয়ক জরুরি কথা
নবপ্রভাত ব্লগজিনের ৬৮তম সংখ্যা (কার্তিক ১৪৩০ অক্টোবর ২০২৩) প্রকাশিত হল। কথামতো এই সংখ্যাটি বই (মুদ্রিত পত্রিকা) আকারে একটি প্রকাশনী থেকেও প্রকাশিত হল। ফন্ট একটু ছোট রেখে সাড়ে আট ফর্মার পত্রিকা হয়েছে। মুল্য ১৭৫ টাকা। তবে আমরা একটা কোড দিচ্ছি ( কোড: NABAPRAVAT30 )। এটা অর্ডার ফাইনাল করার সময় ব্যবহার করলে ১৪৯ টাকায় বইটি পাওয়া যাবে। অর্ডার করলে বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন। (একটি সংখ্যার জন্য ডেলিভারি চার্জ নেবে ৫০ টাকা। একাধিক নিলে ডেলিভারি চার্জ অনেকটাই কমবে। এটা প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব নিয়ম।) কোড ব্যবহার করলে ১৯৯ টাকায় (ডেলিভারি চার্জসহ) বইটি পেয়ে যাবেন। আগ্রহীরা সংগ্রহ করতে পারেন।
যাঁরা অনলাইন অর্ডারে স্বচ্ছন্দ নন, অথবা, অনলাইনকে বিশ্বাস না করে আমাদের থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করতে চান তাঁরা শুধু মুদ্রিত মূল্য ১৭৫ টাকা আমাদের পাঠাতে পারেন। আমরা দায়িত্ব নিয়ে আপনার ঠিকানায় বইটি পাঠিয়ে দেব। হাতে হাতে নেওয়া সম্ভব হলে ১৫০ টাকা পাঠালেই হবে। আমরা আনিয়ে দেব।
আমাদের গুগুল পে / ফোন পে
নম্বর ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬। প্রয়োজনবোধে এই নম্বরে স্বচ্ছন্দে call বা whatsapp করতে পারেন।
মুদ্রিত সংখ্যা অর্ডার করার লিঙ্ক:
https://notionpress.com/read/nabapravat-utsab-2023
==================
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন