প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

ছো ট গ ল্প
কি রে উমা, উঠে আয়। কখন থেকে ডাকছি তোকে শুনছিস না। কতবার বলছি টেনশনের কিছু নেই কিন্তু কে কার কথা শোনে! আরে বাবা, পড়াশোনা করেই তো পরীক্ষাটা দিয়েছিস। তবে এত টেনশন করার কি আছে? সব সাবজেক্টে পাশ করলেই তো হলো। তোকে তো পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হবার দিব্যি দিয়ে রাখেনি কেউ। তবে কিসের জন্য এত টেনশন? সেই কোন বেলায় রেজাল্ট বেরোবে তার জন্য রাতভর জেগে আছিস। এখনও নাওয়া খাওয়া ভুলে বসে আছিস, কেন? আচ্ছা, তুই এইভাবে বসে থাকলে আমার কি ভালো লাগে?
উমার আজ হায়ারসেকেন্ডারীর রেজাল্ট বেরোবে। আর্টসে মোটামুটি ভালোই দখল আছে ওর। মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন ছিল। এইচ. এসে যাতে রেজাল্ট খারাপ না হয় সেজন্য নিজেই আর্টসে ভর্তি হয়েছে। সবকিছু তো ঠিকঠাকই চলছে ঠিক যেভাবে ও চেয়েছে।
তবুও যে কেন এই টেনশন ভেবে পায়না নন্দিনী। অবশ্য মাত্র একটা বছরে একটা মেয়েকে কতটুকুই বা জানা যায়? যে মায়ের কোল আলো করে এই মেয়ে এসেছে সেও কি তার মেয়েকে সবটুকু বুঝতে পারে? তার ওপর আবার ওইরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর! সেদিন নন্দিনী যেভাবে উমাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুস্কিল। চাকরিসূত্রে কিছু বিশেষ লোকজনের সাথে নন্দিনীর পরিচয় ছিল বলে আর তারা নন্দিনীকে যথেষ্ট সম্মান করে বলেই উমাকে বাঁচাতে পেরেছে নন্দিনী। আসলে মানুদি ঠিক সময়ে ফোনটা করেছিল বলেই মেয়েটাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা গেছে। আর নন্দিনীর কথামতোই তারপর থেকে উমা এখানে আছে।
নন্দিনী যখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জে চাকরি করত তখন উমার মা মানুদি'ই ছিল নন্দিনীর সংসারের সবথেকে বিশ্বস্ত কাজের লোক। বাজার করা, রান্না করা থেকে শুরু করে সবাইকে খেতে দেয়া, ঘরদোর গুছিয়ে রাখা, বাড়িতে অন্যান্য যারা কাজ করে তাদের সবার কাজ বুঝে নেয়া, সবই করত মানুদি। যদিও রান্নার কাজ নিয়েই মানুদি এবাড়িতে প্রথম আসে। তারপর নিজের কাজের গুণে কখন যেন নন্দিনীর পরম ভরসার আপনজন হয়ে ওঠে। সংসারে একজন কাজের লোককে যতটাকা মাইনে দাওনা কেন, তোমার প্রতিটি প্রয়োজনের সময়ে যে মানুষটা সবকিছু গুছিয়ে তোমার হাতে তুলে দেয় তার সেবার কোনো দাম ঠিক করা যায়না বলেই মনে করে নন্দিনী। তাই মানুদিকে মাসের বেতন ছাড়াও ওর মেয়ের টিউশন পড়ার খরচ, বই খাতা, জামাকাপড় সবকিছু দিয়ে সাহায্য করত। নন্দিনী মানুদিকে বলেছে যে তোমার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য কোনো চিন্তা করতে হবেনা। নন্দিনীর মেয়ে তো বিদেশে লেখাপড়া করে ওখানকার ছেলে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। এদেশে আসার তার কোনো ইচ্ছেই নেই। একমাত্র ছেলেটাও এস্ট্রোফিজিক্সের একজন স্কলার। বিদেশী বৌ নিয়ে ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে। দুজনের একই প্রফেশনে থাকার ফলে বন্ডিং খুব ভালো। একজন যা বলে অন্যজন সেই একই কথায় ঘাড় কাত করে। ওরাও বাড়িতে আসতে চায়না। নন্দিনীরা কর্তা - গিন্নি দুজন বয়স্ক মানুষ এখন এই বিশাল বাড়িতে থাকে। ওদের দেখাশোনা, ডাক্তার ওষুধ, অতিথি অভ্যাগত, আত্মীয় পরিজন সামলাতে তো লোক লাগে। তাইতো দুজনের সংসারে সাতজনের হাঁড়ি চাপে। ড্রাইভার, মালির সাথে মানুদি উমা আর ঠিকে কাজের মেয়ে সবারই খাবার ব্যবস্থা আছে নন্দিনীর হেঁসেলে। তাই নন্দিনীর নিজের ছেলেমেয়ে বাড়িতে না থাকলেও সংসার একেবারে ভরপুর।
কর্তা কয়েক বছর আগেই ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। নন্দিনীও এখন রিটায়ার্ড। উমাকে নিয়ে আজকাল দিনের অনেকটা সময় কাটে। উমা বর্তমানে একটা ট্রমা পেশেন্ট বলে ওর ওপর একটু সজাগ দৃষ্টি রাখে নন্দিনী। যে ভয়ংকর ঝড় ওর জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তাতে বেশিরভাগ মেয়েরই নিজেকে শেষ করে দেবার একটা টেনডেন্সি দেখা দেয়। উমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ভাবাটা হয়তো ঠিক হবে না।
ফরেনসিক রিপোর্টের নাথিং সাসপেক্টেড যতই আসুক না কেন লোকের মুখের রসালাপ বন্ধ করা তো সম্ভব নয়। বিশেষতঃ সে যদি গরিব ঘরের পিতৃহারা সন্তান হয় তবে তো আত্মীয় পরিজনরাও মধুলোভী সুযোগ সন্ধানী হয়ে ওঠে। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত একটা
মেয়েকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা যখন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে যতটা সম্ভব আগলে রাখতে হয়। নাহলে ঝরা শিউলির দলে অকালে ঝরে যাওয়া এই ফুল শুধু অপবাদের পাহাড়ে চাপা পড়ে যায়।
সেদিনের কথা মনে পড়লে নন্দিনীরো হাতপা অবশ হয়ে আসে। বিকেল তখন পাঁচটা বাজেনি। বেয়ারা সবে এককাপ চা টেবিলের ওপর নামিয়ে দিয়ে গেছে। ফাইলপত্র সরিয়ে রেখে নন্দিনী কেবল চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়েছে তখনই মানুদির ফোন। কাঁদতে কাঁদতে যা বলল তাতে বোঝাগেল যে ওর মেয়ে স্কুল ছুটির পর যখন বাড়ি ফিরছিল তখন কারা যেন মোটরসাইকেলে করে মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। ওর সাথে যারা ছিল তারা বলেছে যে কেউ উমার নাম ধরে ডেকে কথা বলছিল আর তখনই হঠাৎ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা
ছেলে উমার মুখে রুমাল চেপে ধরে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে চলে যায়। খবরটা শুনে নন্দিনী একমুহুর্ত দেরি না করে থানায় ফোন করে আর নিজে গিয়ে থানার ওসি'র সাথে দেখা করে। সাথে সাথে শহরের সব রাস্তায় নাকাবন্দী করা হয়েছিল বলে মেয়েটাকে নিয়ে পালাতে পারেনি দুষ্কৃতীরা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে উমাকে রাস্তার ধারে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় গাড়ি থেকে। অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ উমাকে
উদ্ধার করে রাস্তার পাশে একটা ঝোপের মধ্যে থেকে। সেই রাতেই ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর দুদিন বাদে মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে আসে নন্দিনী। মাথায় চারটে স্টিচ পরলেও অন্য কোনো ক্ষতি হয়নি বলেই জানা গেছে রিপোর্টে। ডিসচার্জ সার্টিফিকেট হাতে ধরে মানুদি ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মেয়ে আর বাড়ি ফিরতে চায়নি। তাই নন্দিনী ওকে এখানেই নিয়ে এসেছে। বেশ কিছু দিন উমা লোক দেখলে ভয় পেত। একলা ঘরে চিৎকার করে কাঁদত। তখন ওকে কাউন্সিলিং করানো হয়। তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছে। এখন ওর দুচোখে শুধুমাত্র আক্রোশ দেখা যায়। বদলা নিতে হবে। যারা ওর মান সম্মান নিয়ে
ছিনিমিনি খেলেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে, দিতেই হবে। তাই এইচ এসের রেজাল্ট যাইহোক না কেন উমা আইন নিয়ে পড়াশোনা করবে। তারপর এইসব ক্রিমিনালগুলোকে উপযুক্ত শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবে। কোনো ভাবেই যেন এরা সমাজের বুকে বুকচিতিয়ে ঘুরে বেড়াতে নাপারে সেই ব্যবস্থাই করবে উমা। নন্দিনীই হল ওর একমাত্র আদর্শ, পরম আশ্রয়, শক্তি ও সাহসের ভান্ডার। উমার জীবনে ফিরে আসা এই আত্মবিশ্বাসকে নন্দিনী এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিছু অসামাজিক লোকজনের জন্য সাধারণ মানুষের জীবনে যেভাবে অন্ধকার নেমে আসছে তার থেকে মুক্তি পেতে উমা হয়ে উঠুক সব মেয়ের আদর্শ। অত্যাচারিত নিপীড়িত মেয়েরা সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। রুখে দাঁড়াক সব রকম ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে। সমাজ সংসারের সবার মঙ্গলের জন্য নন্দিনী সব সময়ই উমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ন্যায়ের পথে।
Rita chakraborty
C/ o Kalipada chakraborty
160/1, No1, Mohishila colony
(opposite to Milansamity club,Near Hariom
Mandir)
Asansol
Pin-713303
West Barddhaman
West Bengal
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন