প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

অ ণু গ ল্প
১
মতিমাসির যা বাজখাঁই গলা-- বাবা রে বাবা। চমকে গিয়ে আমি একটা বিষম খেয়ে বসলাম। আসলে আমার যেমন স্বভাব, পড়া ভুলে জানালা দিয়ে চড়ুইগুলোর কিচিরমিচির দু'চোখ আর দু'কান ভরে দেখাশোনা চলছিল। মতিমাসি কলতলায় মাছ কুটতে বসেছে বোধহয়, বিড়ালটাকে দেখে এমন একটা চিৎকার দিল, সে তো পাঁচিল থেকে দিল লাফ। সবকটা চড়ুই ঝটপট ডানা মেলে উড়ে পালাল। কেন জানি না, আমার দুম করে মলি আন্টির কথা মনে এল আর আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। ক্লাসে আমরাও ঠিক চড়ুইদের মতোই কিচিরমিচির করে গল্প করি আর মলি আন্টিকে ক্লাসরুমের দরজার বাইরে করিডরে দেখা গেলেই সব্বাই দুদ্দাড় নিজের বেঞ্চে, পিনড্রপ সাইলেন্স।
২
আমাদের সাগরদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অঙ্ক করান মলি আন্টি। এত গম্ভীর যে আমরা হেডদিদিমণির থেকেও বেশি ভয় পাই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, বাবা এবার রেজাল্ট দেখে মলিআন্টিকে বারবার অনুরোধ করে রাজি করিয়েছেন যাতে আমাকে অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দেন। দুদিন গিয়েছি, কি ভালো করে বুঝিয়ে দেন, তবু কেন যে এত বুক দুরদুর করে কে জানে! আন্টির চোখদুটো কি টানাটানা, দেখতেও ভারি মিষ্টি, তবু কেন যে এত গম্ভীর।
৩
বিকেলে মেঘের হাঁকডাক শোনা গেলেও পাত্তা দিইনি। সামনেই ক্লাস নাইনের হাফ-ইয়ার্লি, মাও তাই বারণ করে নি। আমি আবার আজ নীল সালোয়ার পরেছি। "চলে নীল শাড়ি নিঙারি নিঙারি পরান সহিত মোর" লাইনটা মনে পড়ে গেল। বৃন্দাআন্টি কি সুন্দর করে 'পূর্বরাগ' পদটি ক্লাসে বুঝিয়েছিলেন। প্রথমে তো সবাই ঠোঁট টিপে হাসছিল, তারপর যেন বুঁদ হয়ে শুনছিলাম রাধার অভিসার যাত্রার বর্ণনা। এ যেন চেনাজানা প্রেমের কথা নয়, কি এক গভীর ভালোবাসা । হৃদয়ে যাকে ধারণ করে মানুষ নির্জন, একাকী।
৪
মলিআন্টির বাড়ির সামনে পৌঁছতে না পৌঁছতেই জোরে ঝাপটা লাগল, ঝড়টা হুড়মুড় করে এসেই পড়ল। দৌড়ে যখন ভেতরে ঢুকলাম, দেখি দরজার সামনে শিউলিদি, আন্টির সঙ্গেই থাকে, সব কাজ করে দেয়। "যাও ওপরে, দিদি পড়ার ঘরেই আছে।" সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের ঘরের সামনে যেতেই গানের সুরটা কানে এল--
"সব যে হয়ে গেল কালো নিভে গেল দীপের আলো
আকাশ পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে।
............... ................ .............
যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে।"
তখন দুএক ফোঁটা বৃষ্টিও শুরু হয়েছে, তবু মলিআন্টির গাল বেয়ে যে জলের ধারা গড়িয়ে নামছিল, তা যে সুন্দর চোখদুটো থেকেই সেটা বুঝতে আমার ভুল হয়নি। কি নরম, কি সুদূর মনে হল আন্টিকে। বুকের মধ্যে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল, আমি যেন কাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। পদাবলীর রাধার মতো আন্টিও যেন ঝড়জলের মধ্যে দিয়ে গানের সুরে ভেসে ভেসে অভিসারে চলেছেন। বাইরে অন্ধকার, খোলা ছাদে দাঁড়ানো দিদিমণি আর সিঁড়ির প্রান্তে আমি গহন আঁধারে ঝড়ের রাতে প্রিয়ের কাছে পৌঁছনোর পথ খুঁজে চলছিলাম।
![]() |
মুদ্রিত সংখ্যার প্রচ্ছদ |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন