দেবী কন্যাকুমারী কেন আজীবন কুমারী
- ডঃ রমলা মুখার্জী
কন্যাকুমারী দেবী দুর্গারই একরূপ। দেবীর নামানুসারেই তামিলনাড়ুর এই তীর্থনগরীর নাম কন্যাকুমারী। খুবই জনপ্রিয় এই তীর্থস্থান। একদিকে ভারতভূমির শেষপ্রান্ত আর অন্যদিকে আরবসাগর, ভারতমহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর এই তিন সমুদ্রের সম্মিলন। এইজন্য একে ত্রিবেনী সঙ্গমও বলা হয়।
উত্তরদিকের তোরণদ্বার দিয়ে কুমারী মন্দিরে প্রবেশ করার প্রধান পথ। পরমাসুন্দরী বালিকারূপিণী দেবী ডানহাতে মালা নিয়ে তপস্যারতা। তামিল বৈশাখী মাসে (মে-জুন) বৈশাখ উৎসব খুব ঘটা করে এখানে হয়। দু বেলা দেবীকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়। সাদা মার্বেল পাথরে তৈরী মূর্তিটি ভারি সুন্দর।
আমার মনে প্রশ্ন জাগল দেবী কেন এখানে কুমারী? অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম সেই পৌরাণিক কাহিনি।
একসময় দৈত্যরাজ বালাসুর দেবতাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে করতে দেবতাদের পরাজিত করে তাদের শুধু বিতাড়িত করল না নির্মম অত্যাচার করতে লাগল। সহ্য করতে না পেরে মা বসুন্ধরা বিষ্ণুদেবের কাছে গেলেন। শ্রীবিষ্ণু পরাশক্তির স্মরণ নিতে বললেন কারণ একমাত্র পরাশক্তিই পারবে প্রবল পরাক্রান্ত বালাসুরকে নিধন করতে। দেবতারা আয়োজন করলেন যজ্ঞের, উদ্দেশ্য পরাশক্তিকে প্রসন্ন করা। দেবী দেখা দিয়ে বললেন, "আমি অবিলম্বে বালাসুর ও অন্যান্য অসুরদের বিনাশ করব।" দেবতারা তাঁর কথায় আশ্বস্ত হলেন। দেবী পরাশক্তি কুমারী বালিকারূপে কন্যাকুমারীতে এসে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। কন্যাকুমারী থেকে মাত্র তেরো কিলোমিটার দূরে সুচীন্দ্রম মন্দির। সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব থাকেন। শিবঠাকুর কুমারী কন্যাটিকে দেখে তার প্রতি অনুরক্ত হলেন ও বিবাহ করতে চাইলেন। বিবাহের আয়োজন চলতে লাগল। কত চাল, ডাল ভোজের জন্য আসতে লাগল। কিন্তু বালাসুর ব্রহ্মার বরে কেবলমাত্র কুমারী কন্যার হাতেই বধ্য তাই দেবর্ষি নারদ শুনে তো প্রমাদ গুনলেন। ব্রহ্মার বিধানে আর কেউ তো বালাসুরকে মারতে পারবে না। তাই নারদ শিবকে গিয়ে বললেন বিবাহ হবে মধ্যরাত্রের এক বিশেষ শুভলগ্নে। শিবের মনে আনন্দের সীমা নেই। সুচীন্দ্রম মন্দির থেকে শিব সেজেগুজে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। শিব যখন বালুকুমপরাইতে (সূচীন্দ্রম মন্দির থেকে ৫ কিমি দূরে) এসে পৌঁছালেন নারদ এক ফন্দী আঁটলেন। এক মোরগের রূপ ধরে নারদ উচ্চরবে ডেকে উঠলেন। শিব মনে করলেন রাত্রি শেষ হয়ে ভোর হয়ে গেছে। বিবাহের শুভলগ্ন অতীত ভেবে তিনি বিরহ কাতর
বক্ষে ফিরে গেলেন সুচীন্দ্রমে। বিয়ে হলনা। দেবীও পণ করলেন তিনি চিরকুমারী থাকবেন তাই কন্যাকুমারীর দেবী কুমারী। বিবাহের জন্য আয়োজিত সমস্ত অন্ন ও খাবার কাঁকর আর বালিতে রূপান্তরিত হয়ে আজও সমুদ্রতীরে সেই অলৌকিক কাহিনীর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
এদিকে কুমারী কন্যার অপরূপ রূপের খ্যাতি লোকমুখে শুনে বালাসুরও কুমারী কন্যাকে বিবাহ করতে চাইলেন। দেবী যখন কিছুতেই তাকে বিবাহ করতে সম্মত হলেন না তখন বালাসুর দেবীকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। বালাসুর যেই বিরাট তরবারি বার করেছেন দেবীও বার করেছেন তাঁর কালান্তক অসি। চলল প্রবল যুদ্ধ। কিন্তু অশুভের পরাজয় শুভের জয়। অবশেষে দেবী চক্র দিয়ে বালাসুরকে সংহার করলেন। দেবতারা নিশ্চিত হয়ে দেবীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ফিরে এলেন স্বর্গে আর সুখে বাস করতে লাগলেন। কুমারী দেবীর নাকে হীরের নাকছাবির মতই আমার মনের মণিকোঠায় এই কাহিনি চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
পরের দিন গেলাম কন্যাকুমারী থেকে ১৩ কি.মি দূরে সুচীন্দ্রমের স্থানুমলয়ন মন্দিরে, যেখান থেকে শিব কন্যাকুমারীতে আসছিলেন বিবাহ করতে। বৈষ্ণব ও শৈব এই দুই সম্প্রদায়ের কাছে এই মন্দিরটি মহা পুণ্যস্থান। মন্দিরগর্ভে একটি মাত্র লিঙ্গ। লিঙ্গটির নাম স্থানুমলয়। লিঙ্গ একটি হলে কি হবে?- একটি লিঙ্গেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই তিন দেবতার ভাবদ্যোতক মন্দিরের অলিন্দে ১৮ ফুট লম্বা শ্রী হনুমানজীর সুন্দর মূর্তিটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্যকলা সত্যই প্রশংসনীয়।
-----------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
১) দেবীকন্যাকুমারি
২) ত্রিবেণী সঙ্গম
----------
ডঃ রমলা মুখার্জী,
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী,
হুগলী, ৭১২১৩৪, পঃ বঃ
হোয়াটসঅ্যাপ- ৯৪৭৪৪৬২৫৯০
মোবাইল- ৭০০৩৫৫০৫৯৫
Sent from RediffmailNG on Android
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন