Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

মরীচিকা ।। সেখ মেহেবুব রহমান

মদের গ্লাসটি টেবিলের ওপর সজোরে রেখে মাথা হেঁট করে বসলেন দেবাশিষ বাবু। পাড়া গ্রামে লোকচক্ষুর সামনে এমন মদের ঠেক প্রায়শই দেখা মেলে। উনি নিজে এক সময় এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে আজ উনি এখানের নিয়মিত খদ্দের। বাড়ির অমত থাকা সত্ত্বেও এখানে ছুটে আসতে বাধ্য। দীর্ঘ লক ডাউনে কর্মহীন হয়ে পরা মানুষের কাছে যন্ত্রণা নিবারনের এটাই একমাত্র উপায়। আর একটা পথ অবশ্য আছে। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে শেষ করে দেওয়া। কিন্তু দেবাশিষ বাবু তাতে ভয় পান। নেশার ঘোরে নিজেকে নিমজ্জিত রাখাই ওনার সহজতর বলে মনে হয়েছে।

উনি কলকাতার এক বেসরকারী অফিসে কর্মরত ছিলেন। ফাইল একজনের থেকে অন্য জনের কাছে স্থানান্তরিত করে দেওয়ায় ওনার কাজ ছিল। ইন্টারনেট র যুগে এ'কাজ যদিও ইমেলের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই শেষ কয়েক বছর ওনাকে তেমন কোনো কাজ করতে হয়নি। দীর্ঘদিনের এম্প্লয় হওয়াই কোম্পানিও ওনাকে কাজ থেকে বিতাড়িত করেনি। কিন্তু এই অতিমারীর কোপে যখন সমস্ত শিল্পকর্ম লসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, দেবাশিষ বাবুর কোম্পানিও সেই ধরার ব্যাতিক্রম নয়। তাই ওনার মত দীর্ঘ দিনের কর্মীকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়।

দেবাশিষ বাবু শারীরিক ভাবে দুর্বল প্রকৃতির। ছোটো থেকেই এপিলেপসি নামক স্নায়ু রোগে উনি আক্রান্ত। গ্রামবাংলায় এটা মৃগী রোগ নামে পরিচিত। এই অসুস্থতা তাকে দীর্ঘদিন যেমন কর্মহীন করে রাখে তেমনই অনেকের কাছে তিনি অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সকলে তাকে অচ্ছুৎ করে রাখে, ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে। সাধারণ মানুষের মনে এই রোগ নিয়ে এইরকম অভিপ্রায় এখনও সচরাচর দেখা মেলে।

তার এই অক্ষমতার জন্য, দীর্ঘদিন কর্ম সন্ধানী ছিলেন, কেউই শারীরিক ভাবে অক্ষম এই মানুষটিকে চাকরি দিতে চায়নি। অনেক খোজা খুঁজির পর এই কাজের সন্ধান মেলে। বছর পচিশ আগে যখন যন্ত্র সভ্যতার রমরমা আসেনি তখন দেবাশিষ বাবুর মত লোক কোম্পানীর কাছে ছিলেন মূল্যবান। কিন্তু এখন দীর্ঘ ছয়মাসের এই যন্ত্রণা ওনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

দেশ জুড়ে আনলক প্রক্রিয়া শুরু হলে, এক এক করে দেবাশিষ বাবুর সমস্ত কলিং কাজে যোগ দেয়, যদিও কোম্পানী থেকে ওনার ডাক আসেনি। প্রথমে কিছুদিন নিজে থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন। শেষে বাধ্য হয়ে ফোন করেন। তখন কোম্পানী থেকে সরাসরি বিতাড়নের কথা জানানো হয়নি। ওনাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলে, ফোন রেখে দেয়। পরে উনি আরও কয়েকবার চেষ্টা করলেও, তারা আর ফোন রিসিভ করেনি। পঞ্চাশোর্ধ দেবাশিষ বাবুর পক্ষে এর কারণ বোঝা কঠিন ছিল না। বাধ্য হয়ে পুরনো কাজ ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে এই বয়েসে নতুন কাজের সন্ধানে মনোনিবেশ করেন। ষাটের দরজায় কড়া নরানো দেবাশিষ বাবুকে কাজ দিতে কেউই আগ্রহ দেখায়নি। আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী সকলেই তাঁর প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েছেন। পরিবারের মানুষজনের মুখে অন্ন তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণা, অচিরেই ওনার গলায় বিষাক্ত মাদক ঢেলে দিয়েছে।

দেবাশিষ বাবুর এই সীমাহীন কষ্টের আরও একটা কারণ ওনার বিবাহ বয়স্কা মেয়ে। লক ডাউনের আগেই মেয়ের বিবাহ স্থির হয়ে যায়। পাত্রপক্ষ বিশাল অঙ্কর অর্থ দাবি করলেও উনি তাতে আপত্তি করেননি। ভেবেছিলেন, অফিস থেকে লোন নিয়ে মেয়ের বিয়েটা অন্তত উতরে দিতে পারবেন। কিন্তু সব যেন এক অজানা ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল। এদিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতেই পাত্র পক্ষের বিয়ের তাড়া দিতে শুরু করল। দেবাশিষ বাবুর এই নির্মম অবস্থা বোঝার ক্ষমতা হয়তো তাদের নেই। মানুষটার ওপর চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। সমস্ত সমস্যার সমাধান শুধু অর্থ। কিন্তু সেই বিপুল অর্থ তিনি পাবেন কোথা থেকে?

আজ মদের ঠেকে কয়েক গ্লাস উত্তেজক পানীয় গলাধকরন করে টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে বসে আছেন। নেশা হয়েছে, তবে তা যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে পারেনি। আশেপাশের কোলাহল মনে বিরক্তি আনলেও, তিনি আর উঠে যেতে পারলেন না। এক অদ্ভূত শক্তি তার দু'পা চেয়ারের সামনের পা জোড়ার সাথে বেঁধে রেখেছে। দু একজন তো তার শরীরে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। উনি অবিচল রইলেন!

মিনিট দশ এইরূপ বসে থাকার পর, এক অচেনা ব্যক্তি তার আসনের অন্য প্রান্তে থাকা চেয়ারটায় বসে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতে দেবাশিষ বাবু কিঞ্চিত মাথা তুললেন। লোকটাকে দেখে অদ্ভূত মনে হলেও, তাকে পুঙ্খানু পুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন না। অতএব পুনরায় মাথা নামিয়ে নিলেন। অচেনা ভদ্রলোক এবার তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে বলল, "আপনার তাহলে টাকার প্রয়োজন নেই মনে হচ্ছে?"

প্রথমে সেই ব্যক্তি কি বলেছিল উনি শুনতে পাননি। কিন্তু টাকার কথা কানে তীব্রভাবে প্রবেশ করতেই উনি সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে মাথা তুলে বসলেন। জড়ানো গলায় বেশ উৎসাহী মন নিয়ে বললেন, "আমার টাকার প্রয়োজনের কথা আপনি কি করে জানলেন?"

লোকটি বলল, "সে কথা ছাড়ুন না। দরকার কিন্তু আপনার, তাই সরাসরি কাজের কথায় আসা ভালো"

দেবাশিষ বাবু হকচকিয়ে গেলেন। টাকা পয়সার সন্ধান পেয়ে নিজে না নিয়ে অন্যজনকে জানিয়ে দিচ্ছে! এই যুগেও এমন লোক আছে। ওনার বিশ্বাস হলো না, বললেন, "লক্ষাধিক টাকার দরকার। এনে দিতে পারবেন?"

লোকটি প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, "তার থেকেও অনেক বেশি পাবেন। প্রায় ১০ লক্ষ মতো। আপনার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। সংসারটাও দাড়িয়ে যাবে"।

দেবাশিষ বাবু এবার নরে চড়ে বসলেন। নেশাতুর দু চোখের পাতা গোল গোল করে পাকিয়ে লোকটিকে আপাদমস্তক দেখতে শুরু করলেন। এমন অদ্ভুত আচরণের মানুষটির বাহ্যিক আবির্ভাব চোখে পড়ার মতন। বাইরে বৃষ্টি হয়নি তারপরেও ওনার শরীর জলে ভেজা। প্যান্টের নিচের দিকে পাঁকের কালো দাগ স্পষ্টতই জানান দেয়, লোকটি এখানে আসার পূর্বে জলাশয়ে নেমেছিল। দেহ থেকেও পচা গন্ধ বেড়িয়ে আসছে। এমন এক ব্যক্তির থেকে এইরূপ কথা দেবাশিষ বাবু মন থেকে হজম করতে পারলেন না। বললেন, "আপনি কোথা থেকে শুনলেন? আর আমাকেই বা বলছেন কেন? আপনি নিজেই তো নিয়ে পারতেন?"

দেবাশিষ বাবুর একগুচ্ছ প্রশ্ন শুনে লোকটি মুচকি হাসলো। হাসির মধ্যে রহস্য লুকিয়ে আছে সেটা পরিষ্কার, কিন্তু সবটা দেবাশিষ বাবুকে বলতে আগ্রহী নন। হয়তো বলা যাবে না। তারপর ওনার দিকে রহস্য পূর্ণ চোখ করে বলল, "আপনার টাকা দরকার, ব্যাস শুধু সেটুকু নিয়েই শান্ত হন। কিভাবে, কেন এত প্রশ্ন করবেন না"।

দেবাশিষ বাবু হা'করে তার দিকে চেয়ে রইলেন। লোকটি একটু থেমে মনে মনে কিসব বিড়বিড় করল। তারপর একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, " একটা কারণ আপনাকে বলতে পারি। আমি সাঁতার জানি না। জলে নামার চেষ্টা করেছিলাম। হাঁটু অবধি জলে নামতেই আমার এই অবস্খা, তাই এমন লোক খুঁজছিলাম যার টাকার প্রয়োজন, আমায় সাহায্য করবে, কিন্তু ঠকাবে না। আপনাকে আমার ভরসাযোগ্য মনে হলো। আপনি সাঁতার জানেন তো?"

দেবাশিষ বাবু বললেন, "সে সব তো বুঝলাম, কিন্তু…"

লোকটি বিরক্ত হয়ে বলল, "মনে এত কিন্তু থাকলে কোনো কিছুর হদিশ দেব না। সব প্রশ্নের উত্তর আপনার না জানলেও চলবে। না'হলে আমি অন্য কাউকে দেখবো"।

দেবাশিষ বাবু নেশাগ্রস্থ ছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তার মনের নেশা অচিরেই ঘুচে গেছে। উপলদ্ধি করলেন আর কথা না বাড়ানোই ভালো। কিন্তু উনি তো সাঁতার জানেন না! স্নায়ুবিক সেই জটিল রোগের জন্য উনি ছোটো থেকেই এরকম নানাবিধ কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। সেকথা প্রকাশ করলে যদি ওনাকে টাকার সন্ধান না দেন! কিন্তু টাকার যে ওনার বড্ড প্রয়োজন, অর্থাৎ এড়িয়ে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করলেন। তারপর সেই অচেনা ব্যাক্তির দিকে একটু ঝুঁকে জিঞ্জাসা করলেন, " আচ্ছা টাকাটা কি কোনো জলাশয়ের আশেপাশে রাখা আছে?"

লোকটি হেসে বলল, "জলাশয়ের আশেপাশে নয়, জলের তলায় ব্যাগের মধ্যে আছে"।

দেবাশিষ বাবু বললেন, " তাহলে আর কোনো টাকায় আস্ত থাকবে না। সব ভিজে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে"।

লোকটি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, "না না, সেটা হবে না। আমি ওখানে টাকা রাখতে নিজে দেখেছি"।

দেবাশিষ বাবু সন্দেহের বশে বললেন, "চুরি ডাকাতির টাকা! আপনিও সেই দলে ছিলেন নাকি?"

"না মশায়"

"তাহলে? অন্তত এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলুন"

লোকটি বিরক্ত না হয়ে বলে চলল, "আপনাদের গ্রামে ঢোকার আগে, রাস্তার ধারে পরিত্যাক্ত দোতলা বাড়ি আছে। বোধহয় ওটা ভাঙা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, রাতের অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। ওটার পিছনে একটি বড়ো পুকুর রয়েছে। চারিদিকে বাঁশ ঝাড়। আরও নানা গাছ আছে। কাল ভোরে যখন ওখান দিয়ে যায়, দেখি একদল লোক পুকুরের একপ্রান্তে জলের তলায় কিছু একটা পুঁতে দিচ্ছে। বেশ ভালোভাবে বাঁধা আছে। কালো ব্যাগ, পলিথিন মোড়া। আড়াল থেকে আমি সবটা লক্ষ করি। পরে ওখান থেকে ফেরার সময় বলা কওয়া করছিল 'এই দশ লাখ এখানেই থাক, সময় করে নিয়ে যাব'। আজ রাতে হয়তো ওরা আসতে পারে। আমাদের তার আগেই ওটা নিতে হবে, নাহলে সব স্বপ্নই থেকে যাবে"।

দেবাশিষ বাবু মন দিয়ে সব শুনে, উৎসাহের সহিত বললেন, "তাহলে আর বসে থেকে লাভ কি? এখান থেকে তো মিনিট কুড়ি লাগবে হেঁটে"।

লোকটি বলল, "আমি আপনাকে লোকেশনটা দেখিয়ে দিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখব। টাকা পাওয়ার পর সোজা আপনার বাড়ি। তারপর বাকিটা দেখা যাবে"।

দেবাশিষ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আকণ্ঠ মাদকে পরিপূর্ণ থাকলেও, মদের নেশা টাকার নেশাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। বেশ সাবলীল ভাবেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন। পথে দুজনে সেইভাবে কথা বললেন না।

দেবাশিষ বাবু সৎ প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু এই অসৎ কাজে ওনার মন একটুও ভীত হলো না। এই পাপ কাজ ওনার হৃদয় নাড়িয়ে দিতে পারল না। কেনই বা দেবে? জীবনের বেশিরভাগ সময় তো মন দিয়েই কাজ করেছেন, কালো দাগের একটা বিন্দুও ওনার গায়ে লাগেনি। কিন্তু প্রাপ্তি তো শুধুই শূন্যতা। সততার মুল্য তো কোম্পানি জীবনের কঠিন সময়ে দেয়নি। তাই অন্তত একবার এই লোভী পথ বেছে নিতে দ্বিধা করলেন না।

ওনার মন এখন আনন্দে খয়ের মত ফুটছে। দীর্ঘদিনের দারিদ্রতা এক লহমায় ঘুচে যাবে, এর থেকে সুখ আর কি হতে পারে। মেয়ের বিয়ে, সংসার দাঁড় করানো সব যেন এবার সময়ের অপেক্ষা।

বেশকিছুক্ষণ পর সেই পুকুর প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন। গভীর কালো অন্ধকার চারিদিকে; কাজটাও তো কালো। অর্থাৎ ঘটনা আর পরিস্থিতি একে অপরের পরিপূরক। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে লোকটি দেবাশিষ বাবুকে পুকুরের উত্তর প্রান্তে একটা জায়গা আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল। বলল, "সাবধানে যাবেন, ওখানেই রেখে গেছে"।

দেবাশিষ বাবু বললেন, "আপনি নিশ্চিত তো?"

লোকটি গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, "আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওখানেই আছে। এখনও থাকবে। ওরা কেউ এখনও অবধি আসেনি। আপনি জলদি নামুন"।

দেবাশিষ বাবু কথা বাড়ালেন না। টর্চটা লোকটিকে দিয়ে পুকুরে নামতে উদ্যত হলেন। যদিও শুরুতেই হোঁচট খেলেন, নামতে গিয়ে পা পিচ্ছলে জলে পড়লেন। লোকটি দ্রুত সাবধান বাণী শুনিয়ে বলল," সামলে একটু, পুকুরটা বেশ গভীর"। 

দেবাশিষ বাবু বললেন, "হুম জানি, আপনি শুধু খেয়াল রাখুন"।

উনি সাঁতার জানেন না, কিন্তু সেই খেয়াল আর ওনার মাথায় এলো না। টাকার গন্ধ যেন সেই অক্ষমতার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। এক কোমর জলে নামতেই টর্চের আলো হঠাৎ নিভে গেল। উনি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, শুধুই অন্ধকার, দূরে ঝি ঝি ডাকছে। গাছগুলো প্রাণ হারিয়ে মড়ার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেবাশিষ বাবু চিৎকার করে বললেন, "কোথায় গেলেন? লাইট নেভালেন কেন?" 
কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না। বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালেন, গভীর অমাবস্যা যেন চারিদিক ঘিরে ধরেছে। মনে ভয় এল, যদিও উনি এই নিসঙ্গতা উপেক্ষা করে টাকা খুঁজতে আরও গভীরে নামলেন। তারপর সন্ধানী মনে ডুব দিলেন জলতলে, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। অন্ধকার তলদেশে হাত পা নেড়ে খোঁজার চেষ্টা করলেন,  বিফল হলেন। আরও একটু গভীরে নামলেন, তারপর আবার ডুব দিয়ে কোনোরকমে সাঁতরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শুধুই শূন্যতা। বিফল হলেও, বিষন্ন হলেন না। স্থির করলেন গভীরতা আরও একটু বাড়িয়ে নেবেন, কিন্তু এতেই বিপত্তি নেমে এল। পুনরায় ডুব দিতে আর উঠতে পারলেন না। বার বার চেষ্টা করতে থাকলেন, কিন্তু পারলেন না। সাঁতারে অন্য পাড়ে যাবার চেষ্টা করলেন, যদিও জল গভীরতা ওনার গতি রুদ্ধ করে দিল। অনুভব করলেন ক্রমেই আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছেন। কিন্তু টাকার ঘোরে এতটাই মত্ত, চিৎকার করে সেই অচেনা ব্যাক্তির সাহায্য চাইলেন না। বরং সব কিছু উপেক্ষা করে টাকা খুঁজতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। সময় যত এগোলো ওনার অস্থিরতা ততই বেড়ে চলল। অজান্তেই তিনি জীবন মৃত্যুর খেলায় অংশগ্রহণ করে ফেলেছেন। ধীরে ধীরে চোখের সামনে ধোঁয়াশার উদ্ভব হতে শুরু করল। মৃত্যু যেন দ্রুত গতিতে তার দিকে ছুটে আসছে।

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হঠাৎ উপলদ্ধি করলেন ওনার থেকে কিছু দূরেই সেই কাঙ্খিত ব্যাগটি রয়েছে। নিস্তেজ শরীরে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেও কিছুই পেলেন না। হতাশ হয়ে পিছন ফিরতেই দেখলেন ব্যাগটি দেবাশিষ বাবুর পূর্ববর্তী অবস্থানে আছে। তৎক্ষণাৎ সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, শরীর আর দিল না।

ধীরে ধীরে মৃত্যু ওনাকে গ্রাস করতে শুরু করলো। দেহের অঙ্গ গুলো একে একে নিষ্প্রাণ হয়ে জীবন সংগ্রামের ইতি টানলো। চোখের পলক শেষ বারের মত ফেলার আগে অবধি, উনি টাকা পেয়ে যন্ত্রণা নিবারণের কথা ভেবে গেলেন। যে অর্থের খোঁজ উনি পেয়েছিলেন, অস্পষ্ট উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিন্তু স্পর্শ করা হলো না। মরীচিকার মত ধোঁকা দিয়ে চলে গেল।

পরের দিন সকালে ওনার ভাসমান দেহ উদ্ধার করলো পুলিশ। তদন্ত শুরু হল। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না। দেহে মাদকের উপস্থিতি মেলায়, শেষে এটাই প্রমাণিত হল, নেশার জন্যই বেঘোরে প্রাণ খুঁয়েছেন। তদন্তের সময় কেউই সেই অপরিচিত ব্যাক্তির অস্তিত্বের কথা বলল না। পরেও কারো মুখে তার কথা উচ্চারিত হল না। তাহলে কী দেবাশিষ বাবুই শুধু তাকে দেখতে পেলেন! লোকটির কি সত্যিই অস্তিত্ব ছিল? যদি না থাকে তাহলে দেবাশিষ বাবুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল কে? অস্তিত্ব থাকলে তিনি কোথায় গেলেন? কেউ দেখলো না কেন? হাজারো প্রশ্নের মাঝে, অর্থহীন মরুভূমির মত জীবনে, সেই ব্যক্তিও দেবাশিষ বাবুর কাছে মরীচিকার মানবিক রূপ হয়ে রয়ে গেল।

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩